ঢাকা ১২:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জীবন সংগ্রামী একজন শিক্ষকের চালচিত্র

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৬:২৭:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর ২০২২
  • / ২৪৭৫ বার পড়া হয়েছে
ফয়সল আহমদ রুহেল : মামুনুর রশীদ। ছিলেন সরকারী কলেজের প্রফেসর ও সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। এক সময়ে লেখালেখি করতেন। লেখক নাম ছিল মামুন ইব্রাহিমী। কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। এখনো মামুনুর রশীদ শিক্ষকতার পাশাপাশি কবিতার লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। এটাই তাঁর শেষ কর্মস্থল। এই গুণী শিক্ষক মামুনুর রশীদ সফলতার সঙ্গে সরকারি চাকরিকাল শেষ করে অবসরে যান ২০১০ এ। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মামুনুর রশীদের এই দীর্ঘ চাকরি জীবনে সফলতা তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি।
জন্ম : তিনি ১৯৫৩ সালের ১৯ জুলাই মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার তেলিজুরী (মৌলভীবাড়ী) গ্রামের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম বজলুর রহমান, মাতা বিলকিছ বেগম (মরহুমা)। মামুনুর রশীদ এর পিতা মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার খলাগ্রাম করিমপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তাঁরা ভাইবোন ৫ জন। এর মধ্যে দুই ভাই শিক্ষক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত এবং একজন কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি সবার বড়।
পারিবারিক জীবন : গুণী এই মানুষটি কর্মক্ষেত্রে যেমন সফল, তেমনি পরিবার প্রধান হিসেবেও নিজ সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং দীক্ষিত করে গড়ে তুলেন। প্রফেসর মামুনুর রশীদ এক ছেলে ও এক মেয়ের  জনক। মেয়ে বড়- ইংরেজীতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে মেয়ে ঢাকায় থাকেন এবং বিবাহিত। ছেলে সিলেটের লিডিং ইউনির্ভাসিটি থেকে বিবিএ শেষ করেন। বর্তমানে ঢাকার ‘হাওলাদার এন্ড ইউনুস’ সিএ ফার্মে সিএ অধ্যয়নরত। বর্তমানে তিনি মৌলভীবাজার মিশন রোড এলাকায় বসবাস করছেন।
শিক্ষা জীবন : শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদ কর্মবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। তাঁর জীবন ছিল নানা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। তিনি তেলিজুরি প্রাইমারী স্কুল ও খলাগ্রাম প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন আনুমানিক ১৯৬০-১৯৬৫ ইং সনে। এরপর খলাগ্রাম করিমপুর হাইস্কুলে নবম শ্রেণী ও রাজনগর পোর্টিয়াস হাইস্কুল থেকে দশম শ্রেণী অধ্যয়ন করে ওই স্কুল থেকে ১৯৭০ সালে (পাকিস্তানের শেষ ব্যাচ)। কুমিল্লা বোর্ডের এসএসসি পরীায় মানবিক বিভাগে ১ম বিভাগ অর্জন করেন। তারপর ১৯৭২ সালে এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (তৎকালীন) থেকে আইএ পাশ করেন। মাত্র ৩ নম্বরের জন্য ১ম বিভাগ পাননি। তিনি ১৯৭৩ সালে এম.সি কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন। ওই কলেজ থেকে সম্ভবত: ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় ২য় শ্রেণীতে ৪র্থ স্থান পান। সে বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন প্রথম শ্রেণী ছিল না। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে এম এ সম্পন্ন করে বের হন। এর আগে অনার্স পরীক্ষা দেবার পর রাজনগর পোর্টিয়াস হাইস্কুলে ৩ মাস শিক্ষকতা করেন।

কর্মজীবন : মামুনুর রশীদের বাবা ছিলেন শিক্ষক। তিনি সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন আদর্শের কারণে। গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। আজীবন মগ্ন ছিলেন জ্ঞানের সাধনায়। তিনি পিতার সেই পথ অনুসরণ করে পড়ালেখার জীবন শেষ করে যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশায়। মামুনুর রশীদ ১৯৮০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী জেলার কবিরহাট ডিগ্রি কলেজে বাংলার লেকচারার হিসেবে প্রথম কলেজ শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখান থেকে ১৯৮১ সালে কলেজ পরিবর্তন করে একই জেলার চাটখিল কলেজে চলে আসেন এবং ওখান থেকে সরকারি চাকুরিতে প্রবেশ করেন। তারপর একটানা প্রায় তিরিশ বছর বিভিন্ন সরকারী কলেজে চাকুরি করে সর্বশেষ ২০১০ সালের জুলাই মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রফেসর হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। গুণী এই মানুষটি বর্তমানে ২০১১ সাল থেকে মৌলভীবাজার ইম্পিরিয়েল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন। টুকটাক বাদ দিলে এই গুণী শিক্ষকের দীর্ঘ প্রায় বিয়াল্লিশ বছর শিক্ষকতা চলছে। এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে জ্ঞানের বাতিঘর হয়ে তিনি নিজেও হয়ে উঠেছিলেন আলোকিত স্বজন।
শিক্ষক থেকে লেখক : মামুনুর রশীদ এক সময়ে লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখা সিলেটের সাপ্তাহিক ‘যুগভেরী’, সাপ্তাহিক ‘সুর’ ইত্যাদি পত্রিকায় কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। মামুনুর রশীদ এর লেখক নাম ছিল মামুন ইব্রাহিমী। এই নামে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার মাধ্যমে একজন কবি তার মনের অনুভূতি সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। পাঠকরা সেই কবিতা পড়ে কবির অনুভূতিকে ধারন করেন। কবিতা মানুষের মনের অনুভূতিকে জাগ্রত করে। মামুনুর রশীদ শিক্ষকতার পাশাপাশি কবিতার লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সেটা প্রশংসার দাবিদার। ২০১৩ সালে ‘এই দাবদাহে, এ অরণ্যে’ নামে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মলাটবদ্ধ হবার অপেক্ষায় রয়েছে ‘দ্বিকালদর্শীর ডায়রি’ একটি আত্মজৈবনিক ভাষ্য।
শিক্ষক শিক্ষার মেরুদন্ড : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মামুনুর রশীদ শিক্ষার দুরবস্থা নিয়ে হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। আমার ধারণা এটি একটি আলংকারিক বাক্য। ওই পর্যন্তই। শুনতে ভালো লাগে। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড-এটা সর্বত্র প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষক শিক্ষার মেরুদন্ড-এ কথাটি ঘুনাক্ষরেও কোথাও উচ্চারিত হয় না। এর জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর প্রয়োজন। একটা আন্দোলন করার দরকার। শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষ যে হচ্ছে না-এটা স্পষ্ট। কিন্তু শিক্ষার পরিমাণগত উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষক সমাজেরও উন্নতি যে প্রয়োজন সেটা বলাবাহুল্য। না হলে লর্ড মেকেলের শিক্ষানীতির মতো আমগাছে আমড়াই ফলতে থাকবে।”
অদৃশ্য নিয়তির অদৃশ্য প্রভাব : মামুনুর রশীদের প্রথম জীবনে শিক্ষকতা পেশা পছন্দের ছিল না। তিনি আমলা হতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু সেটা হতে পারেননি। ঢুকেছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। সেই পঞ্চাশ বছর আগের কথা মামুনুর রশীদ স্মৃতি চারন করেন। বলেন, “তখন তিনি রাজনগর পোর্টিয়াস হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়তেন। ক্লাসের সেকেন্ড বয় হিসেবে বসার স্থান প্রথম বেঞ্চে। ক্লাশ নিচ্ছিলেন হেডমাষ্টার স্যার। তিনি ইংরেজি পড়ান। কথায় কথায় জানালেন, স্কুলে মহকুমা শিক্ষা অফিসার এসেছেন, একটু পরেই তোমাদের ক্লাসে আসবেন, তোমরা প্রস্তুত থেকো। তিনি আসলেন এবং প্রথম বেঞ্চের ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, জীবনে কে কি হবে। আমাকে এই প্রশ্নটা করতেই, বোকার মতো না বুঝেই উত্তর দিলাম,“আমি একজন প্রফেসর হবো” প্রফেসর নামক পেশাটা যে কী, আমি নিজেই জানতাম না। অদৃশ্য নিয়তির অদৃশ্য প্রভাবে পরবর্তীকালে আমি তাই হয়েছিলাম। অর্থাৎ একজন শিক্ষক। প্রথম জীবনে শিক্ষকতা আমার পছন্দের পেশা ছিলো না। যদিও আমার আব্বা হাইস্কুলে সমাজ বিজ্ঞান ও ইসলাম ধর্মের শিক্ষক ছিলেন। আমলা হতে চেয়ে ছিলাম, কিন্তু অনিবার্য এক কারণে সেটাও হলো না।

বিদ্যাজীবি’ কিংবা ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দ দুটোর সম্পর্ক : মানবিক মূল্যবোধ মানুষের মানবিক আচরণ, ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করাকে বুঝায়। কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়ার শিল্প ব্যবসা-বাণিজ্য ভোগবাদী মানসিকতায় মানুষের বিদ্যা বুদ্ধি, মেধা-প্রজ্ঞা ও মানবিক মূল্যবোধে ছেদ পড়েছে। শিক্ষক সমাজের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে মামুনুর রশীদ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
