মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ অধ্যক্ষের দুর্নীতিতে ভেঙ্গে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা
- আপডেট সময় ০৯:৪৬:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ অগাস্ট ২০২৪
- / ১০০৭ বার পড়া হয়েছে
ষ্টাফ রিপোর্টঃ দুর্নীতির মহা উৎসবে মেতে উঠেছেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর দেবাশীষ দেবনাথ ও তার সিন্ডিকেট। কলেজে যোগদানের পর থেকেই তিনি একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন। অনুগত শিক্ষকদের দিয়ে গড়ে তোলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কলেজের বিভিন্ন খাত থেকে নিয়মিত টাকা উত্তোলন, ভুয়া বিল ভাউচার করে টাকা আত্মসাৎ, প্রশংসা ও প্রত্যয়নপত্রের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায়, সিন্ডিকেটের বাহিরের শিক্ষক ও কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখা, অবসরে যাওয়ার পরেও কোনো প্রকার নিয়োগ ছাড়া নিজের পছন্দের কর্মচারী বহাল রাখা ও ব্যক্তিগত কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার সহ নানা অভিযোগের অন্ত নেই সেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষের এমন দুর্নীতিতে ভেঁঙ্গে পড়েছে জেলার সর্বোচ্চ মহাবিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পরিবেশ। আওয়ামীলীগ পরিচয়ে তিনি এসব অপকর্ম ও দুর্নীতি করেন।
জানা যায়, ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন প্রফেসর দেবাশীষ দেবনাথ। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই নানা ভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন তিনি। শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে নিজের আখের ঘুচাতে ব্যস্থ হয়ে পড়েন অধ্যক্ষ।
এদিকে মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ উপাধ্যক্ষ বরাবর ৯ দফা দাবি সম্বলিত একটি দরখাস্ত দিয়েছেন। দরখাস্তে আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছর ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে বিএসএস, বিএ, বিএসসি ও বিবিএস শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফরের কথা বলে ১ লক্ষ টাকা উত্তোলন করেছেন। অথচ শিক্ষা সফরে যাওয়া হয়নি। বাস গাড়ি মেরামতে বড় অংকের অনিয়ম করেছেন। অভ্যন্তরীন ও বহি: ক্রীড়া প্রতিযোগীতার নামে অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন করে তছরুপ করেছেন। নির্মাণ ও মেরামত খাতেও চরম অনিয়ম করা হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ, বোর্ড ও পাবলিক পরীক্ষায় অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ১০ হাজার সম্মানি পাওয়ার কথা। নিয়ম ভঙ্গ করে অধ্যক্ষ প্রতিটি পরীক্ষা কমিটির কাছ থেকে ৩০/৪০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এরকম একটি বিলের কপি যুগান্তরের হাতে এসেছে। অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় (২০২২) অধ্যক্ষ আহ্বায়ক কমিটির কাছ থেকে সম্মানী নিয়েছেন ২৯ হাজার ৫’শ ১০ টাকা ও উপাধ্যক্ষ ২৬ হাজার ৮’শ ৯৮ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক বলেন, একটি পরীক্ষায় অধ্যক্ষকে আমিও ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু বিল করেছি ১০ হাজার টাকার। অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকার বিল আমার নামে করে উনাকে দিয়েছি। আরও দুটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা একই কথা বলেন। প্রশংসা ও প্রত্যয়নপত্রের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রশিদ বিহীন ১’শ টাকা করে আদায় করা হয়। এ টাকা অধ্যক্ষ ও প্রধান সহকারী ভাগবাটোয়ারা করে নেন। প্রভাবকাটিয়ে অধ্যক্ষ বাবুর্চি রাবিয়া বেগমকে গত ২৫ এপ্রিল অব্যাহতি দেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন মহলের চাপে ৩০ জনু নতুনভাবে নিয়োগ দেন। বাবুর্চি রাবিয়া বেগমের মেয়ে জেসমিন বলেন, আমার আম্মা অসুস্থ্য শরীর নিয়েও স্যারের বাসায় কাজ করেছেন। অব্যাহতি দেয়ার পর আমি, আমার মা ও খালা গিয়ে স্যারের স্ত্রীর পায়ে ধরে ১ঘন্টা কান্নাকাটি করেও আশ্রয় পাইনি।
