ঢাকা ০৩:১৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজ
৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি না বুঝে ভিজিট ভিসায় কানাডায় পাড়ি জমানো বাংলাদেশিরা এখন অসহায় লাখাইয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে আনসার ও ভিডিপি’র সাথে মতবিনিময় মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদকসহ ১৪ নেতাকর্মী কারাগারে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদকসহ ১৪ নেতাকর্মী কারাগারে শ্রীমঙ্গল দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার কমলগঞ্জে শমশেরনগরে রেলপথ ঘেষে জমে উঠে অবৈধ পশুর হাট; দুর্ঘটনার আশঙ্কা লাখাইয়ে দিনব্যাপী কৃষক কৃষাণী প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত কোটচাঁদপুরে দুইটি ডিপ টিউবওয়েলের সেকশন পাইপ কেটে দিয়েছেন দূর্বৃত্তরা মৌলভীবাজারে চোরাই গাড়ি উদ্ধার, গ্রেফতার -১

সফল কর্মজীবনের অধিকারী  নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার 

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ১২:২৭:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / ৮৩০ বার পড়া হয়েছে
ফয়সল আহমদ রুহেল : শৈশবে কেটেছে বাবার কর্মস্থল সুরমা চা বাগানে। তখনকার সময় সুরমা চা বাগানের আশেপাশে ছিল না কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাসায় গৃহ শিক্ষকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা নেন। হাইস্কুলে যেতেন বাই-সাইকেলে। কাচা সরু রাস্তা ছিল, বৃষ্টির দিনে এসব মাড়িয়ে স্কুলে যেতেন। শিক্ষা জীবনে বেশ কয়েকটি বছর নষ্ট হয়। তারপর জ্ঞান ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ হয়েছিল। বিএসসি শিক্ষক হিসাবে ১৫০ টাকা বেতনে মাত্র ২২ বছর বয়সে শিক্ষকতা জীবন শুরু। তখন  বিএসসি পাশ লোক গ্রামাঞ্চলে খুব কমই ছিল। তখনকার দিনে অনেক লোভনীয় সরকারী চাকরীর মোহ ত্যাগ করে শিক্ষকতায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। জীবনের যৌবনকালে শিক্ষকতায় আসা মানুষটি মানুষ গড়ার কারখানায় কাটিয়ে দিয়েছেন ৩৯ বছর। অভিভাবক সুলভ ব্যবহার দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীর হৃদয় জয় করে নেন। নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য কমলগঞ্জ উপজেলার “মুন্সীবাজার কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের” অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। দীর্ঘ ও সফল কর্মজীবনের অধিকারী গুণী শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যারের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বর্বর পাকবাহিনী লুটতরাজ চালায়।
জন্ম :
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য ১৯৪৩ সালের ২৮ আগষ্ট হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলার সুরমা চা বাগানে (তৎকালীন ছিল সিলেট) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত নরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, মাতা মৃত সরযু বালা ভট্টাচার্য্য। পিতা চা বাগানে চাকরী (সুরমা চা বাগান) করতেন। নরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। তাদের স্থায়ী নিবাস মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার এর সরিশকান্দি গ্রামে।
শিক্ষাজীবন :
নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য প্রাথমিক শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করেন গৃহ শিক্ষকের কাছে। তিনি ১৯৬১ সালে জগদিশপুর জে,সি হাইস্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পাশ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে ২য় বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি পাশ করেন। এছাড়া তিনি ১৯৮১-১৯৮২ শিক্ষাবর্ষে কুমিল্লা শিক্ষক প্রশিক্ষন মহাবিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১ম বিভাগে ১১তম স্থান অর্জন করে বিএড ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্মজীবন :