প্রথমত, শিক্ষক শব্দটি শুনলেই উনিশ শতকী একটি ধারণা মনে বাসা বাঁধে। এবং সেটা কি? নিরীহ, ভদ্র, বিনয়ী আদর্শবাদী ও প্রায় নির্বিবাদী একজন মানুষ, যিনি বা যারা অল্পে তুষ্ট, যার জীবন সহজ সরল, যাদের অধিকাংশেরই জীবন চিন্তা ও মননশীলতায় সমৃদ্ধ। কিন্তু একালে শিক্ষক সম্পর্কে উল্লিখিত ধারনাগুলো আর নেই। এই না থাকার মূল কারণটাই হলো, সমকালীন সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন। পবির্তনের অন্তরালবর্তী কারনসমুহের আরো সংলগ্ন হলে এটা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে সমাজকে পরিবর্তনের স্রোতধারায় যখন গোটা সমাজটাই পাড়ভাঙ্গা নদীর স্রোতের মত ছুটে চলেছে লক্ষ্যহীনভাবে, তখন সমাজেরই একটি অংশ হিসেবে, শিক্ষক সমাজও ভেসে চলেছেন অসহায়ভাবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষক কিংবা শিক্ষকতা শব্দটির সাথে ‘বিদ্যাজীবি’ কিংবা ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দ দুটোর আত্মিক সম্পর্ক আছে, যদিও প্রত্যেক শিক্ষক বিদ্যাজীবি হলেও সবাই ‘বুদ্ধিজীবি’ নন। অবশ্য এটা প্রচলিত অর্থে। যদিও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবি কোষ’ গ্রন্থে ষোলটি পেশাজীবি সম্প্রদায়কে বুদ্ধিজীবি বলা হয়েছে। কিন্তু অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘বুদ্ধিজীবি’, বিশেষ করে নিকটতম সম্পর্কযুক্ত ‘আঁতেল’। শব্দটি কিঞ্চিত ব্যাঙ্গার্থেই প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেমন, ‘আঁতলামি’ পরিহার করুন। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম ঐতিহাসিক- দার্শনিক আর্নল্ড টয়েনবি একটুখানি ব্যঙ্গ করে তাঁর দেশের বিদ্যাজীবিও বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়কে ‘ইন্টারন্যাল প্রলেটারিয়েট’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। (স্টাডি অব হিষ্ট্রি)। টয়েনবির কাল অতিক্রম করে আমরা আজকে একুশ শতকের তৃতীয় দশকে এবং এটা আজকে সমুহ দুর্ভাবনার বিষয় যে কর্পোরেট দুনিয়ার কথিত নতুন বিশ্বব্যবস্থার বেনাজলে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে মানুষের তাবৎ বিদ্যা বুদ্ধি, মেধা- প্রজ্ঞা, রূপযৌবনসহ যাবতীয় শারীরবৃত্তিয় অনুসঙ্গ ও মানবিক মূল্যবোধসমুহ। মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে উল্লিখিত কথাগুলো এ কারণে বললাম যে, সত্তর দশকের একবারে শেষের দিকে আমি যখন শিক্ষকতায় ঢুকলাম, তার বহু আগেই ব্যক্তিতে, সমাজে ও রাষ্ট্রে ভাঙনের নেতিবাচক সুর বাজতে শুরু করেছে। নাট্যকার মামুনুর রশীদের ‘সুবচন নির্বাসনের মতো নাটকগুলো সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে।”
কলেজ জীবনের বহমান সময় সম্পর্কে প্রকাশিতব্য ‘দ্বিকালদর্শীর ডাইরি’ গ্রন্থে তিনি বয়ান করেন। “মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ এক অনিবার্য পরিবর্তনের মুখোমুখি। চারদিকে অভাব অনটন হাহাকার, সামজিক নৈরাজ্য কিংবা তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা এর মধ্যেই চলেছে আমার কলেজ পড়ার জীবন।” ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন “আমার আব্বা ছিলেন স্থানীয় খলাগ্রাম হাইস্কুলের শিক্ষক, গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজে ইমামতি করতেন, গ্রামের মানুষের কাছে প্রায় অজাতশত্রু। জমি জিরেত যা ছিল, তা থেকে উৎপন্ন ধান দিয়ে ছয় সাত জনের একটি পরিবারের টেনেটুনে বাৎসরিক অন্ন সংস্থান হতো। আমরা পাঁচ ভাইবোনের তিন ভাই-ই কলেজ পড়ুয়া আমি এমসি কলেজে বাংলা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পরীক্ষার্থী, দুই নম্বর ভাই মৌলভীবাজার কলেজে বি কম ফাইনাল ইয়ারে, সেও পরীক্ষার্থী এবং তিন নম্বর ভাই এসএসসি পরীক্ষা দেবে রাজনগর হাইস্কুল থেকে। তিনজনই যথাক্রমে মানবিক বিভাগ, বাণিজ্যবিভাগ ও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তিনজনই এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়েছি। এই দুঃসহ অভাবের মধ্যে আমি একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম তৎকালীন সিলেট ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। বর্তমানে সিলেট সরকারি কলেজ। সিলেট উচ্চমাধ্যমিক কলেজে পড়াকালীন সময়ে দিনের বেলা কেটে যেত ক্লাশ করে আর কলেজ ক্যান্টিনে অকারণে আড্ডা দিয়ে। কফি হাউসের সেই আড্ডাটা এখন আর নেই বটে; কিন্তু অন্তরঙ্গ সহপাঠি বন্ধুবান্ধবদের এবং প্রিয় স্যারদের কথা এখনো স্মৃতিতে অম্লান। খছরু, লকিত (দুজনেই কানাডায়), ফরাসত আলী, আমার পাশের গ্রামের, নিউইয়র্ক ইনস্টিটিউট অব টেকনালেজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বহুকাল আমেরিকায় থেকে সম্প্রতি দেশে আছে। এন আর বি সি ব্যাংকের চেয়ারম্যন ছিল এক সময়। মাঝে মধ্যে তাঁর সাথে যোগাযোগ হয়। সিতেশ প্রশাসন ক্যাডারে, উপসচিব থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরন করেছে। সর্বশেষ, ইন্টারমিডিয়েটের আরেকজন ক্লাশমেটের কথা না বললে ই নয়; এবং সে হচ্ছে, কুলাউড়ার আজম জাহাঙ্গীর চৌধুরী। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি। সম্ভবত ২০০৭ এ সে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ সেলিমের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় চাঁদাবাজির মোকদ্দমা করেছিল। বাহাত্তরের এক সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে একসাথে চা খেয়েছিলাম। এদের সংস্পর্শে আমি উদ্দীপিত হয়েছিলাম। সন ১৯৭১ সে সময়ে সমাজে লজিং কালচার প্রচলিত ছিল। আমিও আমার এক নানা জনাব মনোহর আলী বেগ সাহেবের বদান্যতায় তাঁর টিলাগড়ের বাসায় (এমসি কলেজের গেইটের সামনে) লজিং এ থাকি। লজিং এ থাকা মানে সুখে দুঃখে থাকা। ১৯৭৪ এ আমি যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখন নবীন বাংলাদেশ মন্বন্তরের মুখোমুখি, বাড়ি থেকে আব্বা মাসে দু একখানা পত্র লেখেন, সেই পত্র মারফত আকারে ইঙ্গিতে বুঝতে পারি, বাড়িতে খুব অভাব অনটন চলছে। জানতে পারি যে, সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ ও আমাদের ভাইদের স্কুল কলেজের বেতনাদি ও পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকা পরিশোধের জন্য আব্বা হাওরের বেশ কিছু জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন। বাড়ির জন্য মনটা আইটাই করছে, কিন্তু একদিকে ক্লাশ চলছে এবং আমার হাতে বাড়ি যাওয়ার মত কোন টাকা পয়সা নেই বলে, খুব কষ্ট হলেও, সে পরিকল্পনা আপাতত বাদ দিলাম। অবশ্য একটা টিউশনি খুঁজছিলাম, কিন্তু দেশের এই অর্থনেতিক দুর্দিনে প্রাইভেট পড়ানোর মতো কাউকে পাওয়া গেলো না। বারবার আমার আম্মার চিন্তাকিষ্ট মুখ ও আব্বার চেপে রাখা দুঃখভারাক্রান্ত চেহারা চোখে ভেসে উঠছিল। ক্লাশ ও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু নিজেকে চালিয়ে নেবার মত কোন ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। বলে নিজের কাছে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। একটা প্যান্ট, একটা পায়জামা ও একটা শার্ট ও একটা পাঞ্জাবি আমার কলেজ ড্রেস। প্যান্টটা নিচের দিকে অনেকখানি ছিড়ে গিয়েছে বলে ওটাকে দর্জির কাছে নিয়ে নিচের দিকটা কাপড় জোড়া লাগিয়ে “ইলেফ্যান্ট বটম” নামক, তখনকার দিনে তরুণ সমাজের কাছে প্রিয় একধরনের প্যান্টে রুপান্তরিত করেছিলাম। হাঁটুর উপরের দিকে অপেক্ষাকৃত সরু এবং হাঁটুর নিচের দিকে অস্বাভাবিক প্রসারিত প্যান্ট গুলোকে “ইলেফেন্ট বটম” স্টাইল বলে। এতে করে আমি নুতন একটা প্যান্ট বানানোর খরচ বাঁচিয়েছিলাম। গত চিঠিতে আম্মা জানিয়েছেন যে আমার আট বছরের ছোট বোন দিলওয়ারা বায়না ধরেছে যে আমি সিলেট থেকে বাড়ি যাওয়ার সময়, তার জন্য যেন একগাছি গলার হার নিই। এবার সিলেট আসার সময় আমার গলা জড়িয়ে আমাকে একটা চুমু দিয়েছিল। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম ও বেড়ে-ওঠা ও অভাব অনটনের মাঝে এই পারিবারিক স্নেহের বন্ধন দুরে গেলে ও আরো বেশি জমাট হয়ে উঠে। দিনের বেলা ক্যাম্পাসে ও ক্লাশে সহপাঠিদের সাথে পড়াশুনা ও আড্ডায় দুঃসময়টা কেটে যেতো বটে; বিকালে ও সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে হাঁটাহাটি করে মাগরিবের নামাজ টিলাগড় মসজিদে আদায় করে, নিয়মিত পড়াশুনা করতে বসতাম বটে, কিন্তু রাতে ঘুমানোর আগে বৈশাখী কালো মেঘের মত একদলা চিন্তা মাথার মধ্যে বাসা বেঁধে বসতো। আমার কেবলই মনে হতো, আমার বোধ হয় আর পড়াশুনা করা হবে না। আমি খুব চাপা স্বভাবের মানুষ বলে, এগুলো বাইরে প্রকাশ করতাম না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমাকে ওভাবেই পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে। অতএব, আলস্যকে এড়িয়ে আমি রাতে, বিশেষ করে রাত জেগে পড়াশুনা করতাম। দেশের যে অবস্থা, চারপাশে কেমন যেন একটা অস্থির অস্থির পরিবেশ। গতরাতে এমসি কলেজের হোষ্টেলের দিকে পুলিশ ও জাসদ গণবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। কদিন ধরে থেমে থেমে নানা জায়গায় ওরকম হচ্ছে। আগামী কালকের একটি টিউটোরিয়েল রেডি করতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গেলো। রাত দুটা আড়াইটার দিকে বিছানায় যেতেই কখন যে ঘুম লাগল, টেরই পাইনি। একবারে ভোর রাতের দিকে চাচির (এটা চাচির আব্বার বাসা) ডাকে ঘুম যখন ভাঙলো, তখন দেখি, আমাদের চৌধুরী বাড়ির ডাক্তার চাচা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কি বিষয়? আমাকে জানানো হল, আমার নানা ইন্তেকাল করেছেন, আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে। অগত্যা একটি বেগে কাপড়চোপড় ও দিলওয়ারার গলার হার ভরে সকালের ট্রেনে, বরমচাল, সেখান থেকে করিমপুর চা বাগান দিয়ে, মুন্সিবাজার হয়ে, যখন সকাল এগারোটার দিকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলাম, তখন বিস্ময়ের সাথে দেখলাম আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে, জানাজা শেষে কবরে নামানো হচ্ছে আমার নানাকে নয়, আমার অত্যন্ত আদরের ছোটবোন দিলওয়ারাকে। সিলেটে আমার কাছে সেটা লুকানো হয়েছিল। সে ছিল আমাদের ভাইদের সবার ছোট এবং সবার আদরের। দোহারা গড়নের, হাসলেই গালে টোল পড়তো। প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত আঘাত জীবনে এই প্রথম পেলাম। বস্তুত, এই মৃত্যুটি জীবন সম্পর্কে আমার মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও নৈরাশ্যের সৃষ্টি করলো। এরপর থেকেই শুধু আম্মার কাছে কাছে থাকতাম। পড়াশুনা করার ইচ্ছা একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের কল্পনাতীত ঘটনাকে সামাল দিয়ে এবং বুকটাকে পাষান বানিয়ে আব্বা আম্মার প্রচন্ড চাপে আবার পড়ালেখার জন্য চলে আসতে হল সিলেটে। আসলেও কি হবে? হঠাৎ প্রয়াত বোনটির কথা মনে পড়ে যেতো। প্রতিদিন ঘুমাবার আগে, কখনোবা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, কোথাও একা বসে থাকলে, তার কথা মনে পড়লেই চুপি চুপি চোখটা নিজের অজান্তেই ভিজে আসতো। কিন্তু সত্যিকার অর্থে, দুর্ভিক্ষপীড়িত সে সময়ে, নিরন্তর অভাব অনটনকে গায়ে মেখে প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত একটা বেদনাকে অষ্টপ্রহর বহন করা ও সম্ভব ছিল না। সে বেদনা একদিন ক্রমশ হালকা হল। জীবনের ধর্ম তাই। জীবন হচ্ছে ব্যারিকেড পার হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আল্লাহর উপর নির্ভর করে অনবরত চেষ্টা করে যাওয়া। কিছুদিন পর এই লজিংটা পরিবর্তন করে পুতুল খালার বাসায় লজিং নিলাম। আমার জীবনে বড় হতে তাঁদের সহৃদ্য অবদানকে আমি গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহ তাঁদের মঙ্গল করুন। তাঁদের স্নেহ-মমতা ছাড়া আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল জীবনের এই পর্যায়ে আসা। তাঁদের অনেকেই এখন পৃথিবীতে নেই, তাঁদের পারলৌকিক জীবনের সর্বোত্তম মঙ্গল কামনা করি। এ রকম হাসি কান্না
দিনগুলো যাচ্ছিল; গতানুগতিক, রক্তবর্ণহীনও পানসে। না প্রেম, না বিপ্লব। এরই মধ্যে কয়েকদিন বাড়িতে থেকে আবার সিলেটে চলে এসেছি। শহরে অভাব অনটন অতোটা টের পাওয়া যায় না, কিন্তু গ্রামে আসলেই চারপাশের মানুষের চলমান জীবনযাপনে অভাবটা বড় বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠে। বাড়ি গিয়ে দেখলাম, আমাদের খুব প্রিয় একটি কালোজামের পুরোনো বড় গাছ আব্বা চল্লিশ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। গ্রামের মানুষের মধ্যে জমি জমা, গরুছাগল ও ঘটিবাটি বিক্রির হিড়িক পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় চৌধুরী বাজারে একটি লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে; প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে অভাবী মানুষকে খাওয়ানো হয়। সেবার বাড়ি থেকে সিলেট আসার কালে আব্বা কেন যেন জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ফাইনাল পরীক্ষার দেরি কেমন? প্রশ্নটা পাথর চাপা দিয়ে আবারো চলে আসতে হলো সিলেটে। এটা আমার প্রায়ই হতো, সিলেট থেকে বাড়ি যেতে অনেকগুলি তারিখ পেছাতাম, আবার বাড়ি থেকে সিলেট যেতে হলেও সে রকম, অনেকগুলো তারিখ বদলাতে হতো। কারণটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্লাশগুলো বাদ যেতো। অনেকগুলো এ্যাসাইনমেন্ট (তখন এটাকে আমরা বলতাম, টিউটোরিয়েল) জমে যেতো। এগুলো আবার কষ্ট করে রেডি করে স্যারদের কাছে জমা দিতে হত। এখানে একটা কথা বলা উচিত এবং সেটা হচ্ছে যে পড়াশুনার কষ্টের মধ্যে ও মনের মাঝে একটা ফুরফুরে আনন্দ সবসময় থাকতো। জানি না, এটার কারণ কি, সে সময়টার এই উৎসবিহীন আনন্দের মনস্তাত্বিক কোন ব্যাখ্যাও আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আমি নিশ্চিত যে, অবাঙমানসগোচর সেই বিমূর্ত আনন্দবোধ গাড়ির পিষ্টনের মত আমাকে বারবার সামনের দিকে এগিয়ে নিত। আমার দুঃখকষ্টগুলোকে। হালকা করে দিত।

পারিবারিক ইতিহাসের একটি অধ্যায় সমাপ্ত : কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গুনী এই শিক্ষক বলেন, খুব সম্ভব ১৯৭৬ সাল, আমার অনার্স পরীক্ষার আর মাত্র তিন মাসের মত বাকি। অনার্স ফাইনালের ফরম ফিলআপ শেষ। এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে ফরম ফিল আপ করেছি। আটঘাট বেঁধে পড়াশুনায় লেগেছি। হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে পত্র পেলাম, আব্বা স্ট্রোক করেছে। এক সাইড অবশ, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলেন। হায় আল্লাহ! মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পড়াশুনা, বইপত্র রেখে পাগলের মত ছুটলাম বাড়িতে। গিয়ে দেখি, আব্বা বিছানায় শুয়ে, ডান দিকটি অবশ, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা যা বলছেন, তার অধিকাংশই বোঝা যাচ্ছে না। তখন আমার মাথায়, একমাত্র চিন্তা, কিভাবে আব্বার চিকিৎসা চালানো যায়। বিশ শতকের সত্তর দশকের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল, ধারে কাছে ডাক্তারই নেই, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মেলার তো প্রশ্নই ওঠেনা। যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ, সময়টা বর্ষাকাল। তার উপর টাকা পয়সার অভাব তো আছেই। পাশে ইটা চা বাগানের ডাক্তার নরেন বাবু চিকিৎসা করছেন, কিন্তু অসুখটা মূলত নিউরন ঘটিত, কিন্তু নিউরোলজির ডাক্তার কোথায়? অতএব, সে রকম চিকিৎসা হচ্ছে না, রোগ বাড়ছেই। অগত্যা, নৌকায় করে, কাওয়াদীঘি হাওর হয়ে, মৌলভীবাজারে এসে ড. সৈয়দ হককে দেখানো হল। তিনিও আমারে কোন খবর দিতে পারলেন না। উপায়ান্তর না দেখে যথারীতি বাড়ি ফেরা। অসুখ আরো একটু বাড়তেই কারো কারো পরামর্শে ওঝাও আনানো হল। কিন্তু আল ভেঙ্গে জমিতে পানি ঢুকে গেছে, অতএব, সেভাবেই দেড়মাস বিছানায় থাকার পর, অনেক কষ্টে, অনেক না-বলা কথাকে বুকে চেপে, স্ত্রী-পুত্র কন্যা ও অন্যান্যদের সম্মিলিত কালিমা শাহাদৎ উচ্চারণের মধ্যদিয়ে আমার আব্বা পঁচিশে রমজানের ঠিক ইফতারের সময় ইন্তেকাল করলেন আর কাটা কই মাছের মত আমরা ক’জন ভর সন্ধ্যায় মাটিতে গড়াগড়ি করলাম। আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল।

