ঢাকা ০৬:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মৌলভীবাজারে দুর্গাপূজার আয়োজনে দুর্নীতি..উৎকোচ দিয়ে ছয় দিনের চাকরিতে আনসাররা

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৪:৩৯:৩৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর ২০২২
  • / ৪৮১ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজারে শারদীয় দূর্গাপূজায় আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের কাছ থেকে অন্তত ২৪ লক্ষ টাকার উৎকোচ আদায় করছে একটি চক্র। এ চক্রের সাথে মৌলভীবাজার আনসার ভিডিপির কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ আনসার সদস্যরাও জড়িত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্যেক আনসার সদস্য উৎকোচ দিয়ে ৬ দিনের চাকুরিতে ঢুকতে হয়েছে। আবার একই ব্যক্তির নাম একাধিক পূজামন্ডপে দেয়া হয়েছে। অনেক পূজা মন্ডপে ৪জন আনসার সদস্যকে নিয়োগ দিলেও দায়িত্ব পালন করছেন ২জন। তালিকায় গড়মিল সৃষ্টি করার জন্য মোবাইল নম্বর ও নামে ইচ্ছাকৃত ভুল করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টদের এমন বাণিজ্যে ক্ষুব্ধ আনসার সদস্যরা।

জেলা আনসার ভিডিপির কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর পুরো জেলায় ১ হাজার ৬টি মন্ডপে দূর্গাপুজা হচ্ছে। পূজামন্ডপের গুরুত্ব অনুযায়ী ৮, ৬ ও ৪ জন করে পুরো জেলায় ৪ হাজার ৮’শ ২২ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৬ দিনের চাকুরিতে ঢুকার জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে উৎকোচ নেয়া হয়েছে ৭’শ থেকে শুরু করে ৩’শ টাকা পর্যন্ত। আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা চাকুরি করার নিয়ম থাকলেও অনেক প্রশিক্ষণ বিহীন ব্যক্তিকেও টাকার বিনিময়ে চাকুরি দেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে বড় অংকের টাকা। আবার কারো দায়িত্ব এক পূজা মন্ডপে থাকলেও কাজ করছেন অন্য জায়গায়।
সরেজমিন মৌলভীবাজার পৌর শহরের চাঁদনীঘাট ব্রীজের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের পার্শ্ববর্তী পূজামন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্য মোঃ ইমাদ মিয়া, সাহেদা ও সুবর্ণা’র সাথে কথা হলে তারা টাকা দিয়ে চাকুরিতে প্রবেশের কথা স্বীকার করেন। তারা ওই টাকা সদর উপজেলা আনসার অফিসের স্টাফ শিবলীর কাছে দিয়েছেন বলে প্রতিবেদককে জানান। এসময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য বলেন, ইমরান নামে এক আনসার সদস্য কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় তাকে চাকুরি দেয়া হয়নি। সেন্ট্রাল রোডের কালিবাড়ি মন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী দুলাল মিয়া, রফিক মিয়া এবং কাশীনাথ স্কুল মাঠের মন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী মোঃ সজল মিয়া বলেন, নারী নেত্রী হনুফা বেগমের স্বামী রুনু মিয়ার কাছে ৭’শত টাকা দিয়ে ৬ দিনের চাকুরি নিয়েছি। পৌর শহরের ক্লাব রোডের মন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী শ্রীমঙ্গল উপজেলার জমসেদ মিয়া বলেন, ৬ দিনের চাকুরির জন্য শ্রীমঙ্গল উপজেলা আনসার ভিডিপি কার্যালয়ের বিউটি বেগমকে ৬’শত টাকা দিতে হয়েছে। রাজনগর বাজার পূজা মন্ডপের দায়িত্বরত আনসার সদস্য দেলোয়ার, রুশিয়ারা ও রাশিয়া বেগম বলেন, ৬ দিনের চাকুরির জন্য ওয়াহিদ মিয়াকে ঘুষ দিতে হয়েছে। ওই মন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী সুমন ও রাজন বলেন, ৬ দিনের কাজের বিনিময়ে আমাদেরকে ১৫’শত টাকা দেয়া হবে বলে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু সরকার থেকে আমাদের নামে কত টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জানিনা।