কমলগঞ্জ উপজেলার “মুন্সীবাজার কালী প্রসাদ এম,ই বিদ্যালয়” তখন সবেমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়ে প্রথম বারের মত ১৯৬৫ সালে ছাত্রদের কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড শর্তাধীন (একজন বিএসসি পাশ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে) এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেয়। তখন শিক্ষাবোর্ডের সেই শর্ত পূরন করতে বিএসসি শিক্ষক হিসাবে ১৫০ টাকা বেতনে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য  ১৯৬৫ সালের ২৫ অক্টোবর ঐ বিদ্যালয়ে  বিজ্ঞান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০০২ সালে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। একই স্কুলে একটানা ৩৯ বছর শিক্ষকতার পর ২০০৪ সালের ২৮ আগষ্ট প্রধান শিক্ষক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, প্রধান শিক্ষক হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ক্রীড়া শিক্ষক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই স্কুলের ১২৭ বৎসরের ইতিহাসে এক নাগাদে কোন শিক্ষক এতদিন শিক্ষকতা করেন নাই, যা স্যারের চাকুরী জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি এবং যে কারনে তিনি গর্ববোধ করেন।
শৈশব জীবন :
তখনকার দিনে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলার সুরমা চা বাগানে বা তার আশেপাশে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কেটেছে বাসায় গৃহ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। স্কুল জীবন শুরু হয় ১৯৫৫ সালে আগরতলা “নেতাজী সুভাষ বিদ্যা নিকেতন” এ সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে। নবম শ্রেনী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়ে বাসস্থান পরিবর্তনের কারনে ১৯৫৮ সালে চলে যান শিলং। সেখানে “লাবান বেঙ্গলি বয়েজ হাইস্কুল” এ আবার নবম শ্রেনীতেই ভর্তি হন শিক্ষা বোর্ড পরিবর্তনের কারনে। সেখানে ১ বছর পড়ার পর দশম শ্রেনীতে উঠে ১৯৫৯ সালে পারিবারিক কারনে চলে আসতে হয় বাবার চাকুরিস্থল সুরমা চা বাগানে। ১৯৫৯ সালে আবার নবম শ্রেনীতে ভর্তি হন বাগান থেকে ৫-৬ মাইল দুরে “জগদিশপুর জে,সি, হাইস্কুলে”। স্কুলে যাতায়াত ছিল খুবই কষ্টকর। বাই সাইকেলে স্কুলে যেতেন। কাচা সরু রাস্তা ছিল, বৃষ্টির দিনে খুবই কষ্ট হত। কিছুটা পথ রেল লইনের পাশ দিয়ে যেতে হত। দুইটি লম্বা রেলওয়ে ব্রীজ পার হতে হত খুবই সাবধানে সতর্কতার সাথে সামনে পিছনে ভালো করে দেখে। যেকোন সময় ট্রেন চলে আসতে পারে। রেল লাইনের উপর সাইকেলের চাকা উঠিয়ে স্লিপারে পা রেখে টপকে টপকে ব্রীজ পার হতেন। এই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাশ করেন। প্রথমে কলিকাতা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড তারপর আসাম মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড এবং সর্বশেষ পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডে পড়াশোনা করার কারণে তাঁর শিক্ষা জীবনে বেশ কয়েকটি বছর নষ্ট হলেও জ্ঞান ভান্ডার কিছুটা সমৃদ্ধ হয়েছিল।
ছাত্র রাজনীতি : 
নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য ছাত্র জীবন থেকেই বিভিন্ন সংগঠন ও সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভ্যাস ছিল। তাই কলেজে ভর্তি হবার পর বড় ভাইদের (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, গুলজার আহমেদ প্রমুখ এরা ছিলেন দুই বছরের সিনিয়র) অনুপ্রেরণা এবং নিজের আগ্রহের কারনে জড়িয়ে পরলেন তদানীন্তন রাজনৈতিক সংগঠন “ন্যাপ” এর অঙ্গ সংগঠন EPSU (East Pakistan Students Union)এর সঙ্গে। তখনকার ছাত্র রাজনীতি ছিল শুধু ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই সময় সিলেটের ছাত্র রাজনীতির প্রধান বিষয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটে হবে নাকি চিটাগাং এ হবে এই নিয়ে মতানৈক্য ছিল। বিশ্ববদ্যালয় সিলেটেই প্রতিষ্ঠা হোক এই দাবি নিয়ে উনারা সিলেটের সকল স্তরের ছাত্ররা সিলেট শহরে মিছিল, মিটিং, পোষ্টারিং করেন। তখন আইয়ূব খানের শাষন আমল। চিটাগাং এর ফজলুর কাদের চৌধুরী (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা) ছিলেন তখনকার মুসলিম লীগের খুব