ঢাকা ০১:১৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত অধস্তন আদালতের কর্মচারীবৃন্দ

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৮:৩৮:৪৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৮৮৭ বার পড়া হয়েছে

৩(তিন) দফা দাবী

১। দেশের অধঃস্তন আদালতে কর্মরত কর্মচারীগণকে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করতঃ বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেলের আলোকে বেতন ও ভাতা প্রদান।

২। সকল ব্লক পদ বিলুপ্ত করে যুগোপযোগী পদ সৃজনপূর্বক মহামান্য হাইকোর্ট ও মন্ত্রণালয়ের ন্যায় যোগ্যতা ও জ্যৈষ্ঠতার ক্রমানুসারে প্রতি ০৫ বছর অন্তর অন্তর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদোন্নতি ও উচ্চতর গ্রেড প্রদান।

৩। অধঃস্তন আদালতের কর্মচারীদের জন্য এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন।

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিচার বিভাগ একটি অপরিহার্য অংশ। আদালতের যাবতীয় কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন করার নিমিত্তে বিচারক ও আইনজীবীদের পাশাপাশি সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতাদি এবং সামাজিক মর্যাদা নিয়ে কোনো সরকার কখনোই গুরুত্ব দেননি। অনেকের ধারণা, আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে বেতন-ভাতা পান তা অন্যান্য দপ্তর থেকে বেশী এবং এখানে বাড়তি আয়েরও ব্যবস্থা আছে। বস্তুত কথাটি সত্য নয় এবং অযৌক্তিকও বটে। এখনো অনেক সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন যারা বেতন-ভাতার বাইরে একটি টাকাও ভিন্নভাবে আয়ের চিন্তা করেন না, তারা মানবেতর জীবনযাপন করেন। আবার অনেকেই হয়তো নিরুপায় হয়ে সংসারের টানাপোড়নে বাড়তি আয়ের পথ বেছে নেন। আজকের লেখা মূলত আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানান বৈষম্যের বিষয়ে আলোকপাত করা।

আগেই বলেছি, বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে অধস্তন আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিচারকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে থাকেন আইন মন্ত্রণালয়-হাইকোর্ট বিভাগের অনুমতিক্রমে; সহায়ক কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে থাকেন আইন মন্ত্রণালয়, বদলি করে থাকেন হাইকোর্ট বিভাগ এবং অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান করেন জেলা জজ। আবার সহায়ক কর্মচারীদের আন্তঃজেলা বদলি করেন হাইকোর্ট বিভাগ। আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করা হলেও নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক পে-স্কেল করা হলেও সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উক্ত পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এক কথায়, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর বিচারকদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, বিপরীতে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিচারকদের জন্য বিচারিক ভাতা থাকলেও সহায়ক কর্মচারীদের জন্য উক্ত ভাতা নেই। এমনিভাবে নানা প্রকারের বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ঠ নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা।

২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর থেকেই বিচার বিভাগের একটা অংশ বৈষম্য ও বঞ্চনায় গুমরে কাঁদছে। বর্তমানেও বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিসহ ৩(তিন) দফা দাবিতে এই কর্মচারীরা সংগঠিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু কোন সরকার এদিকে দৃষ্টিপাত করছেন না। অথচ তাঁদের দাবীগুলো অত্যন্ত ন্যায্য ও খুবই যৌক্তিক।

বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার জেলা কার্যনির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মৌলভীবাজার জেলা জজ আদালতের অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর মোঃ আব্দুল মুমিন রনি বলেন, দেশে ২০ হাজারের মতো আদালত-সহায়ক কর্মচারীবৃন্দ রয়েছেন-যারা ত্রিমুখী কর্তৃত্বের যাঁতাকলে বহুদিন যাবৎ পিষ্ঠ হচ্ছেন। আদালতের কর্মচারীরা বিচারিক কাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অতি আবশ্যক হলেও পরিতাপের বিষয় এই যে, এসব কর্মচারীদের আজ অবধি বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের বাংলাদেশ বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে গণ্য করে বেতন ভাতা নির্ধারণ করার; শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদোন্নতি ও উচ্চতর গ্রেড প্রদানের এবং একই সঙ্গে অধস্তন আদালতের সব কর্মচারীবৃন্দের জন্য এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ণের জোর দাবী জানান।