জীবন পথের অব্যর্থ পাথেয় : বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার অনার্স পরীার তখন দেড়মাস বাকি। বর্ষার রাতের জলে দলাপাকানো একদল পিপড়ার মত আমাদের পরিবারটি তখন ভেসে চলেছে কোন এক নিরুদ্দেশ যাত্রায়। আল্লাহ ভরসা। কিন্তু জীবনকে তো সামনে দিকে চালিয়ে নিতে হবে। আব্বার মৃত্যুর দশ পনরো দিন পর্যন্ত তড়িতাহতের মত ট্রমাগ্রস্ত হয়ে পড়ে রইলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, আর পড়াশুনা করবো না এবং পরীক্ষা ও দেবোনা। শেষ পর্যন্ত আমার ও অন্যান্য আত্মীয়দের প্রচন্ড চাপে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। পিতৃবিয়োগের অনিবার্য ধকলে পরীক্ষার আগের দিনগুলাতে একেবারেই পড়াশুনা হয়নি। অতএব, পরীক্ষা দিলাম বটে, কিন্তু সেটা অনেক আগের প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে, আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না প্রায় তিন মাস পর যখন আমার অনার্স পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারলাম যে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স পরীক্ষা দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ হযেছি, সে সময় আমি আমার এক চাচাতো ভাই আকিকের জানাজার নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অবশ্য সে বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স পরীক্ষা কোন ফাস্টক্লাশ আসেনি। আমি তো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে পড়াশুনা আর করবো না, কিন্তু ফলাফল একটু ভালো হওয়াতে আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে ডেকে ডেকে শান্তনা দেয় আর বলে,“তোমার রেজাল্ট টা ভালো হয়েছে, আরো একটু কষ্ট করে এমএ টা শেষ করে নাও”। কিন্তু কিভাবে? দেশ বিদেশের সহৃদয় আত্মীয়স্বজনের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় ও আমার আম্মার তাগিদে আবার জীবন যুদ্ধে কোমর বাঁধলাম। এবার যেতে হবে সুদুর চট্টগ্রামে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, এফ রহমান হলে সিট পাওয়া, অচেনা চট্টগ্রামে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, কটারকোনার দেলওয়ার মামার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠা, তার রুমের বোর্ডার হওয়া, ইত্যাদি কাজগুলো যে কিভাবে হয়েছিল, আজ পয়তাল্লিশ বছরপরে মনে করলে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। কে এই প্রায় অসাধ্য কাজগুলো আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে, সেটার যুক্তিগ্রাহ্য কোন ব্যাখ্যা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এগুলোর প্রত্যেকটিই যে আমার জীবন পথে সামনে চলার একেকটি অব্যর্থ পাথেয় ছিল, তখন না বুঝলে ও পরিণত বয়সে এসে, ঘটনাগুলোকে উল্টেপাল্টে বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে, যে আমার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য, এগুলো ঘটার প্রয়োজন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব, কিভাবে ভর্তি হব, কারো সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করবো, এমন কেউ ছিল না। আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার দেনা করে আপাততঃ টাকা পয়সার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল বটে; কিন্তু পরামর্শ দেবার মত কোন মানুষ পাইনি। (দ্বিকাল-দর্শীর ডাইরি)
যদি লক্ষ্য থাকে অটুট : জীবনে লক্ষ্য অটুট থাকলে যে কেউ সফল হবে। লক্ষ্য ঠিক করো জীবনে কী হতে চাও। স্বপ্ন দেখো নিজেকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও। তাহলে ওই জায়গায় অবশ্যই পোঁছাতে পারবে। মামুনুর রশীদ লক্ষ্য অটুট রেখে ঠিক সেই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক চিত্র তিনি তুলে ধরেন।এক বুধবারে স্থানীয় মুন্সিবাজারে গিয়েছি; সন্ধ্যার কিছু আগে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বাজার থেকে বের হচ্ছি, দেখি শ্যামলা রঙের একজন তরুণ অন্যদিকে তাকাতে তাকাতে হন হন করে ছুটে এসে আমার সাথে ধাক্কাই খেয়ে বসলেন। আমার হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গিয়ে বাজারে একটা সিনক্রিয়েট হয়ে গেল। ব্যাগ থেকে খরচাপাতি পড়ে গিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। ওই তরুণ নিজেই লজ্জা পেয়ে মাটিতে ছড়ানো ছিটানো খরচাপাতি তুলতে শুরু করলেন। এবার তার মুখের দিকে তাকাবার সুযোগ পেলাম। বড় বড় দুটি চোখ, ক্লিন সেভ, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল, হাতে একটি ইদ্রিস মার্কা ছাতা, কথা বলার সময় কারনে অকারনেই ঘনঘন হিস্ হিস্ শব্দ করা- সবমিলিয়ে তাকে আমার কাছে খুব আপন বলেই মনে হল। তিনিও আমাকে বিস্মিত করে পাশের সোনাচান্দের মিষ্টির দোকানে টেনে নিয়ে গেলেন। অতঃপর চা-মিষ্টি খেতে খেতে দুজনের আরো পরিচয় ও ঘনিষ্টতা। আলাপে আলাপে জানা গেল, তার বাড়ি মৌলভীবাজারের কটারকোনা; এখানে এক আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে আসা। আমিও জানালাম, আমি এমসি কলেজের ছাত্র, অনার্সে মোটামুটি একটা ভালো রেজাল্ট হয়েছে; এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা এমএ ফাইনাল ইয়ারে ভর্তি হব। তিনিও জানালেন, তিনিও একই বিশবিদ্যালয়ে বাংলা এমএ ফাইনাল ইয়ার এ পড়েন। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। এফ রহমান হলের ৩১৭ নম্বর রুমে থাকেন। পরীক্ষা পরেই রুম ছেড়ে দেবেন; আমি ইচ্ছে হলে সুযোগটা নিতে পারি। তিনি সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। আজকে তো বুধবার, আগামী বুধবারে তিনি চিটাগাং যাবেন। ব্যস, কথা পাকা হয়েই গেল; আমি তাঁর সাথে চিটাগাং যাব। আমি যেন আগেরদিন লাক্কাতুরা চা বাগানে তাঁদের বাসায় চলে যাই; কারন, তাঁর আব্বা সে বাগানে চাকরি করেন এবং তারা সপরিবারে সেখানেই থাকেন। ঘনিষ্টতার বন্ধন আরো পাকা হল, যখন তিনি জানলেন যে, শাবন্দর ছিরাইনগরের আমার ফুফুতো ভাইয়েরা কি সম্পর্কে তার মামা হন, অতএব, আমিও সে দিনই মামাতে রূপান্তরিত হলাম। আমি শুধু শুধু অবাক হচ্ছি; এ যেন না চাইতেই জলভরা মেঘ। আপাততঃ ওখানেই বিদায়; আল্লাহ হাফেজ, দেলওয়ার মামা। তিনিও একটা রমনা সিগারেট ধরিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। তার সিগারেট টানার স্টাইলটাও আমার মনে ধরলো। দু আংগুলের এক্কেবারে অগ্রভাগে জলন্ত সিগারেটটির একবারে বটমলাইনে দুই ঠোঁট লাগিয়ে জোরে টান দিয়ে নাকমুখ দিয়ে দলা দলা রমণীমোহন ধুম্র উদগীরণ। তখনকারকালে মেয়েরা ধুমপায়ী পুরুষদের নাকি খুব পছন্দ করতো। বাড়িতে এসে আম্মাকে সব খুলে বলতেই, তিনি চট্টগ্রাম যেতে সায় দিলেন কিনা বুঝা গেলোনা। আচ্ছা দেখা যাক বলে প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে রাখলেন এবং পরের দিন সকাল বেলা বললেন,“আচ্ছা যাও, আল্লাহ ভরসা” তারপর খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানতে চাইলেন। আমি কোনটার উত্তর দিলাম, আবার কোনটার উত্তর দিতে পারলাম না। আমি তাঁর প্রথম সন্তান, মায়ের মন; দুরে পাঠানোর আগে হাজারো ভাবনায় মন উদ্বেলিত হবারই কথা। সারারাত হয়তো আকাশপাতাল ভেবেছেন। মামাদের কাছ থেকে টাকা চেয়ে আনলেন মঙ্গলবার বিদায় নেবার দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদলেন এবং সবাইকে কাঁদালেন। কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। এভাবেই জীবন নদীর একপ্রান্ত ভেঙে অন্য প্রান্ত গড়ে ওঠে। সেদিন লাক্কাতুরা চা বাগানে দেলওয়ার মামাদের বাসায় বিকাল নাগাদ পৌঁছলাম এবং পরের দিন সকাল ন’টায় সুরমা মেইলে সিলেট থেকে চিটাগাং রওনা হলাম। তখনকার লক্করঝক্কর ট্রেন, আন্তঃনগর ট্রেন তখনো চালু হয়নি। ঝরঝক্কর ঝরঝক্কর ট্রেন চলতে চলতে তেরো ঘন্টা পরে চট্টগ্রাম ষ্টেশনে যখন পৌঁছলাম, তখন রাত দশটা। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছতে রাত এগারো। দেলওয়ার মামা তার ৩১৭ নং রুমে, তার বেডেই ডাবলিং করে থাকার ব্যবস্থা করলেন। তার সহযোগিতায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলাম। এই ৩১৭ নম্বর রুমই আমার রুম হলো। এই রুমের নাম আমি দিয়েছিলাম “বিদিশা”। শব্দটা জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতা থেকে সংগৃহিত। এখানে থেকেই আমি মাষ্টার্স শেষ করে বের হলাম। পরেরদিন বাড়িতে চিঠি লিখলাম, উত্তর আসলো পনরো দিন পরে। বাড়িতে টেলিফোনের সুযোগ নেই, যুগটা ও মোবাইলের না। যা হোক, সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করে ১৯৮০ইং সনের ১১ই সেপ্টেম্বর আমি নোয়াখালীর কবিরহাট কলেজে কলেজ শিক্ষকতায় প্রবেশ করি। নিয়োগপত্রে উল্লিখিত কলেজ প্রদত্ত আমার মাসিক বেতন ছিল সাকুল্যে ৪০০ টাকা। সরকারি একটা অনুদান ছিল বটে; কিন্তু সেটা অনিয়মিত ও অনিশ্চিতও বটে; চার পাঁচ মাস পরে পাওয়া যেতো”। (দ্বিকাল-দর্শীর ডাইরি)
শৈশব কৈশোর থেকে তিনি শিক্ষকতার আদর্শ নিয়েই বড় হয়ে ওঠেন। নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলেও মানুষ গড়ার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। গুণী শিক্ষক মামুনুর রশীদের দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর শিক্ষকতা জীবনের সফলতার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু অনেক গল্প থেকে যায়। তবে এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন গড়ার কারিগর তিনি। মামুনুর রশীদ জ্ঞানের আলো দ্বারা যুগের সব অন্ধকার দূর করে মানুষের জন্য সভ্য পৃথিবী সৃজন করে যাচ্ছেন। একজন সফল মানুষ গড়ার কারিগর মামুনুর রশীদের আগামীর দিনগুলো সুস্থ থাকুক- সেই কামনা করি।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

