ঢাকা ০৯:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

শিশুদের হাতে ঝুঁকিপূর্ণ বাহন

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০৯:১৬:৫৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২২
  • / ৩৯৩ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি: কুলাউড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন চলছে অবাধেই। তাও এগুলোর অনেকটির চালক শিশু ও কিশোররা।৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু কিশোররা প্রকাশ্যে শহর এবং আশেপাশের এলাকায় বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছে অটোরিকশা।

অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ শিশুরা যান্ত্রিক যান চালনায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ার পাশপাশি শিশুশ্রম আইনও লঙ্ঘিন হচ্ছে। আর ট্রাফিক পুলিশের দাবি, শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুলাউড়া পৌর শহরের প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে প্রতিদিন সহস্রাধিক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। এর মধ্যে প্রায় শতাধিক অটোরিকশার চালক ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু কিশোররা। আর এসব শিশু চালকের অধিকাংশ কানে হেডফোন লাগিয়ে বেপরোয়া গতিতে অটোরিকশা চালাচ্ছে শহরের প্রধান সড়কে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের নজরে পড়লেও বিষয়টি নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই তাদের। এতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশু কিশোর অটোরিকশা চালক।

১১ বছর বয়সী অটোরিকশা চালক ফয়ছল মিয়া বলে, ‘রোজগার ভালো হয় অটোরিকশা চালালে। পৌরসভার চাতলগাঁও এলাকার মুক্তার মিয়ার অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে প্রায় ৩ মাস ধরে চালাচ্ছি। আগে ভয় করতো ট্রাফিক যদি আটকায়। কিন্তু এখন তারা কিছু বলে না।’

১৩ বছর বয়সী অটোরিকশা চালক জীবন আহমদ বলে, ‘আগে আমার বাবা চালাতেন। এখন তিনি অসুস্থ। অন্য কাজ থেকে রিকশা চালানোতে পরিশ্রম কম। তাই ৮ মাস ধরে রিকশা চালিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করছি।

৯ বছর বয়সী অটোরিকশা চালক সজীব আহমদ বলে, ‘হোটেলে ৮-৯ঘণ্টা কাজ করলে ১০০ টাকা পাই। অটোরিকশা চালিয়ে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার হয়। চাতলগাঁও এলাকার একজনের কাছ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়া দিয়ে রিকশা এনেছি। ট্রাফিক পুলিশ আটকালে পরে রিকশার মালিক ছাড়িয়ে নেন।৮ বছর বয়সী চালক নাঈম বলেন, ‘গত ৪ মাস ধরে জয়পাশা গ্রামের ঝুনুর মিয়ার রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাই। কেউ কিছু বলে না। মটর দিয়ে রিকশা চলে তাই কষ্ট তেমন লাগে না।

প্রাপ্তবয়স্ক অটোরিকশা চালক মোহন মিয়া ও আলী হোসেন বলেন, ছোট শিশু হওয়ায় এরা রিকশার গতি নিয়ে কিছুই জানে না। যখন তখন ভিড়ের মধ্যে ওভারটেক করে এবং রিকশা ঘোরানোর চেষ্টা করে। এতে আমাদের রিকশা চালাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

শহরের বস্ত্র ব্যবসায়ী শেখ শহীদুল ইসলাম জানান, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অনভিজ্ঞ এসব শিশুরা কানে হেডফোন লাগিয়ে পাশে সমবয়সী আরেকজনকে বসিয়ে বেপরোয়া গতিতে রিকশা চালায়। এদের রিকশায় ওঠলে ভয় করে কখন জানি দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।

পৌর এলাকার বাসিন্দা নাজমুল বারী সোহেল বলেন, অটোরিকশার শিশু চালকরা হুট সড়কের ওপর রিকশা ঘোরানোর জন্য প্রায়ই মোটর সাইকেল চালকরা দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।