তিনি আরো বলেন, আদালতের এসব কর্মচারীর বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধাও খুব একটা নেই। একই যোগ্যতার অন্য দপ্তরের একজন কর্মচারী তাদের দ্বিগুণ বেতন পেয়ে থাকেন। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আপ্যায়ন ভাতাসহ পদোন্নতি ও যাবতীয় সুবিধা সমহারে পেয়ে থাকেন। পুলিশ বিভাগে কর্মরত কনস্টেবল থেকে শুরু করে অফিসাররা উভয়েই ৩০ শতাংশ ঝুঁকি ভাতা, রেশন, পদোন্নতিসহ যাবতীয় সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীদের মধ্যে বিপরীত বৈষম্য রয়েছে। আবার বিচারকরা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর পাশাপাশি দেওয়ানি আদালতের অবকাশকালীন (ডিসেম্বর মাস) সময়ে ফৌজদারি আদালতে দায়িত্ব পালনের জন্য এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত ভাতাপ্রাপ্ত হন এবং প্রতি মাসেই বিচারিক ভাতা হিসেবে মূল বেতনের ৩০ শতাংশ প্রাপ্ত হন, কিন্তু একইভাবে অবকাশকালীন ছুটিতে দায়িত্ব পালন করা কর্মচারীরা বিচার সহায়ক কোন ভাতা পান না। এমনকি চৌকি আদালতের বিচারক চৌকি ভাতাপ্রাপ্ত হন, কিন্তু উক্ত চৌকি আদালতে কর্মরত সহায়ক কর্মচারীরা চৌকি ভাতাপ্রাপ্ত হন না। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে সমন জারির সাথে সম্পৃক্ত জারীকারকদের সমন জারির জন্য দূর-দূরান্তে যেতে হয়। তাদের টিএ দেয়ার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে এই খাতে বরাদ্দ না পাওয়ায় কোনো ধরনের টিএ/ডিএ প্রদান করা হয় না। বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীদের পদ-পদবীর নাম পরিবর্তন পূর্বক উচ্চতর স্কেলে পদায়ন করা হলেও বিচার বিভাগে কর্মরত সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দিন দিন মামলার পরিমাণ অধিক হওয়ায় দিনের কাজ দিনে শেষ করার জন্য সহায়ক কর্মচারীদের প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩-৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়। এ বিষয়েও কোনো ওভারটাইম বা ভাতা প্রদান করা হয় না।