জীবন সংগ্রামী একজন শিক্ষকের চালচিত্র

আপডেট সময় ০৬:২৭:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর ২০২২
ফয়সল আহমদ রুহেল : মামুনুর রশীদ। ছিলেন সরকারী কলেজের প্রফেসর ও সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। এক সময়ে লেখালেখি করতেন। লেখক নাম ছিল মামুন ইব্রাহিমী। কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। এখনো মামুনুর রশীদ শিক্ষকতার পাশাপাশি কবিতার লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। এটাই তাঁর শেষ কর্মস্থল। এই গুণী শিক্ষক মামুনুর রশীদ সফলতার সঙ্গে সরকারি চাকরিকাল শেষ করে অবসরে যান ২০১০ এ। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মামুনুর রশীদের এই দীর্ঘ চাকরি জীবনে সফলতা তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি।
জন্ম : তিনি ১৯৫৩ সালের ১৯ জুলাই মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার তেলিজুরী (মৌলভীবাড়ী) গ্রামের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম বজলুর রহমান, মাতা বিলকিছ বেগম (মরহুমা)। মামুনুর রশীদ এর পিতা মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার খলাগ্রাম করিমপুর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তাঁরা ভাইবোন ৫ জন। এর মধ্যে দুই ভাই শিক্ষক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত এবং একজন কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি সবার বড়।
পারিবারিক জীবন : গুণী এই মানুষটি কর্মক্ষেত্রে যেমন সফল, তেমনি পরিবার প্রধান হিসেবেও নিজ সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত এবং দীক্ষিত করে গড়ে তুলেন। প্রফেসর মামুনুর রশীদ এক ছেলে ও এক মেয়ের  জনক। মেয়ে বড়- ইংরেজীতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে মেয়ে ঢাকায় থাকেন এবং বিবাহিত। ছেলে সিলেটের লিডিং ইউনির্ভাসিটি থেকে বিবিএ শেষ করেন। বর্তমানে ঢাকার ‘হাওলাদার এন্ড ইউনুস’ সিএ ফার্মে সিএ অধ্যয়নরত। বর্তমানে তিনি মৌলভীবাজার মিশন রোড এলাকায় বসবাস করছেন।
শিক্ষা জীবন : শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদ কর্মবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। তাঁর জীবন ছিল নানা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। তিনি তেলিজুরি প্রাইমারী স্কুল ও খলাগ্রাম প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন আনুমানিক ১৯৬০-১৯৬৫ ইং সনে। এরপর খলাগ্রাম করিমপুর হাইস্কুলে নবম শ্রেণী ও রাজনগর পোর্টিয়াস হাইস্কুল থেকে দশম শ্রেণী অধ্যয়ন করে ওই স্কুল থেকে ১৯৭০ সালে (পাকিস্তানের শেষ ব্যাচ)। কুমিল্লা বোর্ডের এসএসসি পরীায় মানবিক বিভাগে ১ম বিভাগ অর্জন করেন। তারপর ১৯৭২ সালে এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (তৎকালীন) থেকে আইএ পাশ করেন। মাত্র ৩ নম্বরের জন্য ১ম বিভাগ পাননি। তিনি ১৯৭৩ সালে এম.সি কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন। ওই কলেজ থেকে সম্ভবত: ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় ২য় শ্রেণীতে ৪র্থ স্থান পান। সে বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন প্রথম শ্রেণী ছিল না। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে এম এ সম্পন্ন করে বের হন। এর আগে অনার্স পরীক্ষা দেবার পর রাজনগর পোর্টিয়াস হাইস্কুলে ৩ মাস শিক্ষকতা করেন।

কর্মজীবন : মামুনুর রশীদের বাবা ছিলেন শিক্ষক। তিনি সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন আদর্শের কারণে। গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। আজীবন মগ্ন ছিলেন জ্ঞানের সাধনায়। তিনি পিতার সেই পথ অনুসরণ করে পড়ালেখার জীবন শেষ করে যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশায়। মামুনুর রশীদ ১৯৮০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী জেলার কবিরহাট ডিগ্রি কলেজে বাংলার লেকচারার হিসেবে প্রথম কলেজ শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখান থেকে ১৯৮১ সালে কলেজ পরিবর্তন করে একই জেলার চাটখিল কলেজে চলে আসেন এবং ওখান থেকে সরকারি চাকুরিতে প্রবেশ করেন। তারপর একটানা প্রায় তিরিশ বছর বিভিন্ন সরকারী কলেজে চাকুরি করে সর্বশেষ ২০১০ সালের জুলাই মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রফেসর হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। গুণী এই মানুষটি বর্তমানে ২০১১ সাল থেকে মৌলভীবাজার ইম্পিরিয়েল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন। টুকটাক বাদ দিলে এই গুণী শিক্ষকের দীর্ঘ প্রায় বিয়াল্লিশ বছর শিক্ষকতা চলছে। এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে জ্ঞানের বাতিঘর হয়ে তিনি নিজেও হয়ে উঠেছিলেন আলোকিত স্বজন।
শিক্ষক থেকে লেখক : মামুনুর রশীদ এক সময়ে লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখা সিলেটের সাপ্তাহিক ‘যুগভেরী’, সাপ্তাহিক ‘সুর’ ইত্যাদি পত্রিকায় কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। মামুনুর রশীদ এর লেখক নাম ছিল মামুন ইব্রাহিমী। এই নামে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার মাধ্যমে একজন কবি তার মনের অনুভূতি সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। পাঠকরা সেই কবিতা পড়ে কবির অনুভূতিকে ধারন করেন। কবিতা মানুষের মনের অনুভূতিকে জাগ্রত করে। মামুনুর রশীদ শিক্ষকতার পাশাপাশি কবিতার লেখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সেটা প্রশংসার দাবিদার। ২০১৩ সালে ‘এই দাবদাহে, এ অরণ্যে’ নামে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মলাটবদ্ধ হবার অপেক্ষায় রয়েছে ‘দ্বিকালদর্শীর ডায়রি’ একটি আত্মজৈবনিক ভাষ্য।
শিক্ষক শিক্ষার মেরুদন্ড : শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মামুনুর রশীদ শিক্ষার দুরবস্থা নিয়ে হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। আমার ধারণা এটি একটি আলংকারিক বাক্য। ওই পর্যন্তই। শুনতে ভালো লাগে। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড-এটা সর্বত্র প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষক শিক্ষার মেরুদন্ড-এ কথাটি ঘুনাক্ষরেও কোথাও উচ্চারিত হয় না। এর জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর প্রয়োজন। একটা আন্দোলন করার দরকার। শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষ যে হচ্ছে না-এটা স্পষ্ট। কিন্তু শিক্ষার পরিমাণগত উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষক সমাজেরও উন্নতি যে প্রয়োজন সেটা বলাবাহুল্য। না হলে লর্ড মেকেলের শিক্ষানীতির মতো আমগাছে আমড়াই ফলতে থাকবে।”
অদৃশ্য নিয়তির অদৃশ্য প্রভাব : মামুনুর রশীদের প্রথম জীবনে শিক্ষকতা পেশা পছন্দের ছিল না। তিনি আমলা হতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু সেটা হতে পারেননি। ঢুকেছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। সেই পঞ্চাশ বছর আগের কথা মামুনুর রশীদ স্মৃতি চারন করেন। বলেন, “তখন তিনি রাজনগর পোর্টিয়াস হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়তেন। ক্লাসের সেকেন্ড বয় হিসেবে বসার স্থান প্রথম বেঞ্চে। ক্লাশ নিচ্ছিলেন হেডমাষ্টার স্যার। তিনি ইংরেজি পড়ান। কথায় কথায় জানালেন, স্কুলে মহকুমা শিক্ষা অফিসার এসেছেন, একটু পরেই তোমাদের ক্লাসে আসবেন, তোমরা প্রস্তুত থেকো। তিনি আসলেন এবং প্রথম বেঞ্চের ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, জীবনে কে কি হবে। আমাকে এই প্রশ্নটা করতেই, বোকার মতো না বুঝেই উত্তর দিলাম,“আমি একজন প্রফেসর হবো” প্রফেসর নামক পেশাটা যে কী, আমি নিজেই জানতাম না। অদৃশ্য নিয়তির অদৃশ্য প্রভাবে পরবর্তীকালে আমি তাই হয়েছিলাম। অর্থাৎ একজন শিক্ষক। প্রথম জীবনে শিক্ষকতা আমার পছন্দের পেশা ছিলো না। যদিও আমার আব্বা হাইস্কুলে সমাজ বিজ্ঞান ও ইসলাম ধর্মের শিক্ষক ছিলেন। আমলা হতে চেয়ে ছিলাম, কিন্তু অনিবার্য এক কারণে সেটাও হলো না।

বিদ্যাজীবি’ কিংবা ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দ দুটোর সম্পর্ক : মানবিক মূল্যবোধ মানুষের মানবিক আচরণ, ব্যবহার ও কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করাকে বুঝায়। কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়ার শিল্প ব্যবসা-বাণিজ্য ভোগবাদী মানসিকতায় মানুষের বিদ্যা বুদ্ধি, মেধা-প্রজ্ঞা ও মানবিক মূল্যবোধে ছেদ পড়েছে। শিক্ষক সমাজের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে মামুনুর রশীদ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
