‘ছক্কা ছয়ফুর’ থেকে ‘শাহজাহান মাস্টার’
- আপডেট সময় ০৫:১০:১৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ জুন ২০২৩
- / ১২৯৯ বার পড়া হয়েছে
১৯৯০ সালে সিলেট সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছিলেন ছয়ফুর রহমান। যিনি পেশায় সড়কের পাশের একটি ভাঙা রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি ছিলেন। মাঝেমাঝে ঠেলাগাড়িও চালাতেন। একেবারে অপরিচিত সাধারণ এই শ্রমজীবীকে সেবার বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছিলেন সিলেট সদর উপজেলাবাসী।
হেভিওয়েট প্রার্থীদের হারিয়ে ভোটের মাঠে এমন ছক্কা হাঁকানোতে ছয়ফুর রহমানের নাম হয়ে যায় ‘ছক্কা ছয়ফুর’। এই নামেই তিনি পরিচিতি পান সারা দেশে। তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে সিলেটের বাইরেও।
সদ্য সমাপ্ত সিলেট সিটি নির্বাচনেও এরকম একজন সাধারণ শ্রমজীবী মেয়র প্রার্থী চমক সৃষ্টি করেছেন। শাহজাহান মিয়া নামের এই প্রার্থীও পেশাগত জীবনের শুরুর দিকে ছাপরা রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিলেন। ‘শাহজাহান মাস্টার’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত।
মেয়র পদে জিততে না পারলেও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন শাহজাহান মাস্টার। ছক্কা ছয়ফুরের মতো শাহজাহান মাস্টারেরও কোন পোস্টার, লিফলেট, মিছিল-শোডাউন ছিলো না। ছিলো না কোন কর্মী বাহিনীও। জনগণের দেওয়া অর্থ সহায়তায় বাইসাইকেল চড়ে একা একা প্রচার চালিয়েই ২৯ হাজার ৬৮৮ ভোট পেয়েছেন তিনি। বুধবারের এই নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট।
মাত্র সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়ার বস্তি সদৃশ একটি আধপাকা দুই কক্ষের ঘরে পরিবার নিয়ে থাকেন শাহজাহান মিয়া। ঘরে আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই। সামনের কক্ষে একটি বিছানা, জীর্ণ আলনা ও সেলাই মেশিন, আর একটি ভাঙা সোফা আছে বটে তবে সেটিতে একের অধিক লোক বসলেই ঘাইঘুই করে ভেঙে পড়ার হুমকি দেয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুরমা নদী লাগোয়া নগরের ঘাসিটুলা মজুমদার পাড়া এলাকার এই বাসায় গিয়ে আলাপ হয় মেয়র পদের আলোচিত এই প্রার্থীর সাথে। তখন তিনি বিছানায় বসে ভাত খাচ্ছিলেন। ডিম আর আলুর তরকারি দিয়ে। ঘরের দুই কক্ষ মিলিয়ে বৈদ্যুতিক লাইট মাত্র একটি। আর এটির আলো এতোই ক্ষীণ যে সামনের লোকটির মুখও ভালো করে দেখা যায় না।
আলাপ করে জানা যায়, ময়মনসিংহ থেকে অভাবের তাড়নায় ২০০২ সালে সিলেট আসেন শাহজাহান। তখন তিনি নিতান্ত কিশোর। সিলেটে এসে নগরের কানিশাইল এলাকার একটি ছাপরা রেস্টুরেন্টের ‘গ্লাস বয়ের’ চাকরি নেন তিনি। গ্লাস বয় মানে গ্লাস ধোয়ামোছার কাজ করা।
রেস্টুরেন্টে কাজ করলেও পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিলো তার। তাই কাজের পাশাপাশি ভর্তি হন নগরের ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ময়মনসিংহ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। আর ২০১৮ সালে সিলেটের মদন মোহন কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন এই অদম্য তরুণ।
এই সময়কালে সিলেটের প্রায় ৮০টির মতো রেস্টুরেন্টে কাজ করেন শাহজাহান। কাজ করেছেন মোমবাতি কারখানায়ও। এতে একটা বিরাট লাভ হয় শাহজাহানের।
তিনি বলেন, অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট ও কারখানায় কাজ করার ফলে শ্রমিকশ্রেণির সাথে আমার ভালো পরিচয় হয়। তারাও আমাকে পছন্দ করেন। এই নির্বাচনে তারা আমাকে বিরাট সহায়তা করেছেন।
মেয়র পদে ৮ প্রার্থীর মধ্যে অর্থে ও ‘সামাজিক মর্যাদায়’ সবচেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ব্যতিক্রমী প্রচারের কারণে নজর কাড়েন তিনি।