কুলাউড়া সরকারি কলেজের শিক্ষক সিপার আহমদ বলেন, ট্রাফিক আইন তো দূরের কথা, কিভাবে যান্ত্রিক এই যান চালাতে হয় জানে না ক্ষুদে শিশুরা। অথচ এরা এখন বেপরোয়া গতিতে সড়কে অটোরিকশা চালায়। এটা দেখলেই ভয় লাগে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি রাখা উচিত এবং এদের হাতে এসব যান তুলে না দিতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো দরকার।

পৌর এলাকার বাসিন্দা ও ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. রজত কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ‘যেখানে লাইসেন্স ছাড়া যান্ত্রিক যান চালানো নিষেধ সেখানে প্রকাশ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু কিশোররা ব্যটারিচালিত অটোরিকশা এবং সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালাচ্ছে। অনভিজ্ঞ এসব শিশু কিশোররা অটোরিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার সৃষ্টি করছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। এখনই এসব নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

কুলাউড়া ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ এনামুল হক বলেন, ট্রাফিক আইনে শিশু কিশোরদের কোন শাস্তি দেওয়া যায় না। তবে উপজেলা প্রশাসন বা সমাজসেবার পক্ষ থেকে শিশুদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে।

শিশুদের হাতে যারা অটোরিকশা তুলে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালিকরা কাদের হাতে রিকশা তুলে দিচ্ছে সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার কিছু নেই, তবে যদি কোন শিশু অটোরিকশা দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায় তাহলে ওই মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আইনে মামলা হবে।

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিনয় ভূষন রায় বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি শিশুরা যাতে অবাধে রিকশা চালাতে না পারে। তবে এসব শিশুদের হাতে যে মালিকরা রিকশা তুলে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা খোঁজ নিয়ে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নিবো।

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের আলোচনা হয়েছে। আমরা অভিযানে মাঠে নামবো এবং বিষয়টি নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাবো।’

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

শিশুদের হাতে ঝুঁকিপূর্ণ বাহন

আপডেট সময় ০৯:১৬:৫৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২২

বিশেষ প্রতিনিধি: কুলাউড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ঝুঁকিপূর্ণ বাহন চলছে অবাধেই। তাও এগুলোর অনেকটির চালক শিশু ও কিশোররা।৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু কিশোররা প্রকাশ্যে শহর এবং আশেপাশের এলাকায় বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছে অটোরিকশা।

অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অদক্ষ শিশুরা যান্ত্রিক যান চালনায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ার পাশপাশি শিশুশ্রম আইনও লঙ্ঘিন হচ্ছে। আর ট্রাফিক পুলিশের দাবি, শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুলাউড়া পৌর শহরের প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে প্রতিদিন সহস্রাধিক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। এর মধ্যে প্রায় শতাধিক অটোরিকশার চালক ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু কিশোররা। আর এসব শিশু চালকের অধিকাংশ কানে হেডফোন লাগিয়ে বেপরোয়া গতিতে অটোরিকশা চালাচ্ছে শহরের প্রধান সড়কে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের নজরে পড়লেও বিষয়টি নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই তাদের। এতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশু কিশোর অটোরিকশা চালক।

১১ বছর বয়সী অটোরিকশা চালক ফয়ছল মিয়া বলে, ‘রোজগার ভালো হয় অটোরিকশা চালালে। পৌরসভার চাতলগাঁও এলাকার মুক্তার মিয়ার অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে প্রায় ৩ মাস ধরে চালাচ্ছি। আগে ভয় করতো ট্রাফিক যদি আটকায়। কিন্তু এখন তারা কিছু বলে না।’

১৩ বছর বয়সী অটোরিকশা চালক জীবন আহমদ বলে, ‘আগে আমার বাবা চালাতেন। এখন তিনি অসুস্থ। অন্য কাজ থেকে রিকশা চালানোতে পরিশ্রম কম। তাই ৮ মাস ধরে রিকশা চালিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করছি।