প্রথমত, শিক্ষক শব্দটি শুনলেই উনিশ শতকী একটি ধারণা মনে বাসা বাঁধে। এবং সেটা কি? নিরীহ, ভদ্র, বিনয়ী আদর্শবাদী ও প্রায় নির্বিবাদী একজন মানুষ, যিনি বা যারা অল্পে তুষ্ট, যার জীবন সহজ সরল, যাদের অধিকাংশেরই জীবন চিন্তা ও মননশীলতায় সমৃদ্ধ। কিন্তু একালে শিক্ষক সম্পর্কে উল্লিখিত ধারনাগুলো আর নেই। এই না থাকার মূল কারণটাই হলো, সমকালীন সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন। পবির্তনের অন্তরালবর্তী কারনসমুহের আরো সংলগ্ন হলে এটা বুঝতে অসুবিধা হবে না যে সমাজকে পরিবর্তনের স্রোতধারায় যখন গোটা সমাজটাই পাড়ভাঙ্গা নদীর স্রোতের মত ছুটে চলেছে লক্ষ্যহীনভাবে, তখন সমাজেরই একটি অংশ হিসেবে, শিক্ষক সমাজও ভেসে চলেছেন অসহায়ভাবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষক কিংবা শিক্ষকতা শব্দটির সাথে ‘বিদ্যাজীবি’ কিংবা ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দ দুটোর আত্মিক সম্পর্ক আছে, যদিও প্রত্যেক শিক্ষক বিদ্যাজীবি হলেও সবাই ‘বুদ্ধিজীবি’ নন। অবশ্য এটা প্রচলিত অর্থে। যদিও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবি কোষ’ গ্রন্থে ষোলটি পেশাজীবি সম্প্রদায়কে বুদ্ধিজীবি বলা হয়েছে। কিন্তু অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘বুদ্ধিজীবি’, বিশেষ করে নিকটতম সম্পর্কযুক্ত ‘আঁতেল’। শব্দটি কিঞ্চিত ব্যাঙ্গার্থেই প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেমন, ‘আঁতলামি’ পরিহার করুন। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম ঐতিহাসিক- দার্শনিক আর্নল্ড টয়েনবি একটুখানি ব্যঙ্গ করে তাঁর দেশের বিদ্যাজীবিও বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়কে ‘ইন্টারন্যাল প্রলেটারিয়েট’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। (স্টাডি অব হিষ্ট্রি)। টয়েনবির কাল অতিক্রম করে আমরা আজকে একুশ শতকের তৃতীয় দশকে এবং এটা আজকে সমুহ দুর্ভাবনার বিষয় যে কর্পোরেট দুনিয়ার কথিত নতুন বিশ্বব্যবস্থার বেনাজলে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে মানুষের তাবৎ বিদ্যা বুদ্ধি, মেধা- প্রজ্ঞা, রূপযৌবনসহ যাবতীয় শারীরবৃত্তিয় অনুসঙ্গ ও মানবিক মূল্যবোধসমুহ। মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে উল্লিখিত কথাগুলো এ কারণে বললাম যে, সত্তর দশকের একবারে শেষের দিকে আমি যখন শিক্ষকতায় ঢুকলাম, তার বহু আগেই ব্যক্তিতে, সমাজে ও রাষ্ট্রে ভাঙনের নেতিবাচক সুর বাজতে শুরু করেছে। নাট্যকার মামুনুর রশীদের ‘সুবচন নির্বাসনের মতো নাটকগুলো সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে।”
কলেজ জীবনের বহমান সময় সম্পর্কে প্রকাশিতব্য ‘দ্বিকালদর্শীর ডাইরি’ গ্রন্থে তিনি বয়ান করেন। “মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ এক অনিবার্য পরিবর্তনের মুখোমুখি। চারদিকে অভাব অনটন হাহাকার, সামজিক নৈরাজ্য কিংবা তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা এর মধ্যেই চলেছে আমার কলেজ পড়ার জীবন।” ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন “আমার আব্বা ছিলেন স্থানীয় খলাগ্রাম হাইস্কুলের শিক্ষক, গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজে ইমামতি করতেন, গ্রামের মানুষের কাছে প্রায় অজাতশত্রু। জমি জিরেত যা ছিল, তা থেকে উৎপন্ন ধান দিয়ে ছয় সাত জনের একটি পরিবারের টেনেটুনে বাৎসরিক অন্ন সংস্থান হতো। আমরা পাঁচ ভাইবোনের তিন ভাই-ই কলেজ পড়ুয়া আমি এমসি কলেজে বাংলা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পরীক্ষার্থী, দুই নম্বর ভাই মৌলভীবাজার কলেজে বি কম ফাইনাল ইয়ারে, সেও পরীক্ষার্থী এবং তিন নম্বর ভাই এসএসসি পরীক্ষা দেবে রাজনগর হাইস্কুল থেকে। তিনজনই যথাক্রমে মানবিক বিভাগ, বাণিজ্যবিভাগ ও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তিনজনই এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়েছি। এই দুঃসহ অভাবের মধ্যে আমি একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম তৎকালীন সিলেট ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। বর্তমানে সিলেট সরকারি কলেজ। সিলেট উচ্চমাধ্যমিক কলেজে পড়াকালীন সময়ে দিনের বেলা কেটে যেত ক্লাশ করে আর কলেজ ক্যান্টিনে অকারণে আড্ডা দিয়ে। কফি হাউসের সেই আড্ডাটা এখন আর নেই বটে; কিন্তু অন্তরঙ্গ সহপাঠি বন্ধুবান্ধবদের এবং প্রিয় স্যারদের কথা এখনো স্মৃতিতে অম্লান। খছরু, লকিত (দুজনেই কানাডায়), ফরাসত আলী, আমার পাশের গ্রামের, নিউইয়র্ক ইনস্টিটিউট অব টেকনালেজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বহুকাল আমেরিকায় থেকে সম্প্রতি দেশে আছে। এন আর বি সি ব্যাংকের চেয়ারম্যন ছিল এক সময়। মাঝে মধ্যে তাঁর সাথে যোগাযোগ হয়। সিতেশ প্রশাসন ক্যাডারে, উপসচিব থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরন করেছে। সর্বশেষ, ইন্টারমিডিয়েটের আরেকজন ক্লাশমেটের কথা না বললে ই নয়; এবং সে হচ্ছে, কুলাউড়ার আজম জাহাঙ্গীর চৌধুরী। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি। সম্ভবত ২০০৭ এ সে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ সেলিমের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় চাঁদাবাজির মোকদ্দমা করেছিল। বাহাত্তরের এক সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে একসাথে চা খেয়েছিলাম। এদের সংস্পর্শে আমি উদ্দীপিত হয়েছিলাম। সন ১৯৭১ সে সময়ে সমাজে লজিং কালচার প্রচলিত ছিল। আমিও আমার এক নানা জনাব মনোহর আলী বেগ সাহেবের বদান্যতায় তাঁর টিলাগড়ের বাসায় (এমসি কলেজের গেইটের সামনে) লজিং এ থাকি। লজিং এ থাকা মানে সুখে দুঃখে থাকা। ১৯৭৪ এ আমি যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, তখন নবীন বাংলাদেশ মন্বন্তরের মুখোমুখি, বাড়ি থেকে আব্বা মাসে দু একখানা পত্র লেখেন, সেই পত্র মারফত আকারে ইঙ্গিতে বুঝতে পারি, বাড়িতে খুব অভাব অনটন চলছে। জানতে পারি যে, সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ ও আমাদের ভাইদের স্কুল কলেজের বেতনাদি ও পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকা পরিশোধের জন্য আব্বা হাওরের বেশ কিছু জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন। বাড়ির জন্য মনটা আইটাই করছে, কিন্তু একদিকে ক্লাশ চলছে এবং আমার হাতে বাড়ি যাওয়ার মত কোন টাকা পয়সা নেই বলে, খুব কষ্ট হলেও, সে পরিকল্পনা আপাতত বাদ দিলাম। অবশ্য একটা টিউশনি খুঁজছিলাম, কিন্তু দেশের এই অর্থনেতিক দুর্দিনে প্রাইভেট পড়ানোর মতো কাউকে পাওয়া গেলো না। বারবার আমার আম্মার চিন্তাকিষ্ট মুখ ও আব্বার চেপে রাখা দুঃখভারাক্রান্ত চেহারা চোখে ভেসে উঠছিল। ক্লাশ ও পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু নিজেকে চালিয়ে নেবার মত কোন ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। বলে নিজের কাছে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। একটা প্যান্ট, একটা পায়জামা ও একটা শার্ট ও একটা পাঞ্জাবি আমার কলেজ ড্রেস। প্যান্টটা নিচের দিকে অনেকখানি ছিড়ে গিয়েছে বলে ওটাকে দর্জির কাছে নিয়ে নিচের দিকটা কাপড় জোড়া লাগিয়ে “ইলেফ্যান্ট বটম” নামক, তখনকার দিনে তরুণ সমাজের কাছে প্রিয় একধরনের প্যান্টে রুপান্তরিত করেছিলাম। হাঁটুর উপরের দিকে অপেক্ষাকৃত সরু এবং হাঁটুর নিচের দিকে অস্বাভাবিক প্রসারিত প্যান্ট গুলোকে “ইলেফেন্ট বটম” স্টাইল বলে। এতে করে আমি নুতন একটা প্যান্ট বানানোর খরচ বাঁচিয়েছিলাম। গত চিঠিতে আম্মা জানিয়েছেন যে আমার আট বছরের ছোট বোন দিলওয়ারা বায়না ধরেছে যে আমি সিলেট থেকে বাড়ি যাওয়ার সময়, তার জন্য যেন একগাছি গলার হার নিই। এবার সিলেট আসার সময় আমার গলা জড়িয়ে আমাকে একটা চুমু দিয়েছিল। