জুড়ীতে তথ্য দেওয়ায় বন বিভাগের মিথ্যা মামলায় কলেজ ছাত্রের কারাভোগ
- আপডেট সময় ১০:৫৮:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০২৪
- / ১৯১ বার পড়া হয়েছে
জুড়ী প্রতিনিধি- মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বন থেকে সেগুনকাঠ চুরির অভিযোগে ছনির হোসেন নামে এক কলেজছাত্রের উপর মিথ্যা মামলা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এ মামলায় শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে ১৫ দিন জেল খেটে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। লাঠিটিলা বিটের বন কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে মামলার সাক্ষীরা তাকে নির্দোষ দাবী করছেন। অভিযোগ রয়েছে, গাছ চুরির তথ্য গণমাধ্যমকে জানানোর কারণে তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে মামলা দিয়েছেন ঐ কর্মকর্তা। ছনির হোসেন (২০) উপজেলার গোয়াবাড়ী ইউনিয়নের লালছড়া গ্রামের ভিলেজার আসুক মিয়ার ছেলে। সে শিলুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মানবিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
এ ছাড়াও একই মামলায় আরও দুইজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন একই এলাকার মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল (২৮) ও লোকমান মিয়ার ছেলে বদর মিয়া (৩৮)। এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রতিকার চেয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ছনির হোসেন।
ভুক্তভোগী কারাভোগ করা কলেজ শিক্ষার্থী ছনির হোসেন অভিযোগ করে বলেন, এই গাছগুলো সরকারের সম্পত্তি। আমি একজন ভিলেজারের (বন জাগিদার) সন্তান হিসেবে এই বনরক্ষা করা আমার দায়িত্বে পড়ে। আমি বন বিভাগকে গাছ চুরির তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছি। বিট কর্মকর্তা চোরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টা আমার উপর মামলা দিয়েছেন। গাছ চুরির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পরে একাধিকবার বিট কর্মকর্তা আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন কীভাবে এ খবর গণমাধ্যম পেয়েছে। আমি গাছ চুরির তথ্য দিয়েছি। চুরির সঙ্গে জড়িত প্রকৃত চোরদের মামলা দেওয়ার কথা। আমি তো চুরির সঙ্গে জড়িত নই। আমাকে কেন মামলায় জড়ানো হল? এই মামলার জন্য ঈদের আগের দিন থেকে আমি ১৫ দিন জেলে ছিলাম। এখন আমার পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটছে। পড়ালেখা করতে না পারলে আমার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচার চাই এবং প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হোক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে লাঠিটিলা বনের গলাচিপা ও দশেরটিলা থেকে ১৫টির বেশি সেগুনগাছ চুরি হয়েছে। এ ছাড়াও ১৫ থেকে ২০টি সেগুন গাছ রিং পদ্ধতিতে মারা হয়েছে। এই বিষয়টি লাঠিটিলা বিট কর্মকর্তা অবগত হওয়ার পরে বিষয়টি বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে সমাধান করেন। ১৫টিরও বেশি গাছ চুরির ঘটনায় বন বিভাগ অপরাধীদের আইনের আওতায় নেওয়ার কথা থাকলেও বিষয়টি অজ্ঞাত রয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, লাঠিটিলা বন কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পুরো ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা করেন। ১ মাস পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে তৎকালীন সময়ে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও ঘটনাটি জানানো হয়নি। এমন কি সে সময় জুড়ী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হুসাইনকেও অবহিত করা হয়নি বলে জানিয়েছিলেন ঐ কর্মকর্তা। এভাবে সংরক্ষিত বনের গাছ চুরি হলে এক সময় পুরো বন উজাড় হয়ে যাবে বলে মনে করেন ভিলেজাররা। এ বিষয়টি বিট কর্মকর্তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সচেতন কয়েকজন বন জাগিরদার গণমাধ্যমকে অবগত করেন। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে গণমাধ্যমকর্মীকে মুঠোফোনে মামলার হুমকিও দেন ঐ বন কর্মকর্তা। পরবর্তীতে এ নিয়ে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন পত্রিকায় ‘লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে গাছ চুরি থামছে না’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে পুরো এলাকা জুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় কলেজছাত্র ছনির হোসেনকে একাধিকবার বন বিট কর্মকর্তা তার কার্যালয়ে ডেকে গণমাধ্যমে জানানোর কারণ জানতে চেয়ে শাসান। কিছুদিন পরে তিনি জানতে পারেন তার বিরুদ্ধে গাছ চুরির মামলা হয়েছে। গত ঈদুল আযহার আগের দিন তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। ১৫ দিন জেল খেটে জামিনে মুক্ত হন তিনি।
এই মামলায় সাক্ষী ও উল্লেখিত প্রত্যক্ষদর্শী ফরেস্ট গার্ড আব্দুস সাকুর বলেন, ছনির হোসেন গাছ চুরির সঙ্গে জড়িত নয়। যারা প্রকৃত চোর তারা মামলা থেকে বাদ পড়েছেন। প্রকৃত গাছ চুরির সঙ্গে জড়িতরা কোনোভাবে যেন মামলা থেকে ছাড় না পায়। প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
মামলার অপর সাক্ষী আব্দুস শুক্কুর জানান, এই মামলায় কেন তাকে জড়িত করা হয়েছে আমি জানি না। বন বিট অফিসার মাজহারুল ইসলাম আমাদের বস। তিনি যাকে মামলা দিবেন বাধ্যতামূলক সেই মামলায় আমাদের স্বাক্ষর করতে হয়।
অভিযুক্ত বন কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, এলাকার কিছু মানুষের কাছ থেকে তার নাম নিয়ে তদন্ত করে মামলা দিয়েছি। প্রকৃত চোরদের বাদ দিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সে হয়ত কম জড়িত ছিল। এ ঘটনায় জড়িত আরও দুজনকে মামলা দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে মামলা দিয়েছি তা বলা যাবে না। মামলা যেহেতু হয়ে গেছে। ঐ ছেলেকে এখন কীভাবে সাহায্য করা যায় এই ব্যাপারে বুদ্ধি দেন। মামলার সাক্ষীরা অস্বীকার করছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা তো আমার স্টাফ। তারা কি কোর্টে বা আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনে বলবে আমার কথায় স্বাক্ষর করেছে।
বন বিভাগের জুড়ী রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হুসাইন বলেন, ছনির হোসেন নামে যে ছেলেটাকে আসামি করা হয়েছে, সে আমার অফিসে এসেছিল। বিষয়টি আগে জানলে মামলা কোর্টে পাঠানোর পূর্বে তার নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল। এখন আর সুযোগ নেই। সে গাছ চুরির তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এটা ভালো কাজ করেছে। এ জন্য তাকে মামলা দেওয়া ঠিক হয়নি। লাঠিটিলা বিট কর্মকর্তাকে আমি অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন ছেলেটাকে মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, এটা ভুলে হয়ে গেছে। যাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তারা বলেছেন, ছনির হোসাইন জড়িত ছিল।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির বলেন, এমনটি হলে এটি একটি অমানবিক এবং অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। ছেলেটা মিথ্যা মামলায় জেল খাটছে। এটা তো ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। একজন নিরপরাধ মানুষকে তো সাজা দিতে পারে না। তদন্ত করে সে নির্দোষ হলে তাকে মামলা থেকে কীভাবে অব্যাহতি দেওয়া যায় বিষয়টি বিবেচনা করব। এটা তো মজা করার বিষয় নয়। বিট কর্মকর্তা যাচাই-বাছাই না করে কেন এমন ভুল করবে। এ বিষয়ে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।