এদিকে রাজনগর উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিস এক আদেশে বলা হয়েছে সৈয়দনগর ও দক্ষিণ চাটুরা সার্বজনীন দুর্গামন্ডপে এপিসি হিসেবে মোঃ ছাবুল মিয়া, সদস্য হিসেবে করুনা মালাকার, চায়না বেগম ও হাজেরা বেগম দায়িত্ব পালন করবেন। তালিকায় দেয়া চায়না বেগমের মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে তার স্বামী মুহিত মিয়া ফোন রিসিভ করে জানা, চায়না ও হাজেরা কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা দুজনই চাকুরির জন্য রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর গ্রামের আদরকে ৫’শ টাকা করে ঘুষ দিয়েছেন। তালিকায় দেয়া চায়না বেগমের মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে রিসিভ করেন আব্দুর রকিব। তিনি চায়না বেগম নামে কাউকে ছিনেননি বলে প্রতিবেদককে জানান। আব্দুর রকিব রাজনগর উপজেলার সুজিত মালাকারের বাড়িতে দায়িত্ব পালন করছেন। একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সৈয়দনগর ও দক্ষিণ চাটুরা সার্বজনীন দুর্গামন্ডপে এপিসি হিসেবে মোঃ ছাবুল মিয়া’র সাথে মসুদ, সুরমা ও কামাল নামের ৩জন দায়িত্ব পালন করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এমন চিত্র পুরো জেলার।

একাধিক এপিসি ও আনসার সদস্য শারদীয় দূর্গাপূজার আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার চাকুরিতে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করে প্রতিবেদককে বলেন, নির্বাচন এবং অন্যান্য ডিউটিতেও নাম ঢুকানোর জন্য অফিসে ঘুষ দিতে হয়।
নাম গোপন রাখার শর্তে রাজনগর উপজেলার এক ইউপি সদস্য বলেন, “আমার ইউনিয়নের প্রত্যেক আনসার সদস্যের কাছ থেকে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিসের স্টাফরা ৫’শত টাকা ঘুষ নিয়েছে এবং ৪জনের জায়গায় ২জন দিয়ে দায়িত্ব পালন করানো হয়েছে। অন্য এক ইউপি সদস্য বলেন, আমার ওয়ার্ডের মন্ডপে ৪জনের জায়গায় ১জন দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রত্যেক আনসার সদস্যের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা হয়েছে।

এবিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা আনসার ও ভিডিপির কমান্ড্যান্ড মোঃ সেফাউল হোসেন বলেন, আনসার সদস্যদের কাছ থেকে যারা ঘুষ আদায় করেছেন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

মৌলভীবাজারে দুর্গাপূজার আয়োজনে দুর্নীতি..উৎকোচ দিয়ে ছয় দিনের চাকরিতে আনসাররা

আপডেট সময় ০৪:৩৯:৩৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর ২০২২

বিশেষ প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজারে শারদীয় দূর্গাপূজায় আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের কাছ থেকে অন্তত ২৪ লক্ষ টাকার উৎকোচ আদায় করছে একটি চক্র। এ চক্রের সাথে মৌলভীবাজার আনসার ভিডিপির কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সাধারণ আনসার সদস্যরাও জড়িত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রত্যেক আনসার সদস্য উৎকোচ দিয়ে ৬ দিনের চাকুরিতে ঢুকতে হয়েছে। আবার একই ব্যক্তির নাম একাধিক পূজামন্ডপে দেয়া হয়েছে। অনেক পূজা মন্ডপে ৪জন আনসার সদস্যকে নিয়োগ দিলেও দায়িত্ব পালন করছেন ২জন। তালিকায় গড়মিল সৃষ্টি করার জন্য মোবাইল নম্বর ও নামে ইচ্ছাকৃত ভুল করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টদের এমন বাণিজ্যে ক্ষুব্ধ আনসার সদস্যরা।