তিনি আরো জানান, আদালতের কর্মচারীরা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সমাজে বিবেচিত হন। কিন্তু বেশিরভাগ কর্মচারী আর্থিকভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। একটা সময় আদালতের উচ্চমান সহকারী (সেরেস্তাদার) দের মর্যাদা এমন ছিল যে তারা অফিসার্স ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ের জাতীয় বেতন-স্কেল হতে দেখা যায়, বর্তমানে কিছু সংখ্যক দ্বিতীয় শ্রেণির পদ যেমন- উপ-সহকারী প্রকৌশলী, অডিটর, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল সেরেস্তাদারের নিচে ছিল-যা বর্তমানে সেরেস্তাদারের বেতন স্কেলের দ্বিগুণ। অপরদিকে বিচার বিভাগের কর্মচারীদের পদোন্নতির যেটুকু ব্যবস্থা রয়েছে, তার চেয়ে ব্লক পদের সংখ্যাই বেশি। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশনের কার্যক্রম চলমান থাকলেও প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য জনবল অপ্রতুল। বিচার বিভাগীয় বাতায়ন পরিচালনা ও মামলার কার্যতালিকার কার্যক্রম দৈনন্দিন হালনাগাদ করতে প্রযুক্তিনির্ভর জনবল আবশ্যক। তা না হলে ডিজিটালাইজেশনের এই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। পদোন্নতির ধারা উন্মোচনসহ নতুন পদ সৃজন না করায় অধিকাংশ কর্মচারীদের পদোন্নতির পদ রুদ্ধ। অন্যান্য দপ্তরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির জন্য যেখানে ফিডার পদে ৫ থেকে ৭ বছরের চাকরি অভিজ্ঞতায় পদোন্নতির সুযোগ আছে, সেখানে অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের উক্ত পদের জন্য ২০ থেকে ২২ বছর অপেক্ষা করতে হয়। অনেকেরই পদোন্নতির আগে চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আক্ষেপ ও হতাশা নিয়ে বৈষম্যের শিকার অধস্তন আদালতের কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন। দ্রুততম সময়ে নিয়োগবিধি সংশোধনের অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও নিয়োগ বাণিজ্যসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় ব্যস্ত আইন মন্ত্রণালয় দীর্ঘ ৯ বছরেও অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের নিয়োগবিধি সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত করতে পারেননি। শুধু আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন, দীর্ঘদিনেও তা আলোর মুখ দেখেনি। কর্মচারীদের দাবী বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমিকে উল্লেখিত পদক্ষেপ নেয়া হয়-(১) গত ২৯.০৭.২০১৯ খ্রিঃ তারিখে যথাযথ কর্তৃপক্ষের (নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ) মাধ্যমে মাননীয় সচিব, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রাণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়; (২) বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গত ১৮.০৯.২০১৯ খ্রিঃ তারিখে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে তিন দফা দাবি বিষয়ে অবগত করানো হয়; (৩) গত ১১.১১.২০১৯ খ্রিঃ তারিখে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর তিন দফা দাবী সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। উক্ত ৩(তিন) দফা দাবী দ্রুত বাস্তবায়ন করা না হলে অচিরেই মানববন্ধন, পেন ডাউন, কর্মবিরতিসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। বর্তমানে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে সরকারি দপ্তরের অনেকেই নানারকম দাবি-দাওয়া তুলছেন। এর অধিকাংশই প্রমোশন না হওয়া, বেতন বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত। যেহেতু আমি আদালতের একজন কর্মচারী তার জন্য বিচার বিভাগের কথাই বললাম।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উক্ত দাবিসমূহ থেকেও সবচেয়ে যৌক্তিক দাবি হওয়া উচিত- প্রথমত, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ করলে ওভারটাইম চালু করা। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর বিধান অনুযায়ী কোনো শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো দিন বা সপ্তাহে আইনের অধীন নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করলে, অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য নির্ধারিত বেতনের দ্বিগুণ হারে ভাতা (ওভারটাইম) পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু, একজন চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে অন্যান্য সব বিষয় শ্রম আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকলেও ওভার টাইমের প্রচলন নেই। ওভার টাইম চালু হলে, বাধ্যতামূলক লেট সিটিং ও ঘুষ প্রথা কমে আসবে বলে আশা করা যায়। দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগ শুধু হাইকোর্ট আর নিম্ন আদালতের অফিসার নিয়ে গঠন করা হয়েছে এমনটি নয়, স্টাফ ব্যতীত পরিপূর্ণভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই বিচারকদের পাশাপাশি সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতঃ সকল বৈষম্য দূর করে নতুন এক বিচার বিভাগ তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত, বিচার বিভাগের নিয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তন করে আধুনিক এবং দক্ষ জনশক্তি দিয়ে বিচার বিভাগের পরিবর্তন ঘটানো আবশ্যক। পরিশেষে বলবো, বৈষ্যম্যবিরোধী বর্তমান সরকারের মাধ্যমে বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত অধস্তন আদালতের কর্মচারীবৃন্দের বহুদিনের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে-এটাই আমার প্রত্যাশা।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত অধস্তন আদালতের কর্মচারীবৃন্দ