৯ বছর বয়সী অটোরিকশা চালক সজীব আহমদ বলে, ‘হোটেলে ৮-৯ঘণ্টা কাজ করলে ১০০ টাকা পাই। অটোরিকশা চালিয়ে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার হয়। চাতলগাঁও এলাকার একজনের কাছ থেকে ৩০০ টাকা ভাড়া দিয়ে রিকশা এনেছি। ট্রাফিক পুলিশ আটকালে পরে রিকশার মালিক ছাড়িয়ে নেন।৮ বছর বয়সী চালক নাঈম বলেন, ‘গত ৪ মাস ধরে জয়পাশা গ্রামের ঝুনুর মিয়ার রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাই। কেউ কিছু বলে না। মটর দিয়ে রিকশা চলে তাই কষ্ট তেমন লাগে না।

প্রাপ্তবয়স্ক অটোরিকশা চালক মোহন মিয়া ও আলী হোসেন বলেন, ছোট শিশু হওয়ায় এরা রিকশার গতি নিয়ে কিছুই জানে না। যখন তখন ভিড়ের মধ্যে ওভারটেক করে এবং রিকশা ঘোরানোর চেষ্টা করে। এতে আমাদের রিকশা চালাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

শহরের বস্ত্র ব্যবসায়ী শেখ শহীদুল ইসলাম জানান, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অনভিজ্ঞ এসব শিশুরা কানে হেডফোন লাগিয়ে পাশে সমবয়সী আরেকজনকে বসিয়ে বেপরোয়া গতিতে রিকশা চালায়। এদের রিকশায় ওঠলে ভয় করে কখন জানি দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।

পৌর এলাকার বাসিন্দা নাজমুল বারী সোহেল বলেন, অটোরিকশার শিশু চালকরা হুট সড়কের ওপর রিকশা ঘোরানোর জন্য প্রায়ই মোটর সাইকেল চালকরা দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়।

কুলাউড়া সরকারি কলেজের শিক্ষক সিপার আহমদ বলেন, ট্রাফিক আইন তো দূরের কথা, কিভাবে যান্ত্রিক এই যান চালাতে হয় জানে না ক্ষুদে শিশুরা। অথচ এরা এখন বেপরোয়া গতিতে সড়কে অটোরিকশা চালায়। এটা দেখলেই ভয় লাগে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি রাখা উচিত এবং এদের হাতে এসব যান তুলে না দিতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো দরকার।

পৌর এলাকার বাসিন্দা ও ইয়াকুব তাজুল মহিলা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. রজত কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, ‘যেখানে লাইসেন্স ছাড়া যান্ত্রিক যান চালানো নিষেধ সেখানে প্রকাশ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু কিশোররা ব্যটারিচালিত অটোরিকশা এবং সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালাচ্ছে। অনভিজ্ঞ এসব শিশু কিশোররা অটোরিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার সৃষ্টি করছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। এখনই এসব নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

কুলাউড়া ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ এনামুল হক বলেন, ট্রাফিক আইনে শিশু কিশোরদের কোন শাস্তি দেওয়া যায় না। তবে উপজেলা প্রশাসন বা সমাজসেবার পক্ষ থেকে শিশুদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে।

শিশুদের হাতে যারা অটোরিকশা তুলে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালিকরা কাদের হাতে রিকশা তুলে দিচ্ছে সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার কিছু নেই, তবে যদি কোন শিশু অটোরিকশা দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায় তাহলে ওই মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারী আইনে মামলা হবে।

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিনয় ভূষন রায় বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি শিশুরা যাতে অবাধে রিকশা চালাতে না পারে। তবে এসব শিশুদের হাতে যে মালিকরা রিকশা তুলে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা খোঁজ নিয়ে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নিবো।

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনে ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের আলোচনা হয়েছে। আমরা অভিযানে মাঠে নামবো এবং বিষয়টি নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাবো।’