ব্রেকিং নিউজ
নিরঞ্জন কুমার দেব : একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষকের প্রতিকৃতি
নিজস্ব সংবাদ :
- আপডেট সময় ০২:৫৩:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ৬৮৩ বার পড়া হয়েছে
ফয়সল আহমদ রুহেল :
নিরঞ্জন কুমার দেব। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত, দু:খ-দুর্দশা, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার মত অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন করনিক পদে। এরপর শিক্ষকতা পেশায় মনোনিবেশ করেন। তিনি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার মেহেরুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। মহান এ পেশার সফল সমাপ্তি টেনে অবসরে চলে যান।
জন্মস্থান : নিরঞ্জন কুমার দেব ১৯৬১ সালের ৩০ মার্চ মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার বালিসহস্র এর বাহাদুরগঞ্জ এর এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত মথুর চন্দ্র দেব ও মাতা মৃত রানী বালা দেব। পিতার পেশা ছিল কৃষি কাজ। শিক্ষকের ভাই বোনের সংখ্যা ৫ জন। তাদের মধ্যে তিনি ৩য় সন্তান।
পারিবারিক : নিরঞ্জন কুমার দেব দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। মেয়ে নন্দিতা রানী দেব, চন্দ্রা রানী দেব ও চিত্রা রানী দেব। ছেলে নিলয় কুমার দেব ও নীরব কুমার দেব।
শিক্ষা জীবন : নিরঞ্জন কুমার দেব এর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি ১৯৬৬ সালে বড়গাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৭১ সালে রাজনগর পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিকে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মৌলভীবাজার মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিকে ৩য় বিভাগ পান। ১৯৮০ সালে বিএ পাস পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন।
কর্মজীবন : নিরঞ্জন কুমার দেব ১৯৮৩ সালের ২১ জুলাই মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার মেহেরুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম করনিক পদে যোগদান করে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর করনিক পদ পরিবর্তন করে ১৯৮৬ সালে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে ২০২১ সালের ২৯ মার্চ অবসরে চলে যান। ৩৭ বছর ৮ মাস ৮ দিন শিক্ষকতা করেন।
শিক্ষা জীবনের স্মরণীয় ঘটনা : নিরঞ্জন কুমার দেব প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে। দূরত্ব ছিল বাড়ি থেকে রাজনগর প্রায় ৫ কি.মি.। ফাঁড়ি পথে পায়ে হেঁটে যেতে হত প্রায় আড়াই কি.মি. রাস্তা। স্কুলে যাওয়ার পথে একটি ছোট নদী ও খালের উপর বাঁশের সাঁকো ছিল। মাঝে মধ্যে খালের পাশে পৌঁছে দেখতেন সাঁকো ভেঙ্গে গেছে। এমতাবস্থায় কোন দিন বাড়ি ফিরে আসতেন। আবার কোন কোন দিন সেখান থেকে ফেরত এসে অনেক জায়গা ঘুরিয়ে স্কুলে যেতেন।
দেশ থাকতে পরদেশি : এছাড়া নিরঞ্জন কুমার দেব এর শিক্ষা জীবনের বড় একটি ঘটনা হল মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ১৯৭১ ইং সনের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। পড়ালেখা করার কথা সে বছর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। নিরঞ্জন কুমার দেবসহ পরিবারের সবাই ভিটা মাটি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। শুরু হলো শরণার্থী জীবনের দুঃসহ জ্বালা। সর্বোপরি, দেশ থাকতেও পরদেশি। দীর্ঘ ৯ মাস শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করার পর আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ দেশে ফেরত আসেন। দেশে প্রত্যাবর্তন করে আবার শিক্ষাজীবন শুরু করে ভাগ্যের সাথে লড়াই করে যেটুকু ভাগ্যের অর্জন।
শিক্ষকতা জীবনের স্মরণীয় ঘটনা : নিরঞ্জন কুমার দেব এর শিক্ষা জীবন শেষ করতে না করতেই প্রবাস যেতে প্রবল ইচ্ছা হয়। প্রথমেই সিঙ্গাপুর যাওয়ার একটি সুযোগ আসে। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেক টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রবাসের চিন্তা বাদ দিয়ে রাজনগর মেহেরুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে করনিক পদে যোগদান করেন। তিনি কাজের প্রতি একনিষ্টতা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং স্টাফদের সকলের ভালাবাসা অর্জন করেন। শিক্ষকতা জীবনে ছোটখাটো অনেক ঘটনাই থাকে তার মধ্যে একটি ঘটনা মনে রাখার মতো। বিদ্যালয়ে প্রথম পর্যায়ে তিনি যোগদানের প্রায় ৪ বৎসরের পরের ঘটনা। ৮ থেকে ১০ জন বৃত্তিধারী ছাত্রীর বৃত্তির টাকা ৪ হাজার ৫শ’ টাকা অনুমান লেপস হয়ে যায়। তখনকার সময়ে বৃত্তির বিলে প্রধান শিক্ষিকার স্বাক্ষর করে থানা নির্বাহী অফিসারের প্রতিস্বাক্ষর করে উপজেলা ট্রেজারী অফিসে জমা দিতে হতো। কানুন ছিলো ১৫ জুনের মধ্যে প্রতিস্বাক্ষরিত বৃত্তি বিল যেভাবে হোক জমা দিতে হবে। নিরঞ্জন কুমার দেব তখনকার সময়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই থানা নির্বাহী অফিসে জমা দেন। অফিস সুপারের গাফিলতির জন্য অফিস কর্মকর্তার প্রতিস্বাক্ষর করাতে না পারায় এবং ট্রেজারী অফিসের অফিস সুপার এই বৃত্তির বিল গ্রহণ করেননি। তাই বৃত্তির টাকা উত্তোলন করা যায়নি। ছাত্রীদের অভিভাবকগণ থানা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ দেন। এই সূত্রের মাধ্যমে নির্বাহী কর্মকর্তা প্রধান শিক্ষিকাকে চিঠি প্রদান করলে প্রধান শিক্ষিকা তাঁকে শোকজ করেন। ভেবেছিলেন চাকুরী বুঝি চলেই যাবে। টাকাও দিতে হবে। কিন্তু সততা ও নিষ্টার সাথে কাজ করলে পরম করুনাময় কাউকে শাস্তি দেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলাম যে তিনির অফিস সুপারের কারনেই সময়মত বৃত্তির টাকা উত্তোলন করা যায় নাই। শেষ পর্যন্ত নিরঞ্জন কুমার দেব নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বাকী কর্মজীবন সম্পন্ন করে স্বসম্মানে অবসর নেন।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনগর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
নিরঞ্জন কুমার দেব একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষকের প্রতিকৃতি। তিনি শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। প্রায় ৩৮ বছর মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে জীবনের পুরো সময় অতিবাহিত করেন। সফল ও কৃতিত্বপূর্ণ মহান এই শিক্ষকের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
ট্যাগস :