আপডেট সময় ০৮:৩৮:৪৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৪

৩(তিন) দফা দাবী

১। দেশের অধঃস্তন আদালতে কর্মরত কর্মচারীগণকে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করতঃ বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেলের আলোকে বেতন ও ভাতা প্রদান।

২। সকল ব্লক পদ বিলুপ্ত করে যুগোপযোগী পদ সৃজনপূর্বক মহামান্য হাইকোর্ট ও মন্ত্রণালয়ের ন্যায় যোগ্যতা ও জ্যৈষ্ঠতার ক্রমানুসারে প্রতি ০৫ বছর অন্তর অন্তর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদোন্নতি ও উচ্চতর গ্রেড প্রদান।

৩। অধঃস্তন আদালতের কর্মচারীদের জন্য এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন।

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বিচার বিভাগ একটি অপরিহার্য অংশ। আদালতের যাবতীয় কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন করার নিমিত্তে বিচারক ও আইনজীবীদের পাশাপাশি সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতাদি এবং সামাজিক মর্যাদা নিয়ে কোনো সরকার কখনোই গুরুত্ব দেননি। অনেকের ধারণা, আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে বেতন-ভাতা পান তা অন্যান্য দপ্তর থেকে বেশী এবং এখানে বাড়তি আয়েরও ব্যবস্থা আছে। বস্তুত কথাটি সত্য নয় এবং অযৌক্তিকও বটে। এখনো অনেক সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন যারা বেতন-ভাতার বাইরে একটি টাকাও ভিন্নভাবে আয়ের চিন্তা করেন না, তারা মানবেতর জীবনযাপন করেন। আবার অনেকেই হয়তো নিরুপায় হয়ে সংসারের টানাপোড়নে বাড়তি আয়ের পথ বেছে নেন। আজকের লেখা মূলত আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানান বৈষম্যের বিষয়ে আলোকপাত করা।

আগেই বলেছি, বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে অধস্তন আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিচারকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে থাকেন আইন মন্ত্রণালয়-হাইকোর্ট বিভাগের অনুমতিক্রমে; সহায়ক কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে থাকেন আইন মন্ত্রণালয়, বদলি করে থাকেন হাইকোর্ট বিভাগ এবং অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান করেন জেলা জজ। আবার সহায়ক কর্মচারীদের আন্তঃজেলা বদলি করেন হাইকোর্ট বিভাগ। আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করা হলেও নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক পে-স্কেল করা হলেও সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উক্ত পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এক কথায়, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর বিচারকদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, বিপরীতে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিচারকদের জন্য বিচারিক ভাতা থাকলেও সহায়ক কর্মচারীদের জন্য উক্ত ভাতা নেই। এমনিভাবে নানা প্রকারের বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ঠ নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা।

২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর থেকেই বিচার বিভাগের একটা অংশ বৈষম্য ও বঞ্চনায় গুমরে কাঁদছে। বর্তমানেও বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিসহ ৩(তিন) দফা দাবিতে এই কর্মচারীরা সংগঠিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু কোন সরকার এদিকে দৃষ্টিপাত করছেন না। অথচ তাঁদের দাবীগুলো অত্যন্ত ন্যায্য ও খুবই যৌক্তিক।

বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার জেলা কার্যনির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মৌলভীবাজার জেলা জজ আদালতের অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার অপারেটর মোঃ আব্দুল মুমিন রনি বলেন, দেশে ২০ হাজারের মতো আদালত-সহায়ক কর্মচারীবৃন্দ রয়েছেন-যারা ত্রিমুখী কর্তৃত্বের যাঁতাকলে বহুদিন যাবৎ পিষ্ঠ হচ্ছেন। আদালতের কর্মচারীরা বিচারিক কাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অতি আবশ্যক হলেও পরিতাপের বিষয় এই যে, এসব কর্মচারীদের আজ অবধি বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের বাংলাদেশ বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে গণ্য করে বেতন ভাতা নির্ধারণ করার; শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদোন্নতি ও উচ্চতর গ্রেড প্রদানের এবং একই সঙ্গে অধস্তন আদালতের সব কর্মচারীবৃন্দের জন্য এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ণের জোর দাবী জানান।