প্রভাবশালী মন্ত্রী। তাই তাঁর প্রভাবেই অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারন করা হয় চিটাগাংয়ে। ফলে সিলেটবাসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঞ্চিত হন। এমসি কলেজ থেকেই কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৬৩ সালে এইচএসসি পাশ করেন নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য। দুর্ভাগ্যবশত বিএসসি তে ভর্তি হওয়ার সময় বিশেষ কারনে কিছু দেরী হয়ে যাওয়ায় হোস্টেলে সিট পেলেন না এবং তখন সিলেটে থাকার মত এমন কোন সুবিধা না থাকায় এমসি কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না। তখন মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ কোথাও কোন কলেজে বিএসসি পড়ার সুযোগ ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হলেন। অনার্স পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেখানে অনার্স ছিল না। তাই পাশ কোর্সেই ১৯৬৫ সালে ২য় বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি পাশ করেন তিনি।
যেভাবে শিক্ষকতায় আসা :
বাড়ির পা্র্শ্ববর্তী একটি অতি প্রাচীন “মুন্সীবাজার কালী প্রসাদ এমই বিদ্যালয়” তখন সবেমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়ে প্রথম বারের মত ১৯৬৫ সালে ছাত্রদের কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড শর্তাধীন (একজন বিএসসি পাশ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে) এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিএসসি পাশ শিক্ষক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তখনকার দিনে বিএসসি পাশ লোক গ্রামাঞ্চলে খুব কমই পাওয়া যেত। নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যরে একজন প্রতিবেশী ছিলেন ঐ স্কুলের পরিচালনা কমিটির সদস্য। তিনি প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যরে কথা আলাপ করেছিলেন। হঠাৎ একদিন একজন লোক (স্কুলের দপ্তরী) নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে এসে তাঁকে একটি খাম দিলেন। খাম খুলে দেখলেন একটি নিয়োগপত্র। বি,এসসি শিক্ষক হিসাবে ১৫০ টাকা বেতনে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি অবাক হলেন, দরখাস্ত করলেন না, ইন্টারভিউ দিলেন না অথচ চাকরী পেয়ে গেলেন। শিক্ষাবোর্ডের সেই শর্ত পূরন করতে ডিগ্রী পরীক্ষার ফল প্রকাশের সাথে সাথেই ঐ বিদ্যালয়ে তিনি মাত্র ২২ বৎসর বয়সে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৫ সালে ২৫ অক্টোবর কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। যেহেতু ঐ বিদ্যালয়ে কোন বিএসসি শিক্ষক ছিলেন না এবং এলাকাতেও তখন বি,এসসি পাশ কেউ ছিল না, তাই বি,এসসি, স্যার হিসাবে শিক্ষকতার প্রথম দিকে যে পরিচিতি লাভ করেছিলেন অবসর গ্রহনের পর এখনও নিজ নামের চেয়ে বিএস সি স্যার হিসাবেই তিনি বেশী পরিচিত। অনেকেই স্যারের নাম জানেন না। কিন্তু বিএসসি স্যার বা বিএসসি বাবু হিসাবে শুধু এলাকাতেই নয় দূর-দুরান্তেও পরিচয় ছড়িয়ে যায়।
বিদ্যালয়ের জন্য যতকিছু : 
কালী প্রসাদ বিদ্যালয়টি যেহেতু হাইস্কুল হিসাবে নতুন তাই শিক্ষকতার শুরুতেই অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। বিদ্যালয় শুরুর পূর্বে এবং ছুটির পর অতিরিক্ত ক্লাস নেন তিনি। যে কারনে বিদ্যালয়টি প্রথম থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল করতে শুরু করে এবং বোর্ড থেকে স্থায়ী স্বীকৃতি লাভে সমর্থ হয়। প্রথমদিকে বিদ্যালয়টিতে শুধু মানবিক বিভাগ ছিল। তাই মেধাবী ছাত্র যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে ভবিষ্যতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হওয়ার আশা পোষণ করে তাদের সেই আশা পূরনের কোন উপায় ছিল না। তাদের অভিভাবকদের ঐকান্তিক অনুরোধ এবং শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের আশা পূরনের মানসিকতা তাকে প্রবল ভাবে আলোড়িত করে। তাই প্রধান শিক্ষকের সাথে পরামর্শ ক্রমে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ খোলার ব্যবস্থা নেওয়া হল এবং ১৯৬৮ সাল থেকে বিজ্ঞান বিভাগ খুলে বিদ্যালয়টি দ্বি পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হল। একমাত্র বিএসসি শিক্ষক হিসাবে প্রথম কয়েক বছর একা তাঁকে বিজ্ঞান বিভাগের সবগুলো বিষয় পড়াতে হয়েছে যে কারনে তাকে অত্যাধিক পরিশ্রম করতে হয়েছে এমনকি কোন কোন দিন রাত পর্যন্ত হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ক্লাস নিয়েছেন (তখন এলাকাতে বিদ্যুৎ ছিল না)। বিজ্ঞান বিভাগে ১ম ব্যাচে মাত্র ১টি ছাত্রীই ছিল। ঐ ছাত্রীর বাবা প্রতিদিন বিকেল বেলা স্কুলে এসে বসে থাকতেন ক্লাস শেষ হবার পর রাত্রে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। রাত্রে মেয়েতো একা বাড়ি যেতে পারবেনা। সেসব কথা এখন কেউ বিশ্বাসই করবে না। তাঁর এই কর্মোদ্যম ছাত্রদের মধ্যেও যথেষ্ঠ অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে। তারাও যথেষ্ট আশাবাদি ছিল। যে কারনে প্রথম ২ বৎসর বিজ্ঞান বিভাগে পাশের হার ছিল শতকরা ১০০ভাগ। এছাড়া ২০০২ সালে একই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ার পর দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। শিক্ষকদের (প্রায় সবাই স্যারের ছাত্র) নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে এক যোগে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী বৎসরই এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার বিগত বৎসর গুলির তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। প্রধান শিক্ষক হওয়ার আগে তিনি ক্রীড়া শিক্ষক হিসাবেও দায়িত্ব পালন কালে ছাত্ররা জেলা পর্যায় থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত অংশগ্রহন করতে সক্ষম হয়েছে।
শ্রেষ্ট শিক্ষকের পুরস্কার : 
এই গুণী মানুষটিকে শিক্ষকতায় নিজ কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৯৭ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেনী শিক্ষক হিসাবে এবং ২০০৩ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসাবে মনোনীত করে সনদ ও পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
স্যারের যত ছাত্ররা :
কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম দিকের ছাত্ররা অনেকেই এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক হিসাবে স্ব-স্ব স্থানে স্বমহিমায় সুনামের সাথে কর্মরত থেকে সৎভাবে জীবনযাপন করছে। যে কারনে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। মাঝে মধ্যে পুরাতন ছাত্ররা মোবাইল করে সেই সব পুরাতন স্মৃতি স্মরণ করে। তাঁর ভালোই লাগে, শিক্ষক হিসাবে ইহাই তাঁর বড় প্রাপ্তি। শ্রেনী শিক্ষক থাকা অবস্থায় অনেক গরীব শিক্ষার্থী যারা সময়মত বেতন অথবা পরীক্ষার ফিস না দেওয়ার কারনে পরীক্ষা দেওয়া হতে বঞ্চিত হচ্ছিল তাদের অনেকেরই বেতন বা পরীক্ষার ফিস ইত্যাদি নিজেই পরিশোধ করেন। সেইসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু শিক্ষকের এই অবদানের কথা এখনও বলে বেড়ায়। দীর্ঘদিন একই স্কুলে শিক্ষকতা করার কারনে নিজ ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং অনেক  মেম্বার নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যরে প্রাক্তন ছাত্র। স্যারের প্রাক্তন ছাত্র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সেনা বিভাগে, সরকারী আমলা, অধ্যাপক, ব্যাংকার হিসাবে চাকুরীরত অথবা অবসর গ্রহণ করেছে।
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড :
১৯৮১-১৯৮২ শিক্ষাবর্ষে কুমিল্লা শিক্ষক প্রশিক্ষন মহাবিদ্যালয়ে প্রশিক্ষনে থাকা কালীন সময়ে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যোগদান করে অনেক সনদ ও পুরষ্কার পান। কবিতা আবৃত্তি, নাটক ও টেবিল টেনিস খেলাতে ১ম, ক্যারাম বোর্ড খেলাতে ২য় হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার জেলা শিল্প কলা একাডেমির উদ্যোগে জেলা ব্যাপী নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেই প্রতিযোগিতায় “সূর্যমূখী নাট্ট সংস্থা” সহ সমস্ত জেলা থেকে মোট ১৩টি দল অংশ গ্রহন করে। এই প্রতিযোগিতায় তিনি মৌলভীবাজার জেলার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে সনদ এবং পুরষ্কার লাভ করেন। এছাড়াও