জেলা আনসার ভিডিপির কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর পুরো জেলায় ১ হাজার ৬টি মন্ডপে দূর্গাপুজা হচ্ছে। পূজামন্ডপের গুরুত্ব অনুযায়ী ৮, ৬ ও ৪ জন করে পুরো জেলায় ৪ হাজার ৮’শ ২২ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৬ দিনের চাকুরিতে ঢুকার জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে উৎকোচ নেয়া হয়েছে ৭’শ থেকে শুরু করে ৩’শ টাকা পর্যন্ত। আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা চাকুরি করার নিয়ম থাকলেও অনেক প্রশিক্ষণ বিহীন ব্যক্তিকেও টাকার বিনিময়ে চাকুরি দেয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে বড় অংকের টাকা। আবার কারো দায়িত্ব এক পূজা মন্ডপে থাকলেও কাজ করছেন অন্য জায়গায়।
সরেজমিন মৌলভীবাজার পৌর শহরের চাঁদনীঘাট ব্রীজের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের পার্শ্ববর্তী পূজামন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্য মোঃ ইমাদ মিয়া, সাহেদা ও সুবর্ণা’র সাথে কথা হলে তারা টাকা দিয়ে চাকুরিতে প্রবেশের কথা স্বীকার করেন। তারা ওই টাকা সদর উপজেলা আনসার অফিসের স্টাফ শিবলীর কাছে দিয়েছেন বলে প্রতিবেদককে জানান। এসময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য বলেন, ইমরান নামে এক আনসার সদস্য কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় তাকে চাকুরি দেয়া হয়নি। সেন্ট্রাল রোডের কালিবাড়ি মন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী দুলাল মিয়া, রফিক মিয়া এবং কাশীনাথ স্কুল মাঠের মন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী মোঃ সজল মিয়া বলেন, নারী নেত্রী হনুফা বেগমের স্বামী রুনু মিয়ার কাছে ৭’শত টাকা দিয়ে ৬ দিনের চাকুরি নিয়েছি। পৌর শহরের ক্লাব রোডের মন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী শ্রীমঙ্গল উপজেলার জমসেদ মিয়া বলেন, ৬ দিনের চাকুরির জন্য শ্রীমঙ্গল উপজেলা আনসার ভিডিপি কার্যালয়ের বিউটি বেগমকে ৬’শত টাকা দিতে হয়েছে। রাজনগর বাজার পূজা মন্ডপের দায়িত্বরত আনসার সদস্য দেলোয়ার, রুশিয়ারা ও রাশিয়া বেগম বলেন, ৬ দিনের চাকুরির জন্য ওয়াহিদ মিয়াকে ঘুষ দিতে হয়েছে। ওই মন্ডপে দায়িত্ব পালনকারী সুমন ও রাজন বলেন, ৬ দিনের কাজের বিনিময়ে আমাদেরকে ১৫’শত টাকা দেয়া হবে বলে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু সরকার থেকে আমাদের নামে কত টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জানিনা।

এদিকে রাজনগর উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিস এক আদেশে বলা হয়েছে সৈয়দনগর ও দক্ষিণ চাটুরা সার্বজনীন দুর্গামন্ডপে এপিসি হিসেবে মোঃ ছাবুল মিয়া, সদস্য হিসেবে করুনা মালাকার, চায়না বেগম ও হাজেরা বেগম দায়িত্ব পালন করবেন। তালিকায় দেয়া চায়না বেগমের মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে তার স্বামী মুহিত মিয়া ফোন রিসিভ করে জানা, চায়না ও হাজেরা কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা দুজনই চাকুরির জন্য রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর গ্রামের আদরকে ৫’শ টাকা করে ঘুষ দিয়েছেন। তালিকায় দেয়া চায়না বেগমের মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে রিসিভ করেন আব্দুর রকিব। তিনি চায়না বেগম নামে কাউকে ছিনেননি বলে প্রতিবেদককে জানান। আব্দুর রকিব রাজনগর উপজেলার সুজিত মালাকারের বাড়িতে দায়িত্ব পালন করছেন। একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সৈয়দনগর ও দক্ষিণ চাটুরা সার্বজনীন দুর্গামন্ডপে এপিসি হিসেবে মোঃ ছাবুল মিয়া’র সাথে মসুদ, সুরমা ও কামাল নামের ৩জন দায়িত্ব পালন করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এমন চিত্র পুরো জেলার।

একাধিক এপিসি ও আনসার সদস্য শারদীয় দূর্গাপূজার আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার চাকুরিতে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করে প্রতিবেদককে বলেন, নির্বাচন এবং অন্যান্য ডিউটিতেও নাম ঢুকানোর জন্য অফিসে ঘুষ দিতে হয়।
নাম গোপন রাখার শর্তে রাজনগর উপজেলার এক ইউপি সদস্য বলেন, “আমার ইউনিয়নের প্রত্যেক আনসার সদস্যের কাছ থেকে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিসের স্টাফরা ৫’শত টাকা ঘুষ নিয়েছে এবং ৪জনের জায়গায় ২জন দিয়ে দায়িত্ব পালন করানো হয়েছে। অন্য এক ইউপি সদস্য বলেন, আমার ওয়ার্ডের মন্ডপে ৪জনের জায়গায় ১জন দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রত্যেক আনসার সদস্যের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করা হয়েছে।

এবিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা আনসার ও ভিডিপির কমান্ড্যান্ড মোঃ সেফাউল হোসেন বলেন, আনসার সদস্যদের কাছ থেকে যারা ঘুষ আদায় করেছেন তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।