তিনি আরো বলেন, আদালতের এসব কর্মচারীর বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধাও খুব একটা নেই। একই যোগ্যতার অন্য দপ্তরের একজন কর্মচারী তাদের দ্বিগুণ বেতন পেয়ে থাকেন। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আপ্যায়ন ভাতাসহ পদোন্নতি ও যাবতীয় সুবিধা সমহারে পেয়ে থাকেন। পুলিশ বিভাগে কর্মরত কনস্টেবল থেকে শুরু করে অফিসাররা উভয়েই ৩০ শতাংশ ঝুঁকি ভাতা, রেশন, পদোন্নতিসহ যাবতীয় সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীদের মধ্যে বিপরীত বৈষম্য রয়েছে। আবার বিচারকরা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর পাশাপাশি দেওয়ানি আদালতের অবকাশকালীন (ডিসেম্বর মাস) সময়ে ফৌজদারি আদালতে দায়িত্ব পালনের জন্য এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত ভাতাপ্রাপ্ত হন এবং প্রতি মাসেই বিচারিক ভাতা হিসেবে মূল বেতনের ৩০ শতাংশ প্রাপ্ত হন, কিন্তু একইভাবে অবকাশকালীন ছুটিতে দায়িত্ব পালন করা কর্মচারীরা বিচার সহায়ক কোন ভাতা পান না। এমনকি চৌকি আদালতের বিচারক চৌকি ভাতাপ্রাপ্ত হন, কিন্তু উক্ত চৌকি আদালতে কর্মরত সহায়ক কর্মচারীরা চৌকি ভাতাপ্রাপ্ত হন না। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে সমন জারির সাথে সম্পৃক্ত জারীকারকদের সমন জারির জন্য দূর-দূরান্তে যেতে হয়। তাদের টিএ দেয়ার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে এই খাতে বরাদ্দ না পাওয়ায় কোনো ধরনের টিএ/ডিএ প্রদান করা হয় না। বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীদের পদ-পদবীর নাম পরিবর্তন পূর্বক উচ্চতর স্কেলে পদায়ন করা হলেও বিচার বিভাগে কর্মরত সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দিন দিন মামলার পরিমাণ অধিক হওয়ায় দিনের কাজ দিনে শেষ করার জন্য সহায়ক কর্মচারীদের প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩-৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়। এ বিষয়েও কোনো ওভারটাইম বা ভাতা প্রদান করা হয় না।

