নিজেদের উদ্যোগে অপরিচ্ছন্ন গণকবর এখন ফুলবাগান
- আপডেট সময় ০৭:১০:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ মার্চ ২০২৪
- / ৩৬৩ বার পড়া হয়েছে
পুলক পুরকায়স্থ// যেখানে ছিলো ময়লা-আবর্জনার স্তুপ, একটা সময়ে দুর্গন্ধে বাঁধাগ্রস্ত হতেন পথচারীরা। এখন সেখানেই শোভা ছড়াচ্ছে ফুলের বাগান। যেখানে ফুটে আছে নানান রঙের বাহারী ফুল।
একাত্তর সালে পাকবাহিনী মৌলভীবাজার শহরের অনেক মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে। সেই সময় শহরের বেরি লেকের দক্ষিণ পাড়ে তাদের কয়েকজনকে গণকবর দেওয়া হয়।
দীর্ঘদিন পর এই গণকবরের স্থানটিতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হলেও অযত্ন অবহেলা পড়ে ছিলো, ছিলো ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। আর এই গণকবর ও স্মৃতিসৌধের এই দুরাবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন খেটে খাওয়া দরিদ্র দুই ভাই।
তারা হলেন, মৌলভীবাজারের মো. সাইফুল মিয়া (৪৮) ও জাহাঙ্গীর হোসেন(৫০)। থাকেন পৌরশহরের দরগা মহল্লা এলাকায়।
দীর্ঘ আট বৎসর ধরে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় গণকবরের স্থানটি বিনা পারিশ্রমিকে নিজ উদ্যোগে পরিচর্যা করে আসছেন দুইভাই। তারা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন গণকবরের রক্ষণাবেক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ।
রবিবার (২৪ মার্চ) মৌলভীবাজার শহরের বেরি লেক এলাকার গণকবরে গিয়ে দেখা যায়, আপনমনে ফুল বাগানের পরিচর্যা করছেন মো. সাইফুল মিয়া।
আলাপকালে তিনি বলেন, মঙ্গলবার স্বাধীনতা দিবস। এখানে অনেক মানুষজন আসবেন। স্মৃতিসৌধ ধুয়ে-মুছে পরিষ্কারের কাজ শেষে এখন ফুল বাগানে পানি দিচ্ছি।
তিনি জানান, একটা সময় এই গণকবর সংলগ্ন উন্মুক্ত স্থানে আশপাশের দোকান ও বাসাবাড়ির আবর্জনা সেখানে ফেলা হতো, যা দেখে নিজের কাছে খুবই খারাপ লাগতো। পরে বড়ভাইকে সাথে নিয়ে এখানকার ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করেন। পরে গণকবরের জায়গায় জুড়ে এই ফুলের বাগানে নিজেদের টাকায় কেনা প্রথমে ১০টি গাঁদা ফুলের চারা রোপণ করেন। এরপর ধীরে ধীরে বাগানটি বড় করে বিভিন্ন জাতের গোলাপ, জবা, গন্ধরাজসহ কয়েক জাতের ফুলের গাছ রোপণ করা হয়। বর্তমানে বাগানে প্রায় ১৫ জাতের গোলাপসহ জবা, গন্ধরাজ, কামিনী, ডালিয়া ফুলের অর্ধশতাধিক গাছ রয়েছে। কোনো কোনো চারা ১৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করে কিনতে হয়েছে। তাছাড়াও আমড়া, বরই, কাঁঠাল, বিলম্বি, নিম প্রভৃতি গাছসহ শত ফুলগাছের বাগানে পরিণত হয়েছে গণকবরের স্থানটি।
কেউ কোন পারিশ্রমিক দেন না জানিয়ে মো. সাইফুল মিয়া বলেন, এখানে যতগুলো গাছ আছে সবই আমাদের টাকায় কেনা, এমনকি কয়েকদিন আগে পানির পাইপ কিনেছি।
মো. সাইফুল মিয়া সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রিকশা চালান, পরে বিকেলের দিকে গণকবরের পার্শ্বে ভ্যানগাড়িতে বাদাম বিক্রি করেন জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তবে বড়দের কাছে শুনে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও ভালবাসা জমে মনের মধ্যে। সেই থেকেই আমার এলাকার এই গণকবরের জায়গাটির যত্নআত্তি করছি।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীর হোসেন রিকশা চালানোর পাশাপাশি ঝালমুড়ি ও চটপটি বিক্রি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো রকমে দিনাতিপাত করছেন।
তিনি বলেন, এই স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের কটু কথা শুনতে হয়েছে। মানুষের এসব কটুকথা গায়ে না মেখে প্রায় আট বছর ধরে এ স্থানটি আমরা পরিচর্যা করছি। যতদিন শরীরে সয় ততদিন পরিচর্যা করে যাব।
তাদের অল্প আয়ের একটা অংশ বাঁচিয়ে ফুলের চারা, ওষুধ ক্রয়সহ অন্যান্য খরচ বহন করছেন বলে তিনি জানান।
স্থানীয় পরিবেশ কর্মি সোনিয়া মান্নান বলেন, এরা দরিদ্র হলেও উনাদের চেতনা অনেক উঁচু এবং মনটা বিশাল। এই কর্মযজ্ঞ দেখে আমাদের শেখা উচিত এবং উনাদের সম্মান জানানো উচিত।
মৌলভীবাজার শহরকে ফুলের শহর গড়তে কাজ করছেন শিক্ষাবিদ আব্দুল খালিক। তিনি বলেন, আমরা যারা শহরের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য কাজ করি, সবাই মিলে তাদের কাজের সাথে একাত্ম হব। পৌর মেয়রের সাথে আলাপ করে তাদেরকে সহযোগিতার পাশাপাশি এই ফুল বাগানকে আরও প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করা যায় তা করা হবে।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিন জানান, গণকবর ও স্মৃতিসৌধ ঘিরে যে কাজ এই মানুষগুলো করছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।