ছক্কা ছয়ফুরের মতো ব্যতিক্রমী নির্বাচনী প্রচারের মাধ্যমেই প্রথম দৃষ্টি কাড়েন শাহজাহান। সকালেই নিজের বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। একা একা সাইকেল নিয়েই চষে বেড়াতেন নগর। যেতেন ভোটারদের কাছে। প্রচারসামগ্রী বলতে কেবল লিফলেট, তাও অন্যের টাকায় ছাপানো। সেগুলো তুলে দিতেন ভোটারদের হাতে। ভোট ও দোয়া চাইতেন। এই নিঃসঙ্গ প্রচার চালিয়েই প্রথম নজর কাড়েন শাহজাহান।
নিজের প্রচারণা সম্পর্কে শাহজাহান মিয়া বলেন, সকালে সাইকেল নিয়ে বের হতাম আর সন্ধ্যায় ফিরতাম। এই সময়ে যতোটা সম্ভব মানুষের কাছে যেতাম। আমার চা নাস্তা বা খাওয়ার চিন্তা করতে হতো না, প্রায় সব রেস্টুরেন্টের শ্রমিকরাই পরিচিত। তারা খাওয়াতেন।
তিনি বলেন, টাকা পয়সা না থাকায় ব্যানার পোস্টার করতে পারিনি। লিফলেটও অন্যরা করে দিয়েছেন। নির্বাচনে আমার পকেট থেকে সবমিলিয়ে ২/৩ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।
এখন স্থায়ী কোন পেশা নেই তার। যখন যা পান তা করেন। বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ সাপ্লাই দিয়ে থাকেন। নিজের একটা ফার্মেসিও ছিলো, তবে এখন আর নেই।
নিজেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তবু মানুষের সেবায় সবসময়ই অগ্রণী শাহজাহান। কানিশাইল এলাকার ফ্রি চিকিৎসাকেন্দ্র খুলে গরিব শ্রমজীবীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। কোচিং সেন্টার খুলে গরিব বাচ্চাদের ফ্রি পড়িয়েছেন, এমনকি করোনার সময় ২০০ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন বলে জানান শাহজাহান।
নিজের নামের সাথে মাস্টার শব্দ যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে শাহজাহান বলেন, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি আধা সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছি। এছাড়া কোচিং সেন্টারে ফ্রি পড়াই। তাই সবাই শাহজাহান মাস্টার ডাকে।
প্রায় ৩০ হাজার ভোট পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানুষ মায়া থেকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছেন। তারা আমাকে পছন্দ করেছেন। এই ঋণ শোধ হবার নয়।
শাহজাহান বলেন, আমার প্রতীক মানুষে জানতো না। আমি একা মানুষ। সবার কাছে যেতে পারিনি। না হলে আরও ভোট পেতাম।
‘ছক্কা ছয়ফুরের’ মতো শাহজাহান মাস্টারেরও ভোটের নেশা। ছয়ফুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন। আর শাহজাহান গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনের এমপি পদে মনোনয়ন কিনেছিলেন। কিন্তু জমা দিতে পারেননি। মনোনয়নপত্রের সাথে এক শতাংশ ভোটারের সাক্ষর নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। তখন তা যোগাড় করতে পারেননি।
তিনি বলেন, ছোটকালে পরিকল্পনা ছিলো জনপ্রতিনিধি হওয়ার। আমি ছোটবেলায় পড়ালেখার খাতা কলম কিনতে পারিনি। তাই মানুষের সেবা করার ইচ্ছা আমার সব সময়ের। এ কারণে নির্বাচনে প্রার্থী হই। জনসমর্থন থাকলে আগামীতেও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ রয়েছে বলে জানান শাহজাহান মিয়া।
ছক্কা ছয়ফুরের মতো শাহজাহান মিয়াও জনগণের ক্ষোভের ভোট পেয়েছেন জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন- সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে বড় দলগুলোর প্রার্থী পছন্দ হয়নি ভোটারদের। তাছাড়া নিরীহ প্রার্থী ছয়ফুরের উপর হামলা মেনে নিতে পারেননি তারা। এই ক্ষোভ থেকে জনগণ ভোট দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলেন ছয়ফুরের বাক্স।
ফারুক মাহমুদ বলেন, এবারও শাহজাহান সম্ভবত ক্ষোভের ভোট পেয়েছেন। পছন্দের প্রার্থী না পেয়ে ক্ষুব্ধ ভোটাররা তাকে ভোট দিয়ে থাকতে পারেন। এছাড়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করলেও তাদের অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। ফলে কাউন্সিলর পদে ভোট দিতে এসব দলের অনেকে ভোট কেন্দ্রের এসেছেন। তাদের অনেক ভোটও শাহজাহান মিয়া পেয়ে থাকতে পারেন।