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম ও বেড়ে-ওঠা ও অভাব অনটনের মাঝে এই পারিবারিক স্নেহের বন্ধন দুরে গেলে ও আরো বেশি জমাট হয়ে উঠে। দিনের বেলা ক্যাম্পাসে ও ক্লাশে সহপাঠিদের সাথে পড়াশুনা ও আড্ডায় দুঃসময়টা কেটে যেতো বটে; বিকালে ও সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে হাঁটাহাটি করে মাগরিবের নামাজ টিলাগড় মসজিদে আদায় করে, নিয়মিত পড়াশুনা করতে বসতাম বটে, কিন্তু রাতে ঘুমানোর আগে বৈশাখী কালো মেঘের মত একদলা চিন্তা মাথার মধ্যে বাসা বেঁধে বসতো। আমার কেবলই মনে হতো, আমার বোধ হয় আর পড়াশুনা করা হবে না। আমি খুব চাপা স্বভাবের মানুষ বলে, এগুলো বাইরে প্রকাশ করতাম না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমাকে ওভাবেই পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হবে। অতএব, আলস্যকে এড়িয়ে আমি রাতে, বিশেষ করে রাত জেগে পড়াশুনা করতাম। দেশের যে অবস্থা, চারপাশে কেমন যেন একটা অস্থির অস্থির পরিবেশ। গতরাতে এমসি কলেজের হোষ্টেলের দিকে পুলিশ ও জাসদ গণবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে। কদিন ধরে থেমে থেমে নানা জায়গায় ওরকম হচ্ছে। আগামী কালকের একটি টিউটোরিয়েল রেডি করতে গিয়ে অনেক রাত হয়ে গেলো। রাত দুটা আড়াইটার দিকে বিছানায় যেতেই কখন যে ঘুম লাগল, টেরই পাইনি। একবারে ভোর রাতের দিকে চাচির (এটা চাচির আব্বার বাসা) ডাকে ঘুম যখন ভাঙলো, তখন দেখি, আমাদের চৌধুরী বাড়ির ডাক্তার চাচা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। কি বিষয়? আমাকে জানানো হল, আমার নানা ইন্তেকাল করেছেন, আমাকে এক্ষুনি বাড়ি যেতে হবে। অগত্যা একটি বেগে কাপড়চোপড় ও দিলওয়ারার গলার হার ভরে সকালের ট্রেনে, বরমচাল, সেখান থেকে করিমপুর চা বাগান দিয়ে, মুন্সিবাজার হয়ে, যখন সকাল এগারোটার দিকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলাম, তখন বিস্ময়ের সাথে দেখলাম আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে, জানাজা শেষে কবরে নামানো হচ্ছে আমার নানাকে নয়, আমার অত্যন্ত আদরের ছোটবোন দিলওয়ারাকে। সিলেটে আমার কাছে সেটা লুকানো হয়েছিল। সে ছিল আমাদের ভাইদের সবার ছোট এবং সবার আদরের। দোহারা গড়নের, হাসলেই গালে টোল পড়তো। প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত আঘাত জীবনে এই প্রথম পেলাম। বস্তুত, এই মৃত্যুটি জীবন সম্পর্কে আমার মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও নৈরাশ্যের সৃষ্টি করলো। এরপর থেকেই শুধু আম্মার কাছে কাছে থাকতাম। পড়াশুনা করার ইচ্ছা একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের কল্পনাতীত ঘটনাকে সামাল দিয়ে এবং বুকটাকে পাষান বানিয়ে আব্বা আম্মার প্রচন্ড চাপে আবার পড়ালেখার জন্য চলে আসতে হল সিলেটে। আসলেও কি হবে? হঠাৎ প্রয়াত বোনটির কথা মনে পড়ে যেতো। প্রতিদিন ঘুমাবার আগে, কখনোবা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, কোথাও একা বসে থাকলে, তার কথা মনে পড়লেই চুপি চুপি চোখটা নিজের অজান্তেই ভিজে আসতো। কিন্তু সত্যিকার অর্থে, দুর্ভিক্ষপীড়িত সে সময়ে, নিরন্তর অভাব অনটনকে গায়ে মেখে প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত একটা বেদনাকে অষ্টপ্রহর বহন করা ও সম্ভব ছিল না। সে বেদনা একদিন ক্রমশ হালকা হল। জীবনের ধর্ম তাই। জীবন হচ্ছে ব্যারিকেড পার হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আল্লাহর উপর নির্ভর করে অনবরত চেষ্টা করে যাওয়া। কিছুদিন পর এই লজিংটা পরিবর্তন করে পুতুল খালার বাসায় লজিং নিলাম। আমার জীবনে বড় হতে তাঁদের সহৃদ্য অবদানকে আমি গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহ তাঁদের মঙ্গল করুন। তাঁদের স্নেহ-মমতা ছাড়া আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল জীবনের এই পর্যায়ে আসা। তাঁদের অনেকেই এখন পৃথিবীতে নেই, তাঁদের পারলৌকিক জীবনের সর্বোত্তম মঙ্গল কামনা করি। এ রকম হাসি কান্না
দিনগুলো যাচ্ছিল; গতানুগতিক, রক্তবর্ণহীনও পানসে। না প্রেম, না বিপ্লব। এরই মধ্যে কয়েকদিন বাড়িতে থেকে আবার সিলেটে চলে এসেছি। শহরে অভাব অনটন অতোটা টের পাওয়া যায় না, কিন্তু গ্রামে আসলেই চারপাশের মানুষের চলমান জীবনযাপনে অভাবটা বড় বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠে। বাড়ি গিয়ে দেখলাম, আমাদের খুব প্রিয় একটি কালোজামের পুরোনো বড় গাছ আব্বা চল্লিশ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। গ্রামের মানুষের মধ্যে জমি জমা, গরুছাগল ও ঘটিবাটি বিক্রির হিড়িক পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় চৌধুরী বাজারে একটি লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে; প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে অভাবী মানুষকে খাওয়ানো হয়। সেবার বাড়ি থেকে সিলেট আসার কালে আব্বা কেন যেন জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ফাইনাল পরীক্ষার দেরি কেমন? প্রশ্নটা পাথর চাপা দিয়ে আবারো চলে আসতে হলো সিলেটে। এটা আমার প্রায়ই হতো, সিলেট থেকে বাড়ি যেতে অনেকগুলি তারিখ পেছাতাম, আবার বাড়ি থেকে সিলেট যেতে হলেও সে রকম, অনেকগুলো তারিখ বদলাতে হতো। কারণটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্লাশগুলো বাদ যেতো। অনেকগুলো এ্যাসাইনমেন্ট (তখন এটাকে আমরা বলতাম, টিউটোরিয়েল) জমে যেতো। এগুলো আবার কষ্ট করে রেডি করে স্যারদের কাছে জমা দিতে হত। এখানে একটা কথা বলা উচিত এবং সেটা হচ্ছে যে পড়াশুনার কষ্টের মধ্যে ও মনের মাঝে একটা ফুরফুরে আনন্দ সবসময় থাকতো। জানি না, এটার কারণ কি, সে সময়টার এই উৎসবিহীন আনন্দের মনস্তাত্বিক কোন ব্যাখ্যাও আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আমি নিশ্চিত যে, অবাঙমানসগোচর সেই বিমূর্ত আনন্দবোধ গাড়ির পিষ্টনের মত আমাকে বারবার সামনের দিকে এগিয়ে নিত। আমার দুঃখকষ্টগুলোকে। হালকা করে দিত।

পারিবারিক ইতিহাসের একটি অধ্যায় সমাপ্ত : কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গুনী এই শিক্ষক বলেন, খুব সম্ভব ১৯৭৬ সাল, আমার অনার্স পরীক্ষার আর মাত্র তিন মাসের মত বাকি। অনার্স ফাইনালের ফরম ফিলআপ শেষ। এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে ফরম ফিল আপ করেছি। আটঘাট বেঁধে পড়াশুনায় লেগেছি। হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে পত্র পেলাম, আব্বা স্ট্রোক করেছে। এক সাইড অবশ, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলেন। হায় আল্লাহ! মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পড়াশুনা, বইপত্র রেখে পাগলের মত ছুটলাম বাড়িতে। গিয়ে দেখি, আব্বা বিছানায় শুয়ে, ডান দিকটি অবশ, জড়িয়ে জড়িয়ে কথা যা বলছেন, তার অধিকাংশই বোঝা যাচ্ছে না। তখন আমার মাথায়, একমাত্র চিন্তা, কিভাবে আব্বার চিকিৎসা চালানো যায়। বিশ শতকের সত্তর দশকের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল, ধারে কাছে ডাক্তারই নেই, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মেলার তো প্রশ্নই ওঠেনা। যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ, সময়টা বর্ষাকাল। তার উপর টাকা পয়সার অভাব তো আছেই। পাশে ইটা চা বাগানের ডাক্তার নরেন বাবু চিকিৎসা করছেন, কিন্তু অসুখটা মূলত নিউরন ঘটিত, কিন্তু নিউরোলজির ডাক্তার কোথায়? অতএব, সে রকম চিকিৎসা হচ্ছে না, রোগ বাড়ছেই। অগত্যা, নৌকায় করে, কাওয়াদীঘি হাওর হয়ে, মৌলভীবাজারে এসে ড. সৈয়দ হককে দেখানো হল। তিনিও আমারে কোন খবর দিতে পারলেন না। উপায়ান্তর না দেখে যথারীতি বাড়ি ফেরা। অসুখ আরো একটু বাড়তেই কারো কারো পরামর্শে ওঝাও আনানো হল। কিন্তু আল ভেঙ্গে জমিতে পানি ঢুকে গেছে, অতএব, সেভাবেই দেড়মাস বিছানায় থাকার পর, অনেক কষ্টে, অনেক না-বলা কথাকে বুকে চেপে, স্ত্রী-পুত্র কন্যা ও অন্যান্যদের সম্মিলিত কালিমা শাহাদৎ উচ্চারণের মধ্যদিয়ে আমার আব্বা পঁচিশে রমজানের ঠিক ইফতারের সময় ইন্তেকাল করলেন আর কাটা কই মাছের মত আমরা ক’জন ভর সন্ধ্যায় মাটিতে গড়াগড়ি করলাম। আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল।