কলেজের হায়েস গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। পরিবার ও আত্মীয় স্বজনরাও এ গাড়ি ব্যবহার করেন। অথচ শিক্ষার্থীরা চলতি বছর জাতীয় পর্যায়ে জারিগান প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করতে ঢাকায় যেতে চাইলে গাড়ি দেয়া হয়নি। গাড়ি চালক ইমন মিয়া বলেন, মাঝে মধ্যে স্যার বাড়িতে নিয়ে যান। বাস চালক আনকার মিয়া বলেন, এ অর্থ বছরে বাসের প্রায় ১ লক্ষ টাকার মেরামতের কাজ হয়েছে। এর বাহিরে কেউ কিছু করলে আমার জানা নেই।
সদ্য অবসর প্রাপ্ত প্রধান সহকারী কাজী মোহাম্মদ বোরহান উদ্দিন বিগত ২০২৩ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী অবসরে যান। এপ্রিল মাসে প্রধান সহকারী হিসেবে যোগদান করেন শর্বরী দেব। তারপরেও বোরহান উদ্দিন অধ্যবদি প্রশাসনিক ভবনে বসে কাজ করছেন। সূত্র বলছে, অনিয়মের কাগজপত্র প্রস্তুত করে দেয়ার জন্য অধ্যক্ষ বোরহান উদ্দিন’কে নিয়ম বহির্ভুতভাবে রেখেছেন। তিনি অধ্যক্ষকে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরিতে সহযোগীতা করেন। অধ্যক্ষের এ সিন্ডিকেটে রয়েছেন, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো: শরিফুর রহমান, শরীরচর্চা শিক্ষক মোসাম্মৎ নুরুন নাহার, বর্তমান প্রধান সহকারী শর্বরী দেব ও হিসাব সহকারী আবুল বাশার। আবুল বাশার মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অবসরে যাওয়ার পর কলেজে মাষ্টার রোলে চাকুরি করছেন। অথচ রাজস্বভুক্ত, হিসাব সহকারী, ক্যাশিয়ার ও অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক কর্মচারীরা অলস সময় পার করছেন। এদের বসারও জায়গা নেই। রাজস্বভুক্ত চাকুরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরেও ক্যাশ সরকার পদে মো: ফরিদ’কে মাষ্টার রোলে নিয়োগ দেয়া হয়।
রাজস্বভুক্ত একাধিক কর্মচারী বলেন (গোপনীয়তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হয়নি), যোগদানের পর থেকে বসার মতো জায়গা নেই। মূল দায়িত্ব না দিয়ে অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়। অথচ মাষ্টার রোলে অধ্যক্ষের পছন্দের কর্মচারী দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে (প্রতিবেদকের কাছে ভিডিও ও অডিও সংরক্ষিত আছে) একাধিক বিভাগীয় প্রধান বলেন, অডিট ফেস করার জন্য প্রতিটি ব্যবস্থাপনা কমিটি থেকে বাজেটের ২ শতাংশ অধ্যক্ষকে দিতে হয়। সেমিনার থেকে দিতে হয় ১০ হাজার টাকা।
কলেজের একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী বলেন, অধ্যক্ষ বঙ্গবন্ধু কর্ণারের নামে বড় অংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পূজার টাকাও তিনি আত্মসাৎ করেন। আমরা অধ্যক্ষের অপসারণ চাই। উনি যোগদানের পর পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে।
হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো: শরিফুর রহমানের কাছে নির্মাণ ও মেরামত এবং অভ্যন্তরীণ অডিট সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাইলে তিনি তথ্য দেননি। প্রতিবেদকের সাথে অশুভ আচরণ করেন।
অধ্যক্ষ প্রফেসর দেবাশীষ দেবনাথ বলেন, আপনারা এগুলো খোঁজেছেন কেন। কলেজে গাড়ি নেই, ক্লাস রুম সহ নানা সংকট রয়েছে এগুলো নিয়ে লিখেন। এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ বলেন, অডিট আসলে তাদের টাকা দিতে হয়। তা না হলে তারা বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে ঝামেলায় ফেলে। অডিটকারীরা ঢাকায় একটা অংশ পাঠাতে হয়।
কলেজে নিয়ম বহির্ভুতভাবে কর্মচারী রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, নতুনরা কাজ জানে না। এজন্য পুরাতনদের রাখতে হয়। প্রশংসা ও প্রত্যয়নপত্রে টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এগুলো অফিসের কাজে অনেকটা ব্যয় হয়। দ্বিতীয় দিন এসব বিষয়ে আরও তথ্য জানতে চাইলে অধ্যক্ষ প্রতিবেদককে সময় দেননি।