মৌলভীবাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ৫ বছর যাবৎ চোখেই দেখেনি শিক্ষার্থীরা, নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সরঞ্জামাধি
- আপডেট সময় ০৩:৪৪:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ অক্টোবর ২০২২
- / ২৯১৫ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধিঃ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা তৈরি ও দেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে প্রাথমিক স্থর থেকে আইসিটি শিক্ষার যুগান্তকারী প্রদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ল্যাবের মাধ্যমে শিক্ষায় তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ তৈরী, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু জেলা-উপজেলা শিক্ষা অফিসার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও প্রশাসনের সঠিক তদারকির অভাবে মৌলভীবাজার জেলায় সরকারের এ মহৎ উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে।
জানা যায়, ২০১৬-২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন ধাপে মৌলভীবাজারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিটি ল্যাবে ১৫/১৭টি ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, স্ক্যানার, প্রিন্টার, চেয়ার, টেবিল সহ প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়। ল্যাবের কক্ষ অত্যাধুনিকভাবে ডেকোরেশনও করা হয়। তবে প্রাইমারী স্তরে ডেস্কটপ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু অযত্নে, অবহেলা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রকল্প ভেস্তে যাচ্ছে।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, তথ্য ও প্রযুক্তি অধিদপ্তর কর্তৃক মৌলভীবাজার জেলায় ১০টি কলেজ, ৩৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা ও ২টি প্রাইমারী বিদ্যালয়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়। মঙ্গলবার শেখ রাসেল দিবস উপলক্ষে জেলায় আরও ৬৬টি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব উদ্বোধন করা হয়েছে।
সরজমিনে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আজাদ বখ্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব তালাবদ্ধ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন আইসিটি শিক্ষক ছুটিতে আছেন। উনাকে চাবি দিয়ে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি। চাবি উনার সাথে। প্রধান শিক্ষক কিংবা দপ্তরীর কাছেও চাবি খোঁজে পাওয়া যায়নি। এদিকে স্কুলের সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থী তওহীদুল ইসলাম দিপু ও শোয়াইবুর রহমান খান নিরব বলেন, বিগত ৫ বছর ওই বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি কিন্তু ল্যাব কি চোখে দেখিনি। শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে হাতে কলমে আমাদের কম্পিউটার কিছুই শিখানো হয়নি। ঐ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ৫ জন শিক্ষার্থী (নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষার্থীদের নাম প্রকাশ করা হয়নি) প্রতিবেদককে বলেন, বেশির ভাগ সময়ই ল্যাব তালাবদ্ধ থাকে। চলতি বছর ল্যাবে ১দিনও ক্লাস করানো হয়নি। তবে আমরা কম্পিউটার দেখেছি। সদর উপজেলা নাদামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাস চলছে। ঐ ল্যাবের কম্পিউটারগুলো নতুন ভবণের উপর তলায় চাঁদর দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। ল্যাবের যন্ত্রগুলো এলোমেলোভাবে রাখা। এই স্কুলে ২০২০ সালের পর ল্যাবের কোন ক্লাস হয়নি বলে জানান, সহকারি শিক্ষক রুনা আক্তার।
তিনি বলেন, “আমি ডিপিএড প্রশিক্ষণে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছি। পরবর্তীতে কি হয়েছে বলতে পারছি না। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আছিয়া বেগম বলেন, আমার বিদ্যালয় বছরের ৫ মাস পানির নিচে থাকতো। যার কারণে বর্ষার মৌসুমে কম্পিউটারগুলো অন্যের বাড়িতে নিয়ে রাখতাম। এখন নতুন ভবণের উপর তলায় ল্যাবটি স্থাপন করা হচ্ছে। আর কম্পিউটার সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। এগুলো আমি কম বুঝি।
এদিকে রাজনগর উপজেলার সোনাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে একাধিক শিক্ষার্থীদের সাথে (নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষার্থীদের নাম প্রকাশ করা হয়নি) কথা হলে তারা বলেন, ল্যাব আছে কিন্তু কোনো দিন ক্লাস করিনি। আমাদের দৈনন্দি ক্লাস রুটিনের মধ্যে ল্যাবের ক্লাসের কোন সময় দেয়া হয়নি। তাই ল্যাবে আমাদের ক্লাস হয়নি। সোনাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইমাম উদ্দিন বলেন, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে ক্লাস করতে যে সকল শিক্ষার্থীরা আগ্রহী তারাই ক্লাস করে। ল্যাবে সকল শিক্ষার্থীদের ক্লাস না হওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করে বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নিয়মীত ক্লাস করা যাচ্ছে না। তবে আমরা আগামীতে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখব।
সোনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে ৫ম শ্রেণীর একাধিক শিক্ষার্থীদের (নিরাপত্তার স্বার্থে শিক্ষার্থীদের নাম প্রকাশ করা হয়নি) সাথে কথা হলে তারা জানান, এযাবৎ তারা একদিনও শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবে ক্লাস করেনি। ল্যাবের ভীতরে গিয়ে দেখা যায় এলোমেলোভাবে সরঞ্জামাদি ফেলে রাখা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান জানান, তাদের অধিকাংশ সরঞ্জামাদি নষ্ট। যার কারণে ল্যাব সচল করতে পারছি না। করোনাকালীন ও বন্যার বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদানে উপস্থিত করাতেও অনেকটা কষ্টা হচ্ছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে জেলার বেশিরভাগ শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের একই হাল।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে এমনটি হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাছাইর ক্ষেত্রেও অনিয়ম করা হয়েছে। তারা বলছেন, সরকারের এই মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হলে তদারকির পাশাপাশি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।
এবিষয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ ফজলুর রহমান বলেন, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের কারণে এমনটি হচ্ছে। তবে এই সংকট নিরসনের জন্য আমরা কাজ করছি। ল্যাব তদারকি করার জন্য টেকনেশিয়ান নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।