জীবন পথের অব্যর্থ পাথেয় : বিশ্ববিদ্যালয় স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমার অনার্স পরীার তখন দেড়মাস বাকি। বর্ষার রাতের জলে দলাপাকানো একদল পিপড়ার মত আমাদের পরিবারটি তখন ভেসে চলেছে কোন এক নিরুদ্দেশ যাত্রায়। আল্লাহ ভরসা। কিন্তু জীবনকে তো সামনে দিকে চালিয়ে নিতে হবে। আব্বার মৃত্যুর দশ পনরো দিন পর্যন্ত তড়িতাহতের মত ট্রমাগ্রস্ত হয়ে পড়ে রইলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, আর পড়াশুনা করবো না এবং পরীক্ষা ও দেবোনা। শেষ পর্যন্ত আমার ও অন্যান্য আত্মীয়দের প্রচন্ড চাপে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। পিতৃবিয়োগের অনিবার্য ধকলে পরীক্ষার আগের দিনগুলাতে একেবারেই পড়াশুনা হয়নি। অতএব, পরীক্ষা দিলাম বটে, কিন্তু সেটা অনেক আগের প্রস্তুতির উপর নির্ভর করে, আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না প্রায় তিন মাস পর যখন আমার অনার্স পরীক্ষার ফলাফল জানতে পারলাম যে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স পরীক্ষা দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ হযেছি, সে সময় আমি আমার এক চাচাতো ভাই আকিকের জানাজার নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অবশ্য সে বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স পরীক্ষা কোন ফাস্টক্লাশ আসেনি। আমি তো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে পড়াশুনা আর করবো না, কিন্তু ফলাফল একটু ভালো হওয়াতে আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে ডেকে ডেকে শান্তনা দেয় আর বলে,“তোমার রেজাল্ট টা ভালো হয়েছে, আরো একটু কষ্ট করে এমএ টা শেষ করে নাও”। কিন্তু কিভাবে? দেশ বিদেশের সহৃদয় আত্মীয়স্বজনের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় ও আমার আম্মার তাগিদে আবার জীবন যুদ্ধে কোমর বাঁধলাম। এবার যেতে হবে সুদুর চট্টগ্রামে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, এফ রহমান হলে সিট পাওয়া, অচেনা চট্টগ্রামে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, কটারকোনার দেলওয়ার মামার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠা, তার রুমের বোর্ডার হওয়া, ইত্যাদি কাজগুলো যে কিভাবে হয়েছিল, আজ পয়তাল্লিশ বছরপরে মনে করলে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। কে এই প্রায় অসাধ্য কাজগুলো আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে, সেটার যুক্তিগ্রাহ্য কোন ব্যাখ্যা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এগুলোর প্রত্যেকটিই যে আমার জীবন পথে সামনে চলার একেকটি অব্যর্থ পাথেয় ছিল, তখন না বুঝলে ও পরিণত বয়সে এসে, ঘটনাগুলোকে উল্টেপাল্টে বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে, যে আমার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য, এগুলো ঘটার প্রয়োজন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব, কিভাবে ভর্তি হব, কারো সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করবো, এমন কেউ ছিল না। আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার দেনা করে আপাততঃ টাকা পয়সার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল বটে; কিন্তু পরামর্শ দেবার মত কোন মানুষ পাইনি। (দ্বিকাল-দর্শীর ডাইরি)
যদি লক্ষ্য থাকে অটুট : জীবনে লক্ষ্য অটুট থাকলে যে কেউ সফল হবে। লক্ষ্য ঠিক করো জীবনে কী হতে চাও। স্বপ্ন দেখো নিজেকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও। তাহলে ওই জায়গায় অবশ্যই পোঁছাতে পারবে। মামুনুর রশীদ লক্ষ্য অটুট রেখে ঠিক সেই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক চিত্র তিনি তুলে ধরেন।এক বুধবারে স্থানীয় মুন্সিবাজারে গিয়েছি; সন্ধ্যার কিছু আগে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বাজার থেকে বের হচ্ছি, দেখি শ্যামলা রঙের একজন তরুণ অন্যদিকে তাকাতে তাকাতে হন হন করে ছুটে এসে আমার সাথে ধাক্কাই খেয়ে বসলেন। আমার হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গিয়ে বাজারে একটা সিনক্রিয়েট হয়ে গেল। ব্যাগ থেকে খরচাপাতি পড়ে গিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। ওই তরুণ নিজেই লজ্জা পেয়ে মাটিতে ছড়ানো ছিটানো খরচাপাতি তুলতে শুরু করলেন। এবার তার মুখের দিকে তাকাবার সুযোগ পেলাম। বড় বড় দুটি চোখ, ক্লিন সেভ, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল, হাতে একটি ইদ্রিস মার্কা ছাতা, কথা বলার সময় কারনে অকারনেই ঘনঘন হিস্ হিস্ শব্দ করা- সবমিলিয়ে তাকে আমার কাছে খুব আপন বলেই মনে হল। তিনিও আমাকে বিস্মিত করে পাশের সোনাচান্দের মিষ্টির দোকানে টেনে নিয়ে গেলেন। অতঃপর চা-মিষ্টি খেতে খেতে দুজনের আরো পরিচয় ও ঘনিষ্টতা। আলাপে আলাপে জানা গেল, তার বাড়ি মৌলভীবাজারের কটারকোনা; এখানে এক আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে আসা। আমিও জানালাম, আমি এমসি কলেজের ছাত্র, অনার্সে মোটামুটি একটা ভালো রেজাল্ট হয়েছে; এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা এমএ ফাইনাল ইয়ারে ভর্তি হব। তিনিও জানালেন, তিনিও একই বিশবিদ্যালয়ে বাংলা এমএ ফাইনাল ইয়ার এ পড়েন। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। এফ রহমান হলের ৩১৭ নম্বর রুমে থাকেন। পরীক্ষা পরেই রুম ছেড়ে দেবেন; আমি ইচ্ছে হলে সুযোগটা নিতে পারি। তিনি সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। আজকে তো বুধবার, আগামী বুধবারে তিনি চিটাগাং যাবেন। ব্যস, কথা পাকা হয়েই গেল; আমি তাঁর সাথে চিটাগাং যাব। আমি যেন আগেরদিন লাক্কাতুরা চা বাগানে তাঁদের বাসায় চলে যাই; কারন, তাঁর আব্বা সে বাগানে চাকরি করেন এবং তারা সপরিবারে সেখানেই থাকেন। ঘনিষ্টতার বন্ধন আরো পাকা হল, যখন তিনি জানলেন যে, শাবন্দর ছিরাইনগরের আমার ফুফুতো ভাইয়েরা কি সম্পর্কে তার মামা হন, অতএব, আমিও সে দিনই মামাতে রূপান্তরিত হলাম। আমি শুধু শুধু অবাক হচ্ছি; এ যেন না চাইতেই জলভরা মেঘ। আপাততঃ ওখানেই বিদায়; আল্লাহ হাফেজ, দেলওয়ার মামা। তিনিও একটা রমনা সিগারেট ধরিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। তার সিগারেট টানার স্টাইলটাও আমার মনে ধরলো। দু আংগুলের এক্কেবারে অগ্রভাগে জলন্ত সিগারেটটির একবারে বটমলাইনে দুই ঠোঁট লাগিয়ে জোরে টান দিয়ে নাকমুখ দিয়ে দলা দলা রমণীমোহন ধুম্র উদগীরণ। তখনকারকালে মেয়েরা ধুমপায়ী পুরুষদের নাকি খুব পছন্দ করতো। বাড়িতে এসে আম্মাকে সব খুলে বলতেই, তিনি চট্টগ্রাম যেতে সায় দিলেন কিনা বুঝা গেলোনা। আচ্ছা দেখা যাক বলে প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে রাখলেন এবং পরের দিন সকাল বেলা বললেন,“আচ্ছা যাও, আল্লাহ ভরসা” তারপর খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানতে চাইলেন। আমি কোনটার উত্তর দিলাম, আবার কোনটার উত্তর দিতে পারলাম না। আমি তাঁর প্রথম সন্তান, মায়ের মন; দুরে পাঠানোর আগে হাজারো ভাবনায় মন উদ্বেলিত হবারই কথা। সারারাত হয়তো আকাশপাতাল ভেবেছেন। মামাদের কাছ থেকে টাকা চেয়ে আনলেন মঙ্গলবার বিদায় নেবার দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদলেন এবং সবাইকে কাঁদালেন। কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। এভাবেই জীবন নদীর একপ্রান্ত ভেঙে অন্য প্রান্ত গড়ে ওঠে। সেদিন লাক্কাতুরা চা বাগানে দেলওয়ার মামাদের বাসায় বিকাল নাগাদ পৌঁছলাম এবং পরের দিন সকাল ন’টায় সুরমা মেইলে সিলেট থেকে চিটাগাং রওনা হলাম। তখনকার লক্করঝক্কর ট্রেন, আন্তঃনগর ট্রেন তখনো চালু হয়নি। ঝরঝক্কর ঝরঝক্কর ট্রেন চলতে চলতে তেরো ঘন্টা পরে চট্টগ্রাম ষ্টেশনে যখন পৌঁছলাম, তখন রাত দশটা। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছতে রাত এগারো। দেলওয়ার মামা তার ৩১৭ নং রুমে, তার বেডেই ডাবলিং করে থাকার ব্যবস্থা করলেন। তার সহযোগিতায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলাম। এই ৩১৭ নম্বর রুমই আমার রুম হলো। এই রুমের নাম আমি দিয়েছিলাম “বিদিশা”। শব্দটা জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতা থেকে সংগৃহিত। এখানে থেকেই আমি মাষ্টার্স শেষ করে বের হলাম। পরেরদিন বাড়িতে চিঠি লিখলাম, উত্তর আসলো পনরো দিন পরে। বাড়িতে টেলিফোনের সুযোগ নেই, যুগটা ও মোবাইলের না। যা হোক, সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করে ১৯৮০ইং সনের ১১ই সেপ্টেম্বর আমি নোয়াখালীর কবিরহাট কলেজে কলেজ শিক্ষকতায় প্রবেশ করি। নিয়োগপত্রে উল্লিখিত কলেজ প্রদত্ত আমার মাসিক বেতন ছিল সাকুল্যে ৪০০ টাকা। সরকারি একটা অনুদান ছিল বটে; কিন্তু সেটা অনিয়মিত ও অনিশ্চিতও বটে; চার পাঁচ মাস পরে পাওয়া যেতো”। (দ্বিকাল-দর্শীর ডাইরি)
শৈশব কৈশোর থেকে তিনি শিক্ষকতার আদর্শ নিয়েই বড় হয়ে ওঠেন। নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলেও মানুষ গড়ার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। গুণী শিক্ষক মামুনুর রশীদের দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর শিক্ষকতা জীবনের সফলতার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু অনেক গল্প থেকে যায়। তবে এই দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন গড়ার কারিগর তিনি। মামুনুর রশীদ জ্ঞানের আলো দ্বারা যুগের সব অন্ধকার দূর করে মানুষের জন্য সভ্য পৃথিবী সৃজন করে যাচ্ছেন। একজন সফল মানুষ গড়ার কারিগর মামুনুর রশীদের আগামীর দিনগুলো সুস্থ থাকুক- সেই কামনা করি।