তিনি আরো জানান, আদালতের কর্মচারীরা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সমাজে বিবেচিত হন। কিন্তু বেশিরভাগ কর্মচারী আর্থিকভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। একটা সময় আদালতের উচ্চমান সহকারী (সেরেস্তাদার) দের মর্যাদা এমন ছিল যে তারা অফিসার্স ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ের জাতীয় বেতন-স্কেল হতে দেখা যায়, বর্তমানে কিছু সংখ্যক দ্বিতীয় শ্রেণির পদ যেমন- উপ-সহকারী প্রকৌশলী, অডিটর, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল সেরেস্তাদারের নিচে ছিল-যা বর্তমানে সেরেস্তাদারের বেতন স্কেলের দ্বিগুণ। অপরদিকে বিচার বিভাগের কর্মচারীদের পদোন্নতির যেটুকু ব্যবস্থা রয়েছে, তার চেয়ে ব্লক পদের সংখ্যাই বেশি। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশনের কার্যক্রম চলমান থাকলেও প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য জনবল অপ্রতুল। বিচার বিভাগীয় বাতায়ন পরিচালনা ও মামলার কার্যতালিকার কার্যক্রম দৈনন্দিন হালনাগাদ করতে প্রযুক্তিনির্ভর জনবল আবশ্যক। তা না হলে ডিজিটালাইজেশনের এই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। পদোন্নতির ধারা উন্মোচনসহ নতুন পদ সৃজন না করায় অধিকাংশ কর্মচারীদের পদোন্নতির পদ রুদ্ধ। অন্যান্য দপ্তরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির জন্য যেখানে ফিডার পদে ৫ থেকে ৭ বছরের চাকরি অভিজ্ঞতায় পদোন্নতির সুযোগ আছে, সেখানে অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের উক্ত পদের জন্য ২০ থেকে ২২ বছর অপেক্ষা করতে হয়। অনেকেরই পদোন্নতির আগে চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আক্ষেপ ও হতাশা নিয়ে বৈষম্যের শিকার অধস্তন আদালতের কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন। দ্রুততম সময়ে নিয়োগবিধি সংশোধনের অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও নিয়োগ বাণিজ্যসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় ব্যস্ত আইন মন্ত্রণালয় দীর্ঘ ৯ বছরেও অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের নিয়োগবিধি সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত করতে পারেননি। শুধু আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন, দীর্ঘদিনেও তা আলোর মুখ দেখেনি। কর্মচারীদের দাবী বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ক্রমিকে উল্লেখিত পদক্ষেপ নেয়া হয়-(১) গত ২৯.০৭.২০১৯ খ্রিঃ তারিখে যথাযথ কর্তৃপক্ষের (নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ) মাধ্যমে মাননীয় সচিব, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রাণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়; (২) বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গত ১৮.০৯.২০১৯ খ্রিঃ তারিখে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়কে তিন দফা দাবি বিষয়ে অবগত করানো হয়; (৩) গত ১১.১১.২০১৯ খ্রিঃ তারিখে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর তিন দফা দাবী সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। উক্ত ৩(তিন) দফা দাবী দ্রুত বাস্তবায়ন করা না হলে অচিরেই মানববন্ধন, পেন ডাউন, কর্মবিরতিসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। বর্তমানে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে সরকারি দপ্তরের অনেকেই নানারকম দাবি-দাওয়া তুলছেন। এর অধিকাংশই প্রমোশন না হওয়া, বেতন বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত। যেহেতু আমি আদালতের একজন কর্মচারী তার জন্য বিচার বিভাগের কথাই বললাম।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উক্ত দাবিসমূহ থেকেও সবচেয়ে যৌক্তিক দাবি হওয়া উচিত- প্রথমত, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ করলে ওভারটাইম চালু করা। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর বিধান অনুযায়ী কোনো শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো দিন বা সপ্তাহে আইনের অধীন নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করলে, অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য নির্ধারিত বেতনের দ্বিগুণ হারে ভাতা (ওভারটাইম) পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু, একজন চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে অন্যান্য সব বিষয় শ্রম আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকলেও ওভার টাইমের প্রচলন নেই। ওভার টাইম চালু হলে, বাধ্যতামূলক লেট সিটিং ও ঘুষ প্রথা কমে আসবে বলে আশা করা যায়। দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগ শুধু হাইকোর্ট আর নিম্ন আদালতের অফিসার নিয়ে গঠন করা হয়েছে এমনটি নয়, স্টাফ ব্যতীত পরিপূর্ণভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই বিচারকদের পাশাপাশি সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতঃ সকল বৈষম্য দূর করে নতুন এক বিচার বিভাগ তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত, বিচার বিভাগের নিয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তন করে আধুনিক এবং দক্ষ জনশক্তি দিয়ে বিচার বিভাগের পরিবর্তন ঘটানো আবশ্যক। পরিশেষে বলবো, বৈষ্যম্যবিরোধী বর্তমান সরকারের মাধ্যমে বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত অধস্তন আদালতের কর্মচারীবৃন্দের বহুদিনের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে-এটাই আমার প্রত্যাশা।