স্কুলে ও এলাকাতে তিনি অনেক নাটকে অংশগ্রহন করে সুনাম অর্জন করেন। প্রশিক্ষনের কারনে শিক্ষকতায় উৎকর্ষ সাধন হয় এবং প্রনালীবদ্ধ উপায়ে ছাত্রদের শিক্ষাদান করে তাদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করেন। ১৯৯৬ সালে শিক্ষাক্রম বিস্তরন কার্যক্রমের উপর প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। যা পেশাগত মান ও শ্রেনী কক্ষে শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নের উপর সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বল্পকালীন প্রশিক্ষন নিয়ে নিজের পেশাগত মান বৃদ্ধি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহজবোধ্য উপায়ে শিক্ষাদান করার চেষ্টা করেন।
পরীক্ষক : 
শ্রদ্ধেয় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে প্রথম এসএসসি পরীক্ষার গণিত বিষয়ের পরীক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং পরবর্ত্তী বৎসর গুলিতেও পরীক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অত:পর ২০০০ সালে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের জন্মলগ্ন থেকেই পরীক্ষক হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে গণিত বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রশিক্ষণ : 
শ্রদ্ধেয় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য অবসর গ্রহন করার পর ২০০৬ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের ফিমেল সেকেন্ডারি স্কুল এসিসট্যান্স প্রজেক্ট থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কমিটির এবং পিটিএ সদস্যদের উন্নত মানের শিক্ষাদান পদ্ধতি, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার ব্যাপারে প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য কমলগঞ্জ উপজেলা থেকে একমাত্র নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যকে নির্বাচিত করা হয় এবং এ ব্যাপারে ঢাকা থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অত্র উপজেলার শিক্ষক ও কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
শিক্ষকদের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা : বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন অবহেলিত, তাদের মাসিক বেতনও ছিল নগন্য, সরকার থেকে তারা কোন আর্থিক সুযোগ সুবিধা পেতেন না তাই শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষকদের সার্বিক উন্নয়নের ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার। যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিন মৌলভীবাজার জেলার শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং অবসর গ্রহনের দিন পর্যন্তও এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির মোট চার জন উপদেষ্টার মধ্যে তিনিও একজন উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে শিক্ষকরা শতভাগ সরকারী বেতন পাচ্ছেন।
দায়িত্ব পালন : 
গুণী শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য “দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি” কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে “সুশাসনের জন্য নাগরিক” (সুজন) কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সরিষকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (স্যারের পূর্ব পুরুষের দান করা জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত) পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসাবে কয়েকবার দায়িত্ব পালন করেন। গবিন্দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। “বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খীষ্টান ঐক্য পরিষদ” মৌলভীবাজার জেলা শাখার শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এবং একই সংগঠনের কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্র জীবনের ঘটনা :
নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, এমসি কলেজে মুহিব আলী স্যার নামে একজন অংকের অধ্যাপক ছিলেন। খুবই বৃদ্ধ এবং রসালাপী। ক্লাসের বাইরে সিলেটি ভাষায় কথা বলতেন। একদিন অংকের ক্লাস শেষে তিনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেছেন হঠাৎ আমরা যারা ক্লাসের ১ম সারিতে বসতাম আমাদের নজরে পড়লো যে স্যার উনির চশমার কেইচটা ভূলবসত টেবিলের উপর ফেলে গেছেন। আমরা কয়েকজন চশমার কেইচটা নিয়ে স্যারের সুনজরে পড়া এবং একটু বাহবা পাওয়ার আশায় দৌঁড়ে স্যারের কাছে যেতেই স্যার পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকালেন, আমরা চশমার কেইচটা স্যারের হাতে দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করলাম। মুহুর্তেই সব ম্লান হয়ে গেল। স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন “তোমরা ত ভালা মাইনষর বাচ্চা নায়।” আমরা অবাক হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পরেই স্যার হেসে বললেন “রাগ করছনি হুনো, আইজ কাইল ভালা মাইনষে কিচ্ছু পাইলে ফিরৎ দেইননা, পকেটো বরি রাখি দেইন। এর লাগি কইছি তোমরা ভালা মাইনষর বাচ্চা নায়।” মুহুর্তে আমাদের ভুল ভেঙ্গে গেলো, ম্লান মুখে হাসি ফুটলো। স্যার আমাদের পিঠ চাপড়ে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। স্যারের দোয়া ও স্নেহ আমৃত্যু মনে থাকবে।
শিক্ষকতা জীবনের ঘটনা : (১) নিহারেন্দু ভট্টাচার্যের  জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তারপরও তিনি দু’একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন- আমাদের স্কুলের পাশেই বাজার। তখন স্কুলের সীমানা দেয়াল না থাকায় টিফিনের সময় কিছু কিছু ছাত্র বাজারে চলে যেত। একদিন দেখলাম টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়ে গেছে, ছেলেরা দৌড়ে দৌড়ে স্কুলে এসে ডুকছে। বেশ কিছু সময় পর দেখলাম দশম শ্রেণীর একটি ছেলে খুব আস্তে আস্তে  নবাবি কায়দায় হেটে হেটে স্কুলে এসে ঢুকছে। আমি দপ্তরী পাঠিয়ে ঐ ছেলেকে অফিস রুমে আমার কাছে এনে টিফিনের পর দেরীতে স্কুলে আসার কারন জিজ্ঞাসা করলে সে বললো “এভাবেত অনেক ছেলেই দেরীতে আসে।” তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে আমার রাগ হলো। আমি তাকে বেত্রাঘাত করে শাসন করলাম (তখন বেতের প্রচলন ছিলো)। এর ৩/৪ দিন পর একদিন স্কুল ছুটির পর বাইসাইকেলে বাড়ী আসার পথে একজন খুব সাদাসিদে ধরনের ভদ্র লোক, আমাদের এলাকার লোক বলে মনে হলো না, আমার বিপরীত দিক থেকে আসছেন। আমাকে সাইকেল থামানোর ইঙ্গিত দিলেন। নেমে কারন জিজ্ঞাসা করলে জানতে চাইলেন হাইস্কুলটা কতদূর? কৌতুহল হলো। জানতে চাইলাম হাইস্কুলে উনার কি দরকার। উত্তরে বললেন, এই স্কলে বিএসসি স্যার নামে একজন শিক্ষক আছেন উনার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন। আরো অবাক হলাম জীবনে উনাকে কখনও দেখিনি অথচ আমাকে উনার প্রয়োজন। আমার পরিচয় দিলাম যে আমিই বিএসসি স্যার। সঙ্গে সঙ্গে এই রাস্তার উপরেই মাথা নুইয়ে আমার দুই পা জড়িয়ে ধরে বললেন উনার ছেলে আমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছে, ওস্তাদ এর সঙ্গে বেয়াদবি করা মহাপাপ তাই ছেলের হয়ে উনি ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। তাড়াতাড়ি নুইয়ে উনাকে হাত ধরে দাঁড় করে উনার ছেলের নাম জিজ্ঞাসে করে জানতে পারলাম, যে ছেলেটি ঐ দিন টিফিনের পর স্কুলে আসতে দেরী করেছিল সেই ছেলেটির বাবা উনি। উনার বাড়ী এখানে নয়, উনার ছেলে এখানে এক বাড়ীতে লজিংয়ে থাকে। ঐ লজিং মাষ্টার উনাকে খবর দিয়ে বিষয়টা জানিয়েছেন। আমি উনাকে শান্তনা দিয়ে বললাম যে আপনি অনুশোচনা করবেন না আমি এসব কথা ভুলে গেছি। উনাকে শান্তনা দিয়ে এবং উনার উপযুক্ত অভিভাবকত্বের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলাম। মনে মনে ভাবলাম এই ধরনের অভিভাবক আছেন বলেই আমরা শিক্ষকরা এখনো সমাজের বুকে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে টিকে আছি। অনেক বছর পর একদিন শমসেরনগর রেল ষ্টেশনে একটি সুঠাম দেহের অধিকারী লোক আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে দোয়া করতে বললো। আমি প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। সে তার নাম ও বহুদিন আগের ঐ ঘটনাটির ইঙ্গিত দিয়ে বললো “স্যার আপনার বেতের আঘাতেই আজ আমি মানুষ হয়েছি, এখন আমি সেনাবাহিনীতে চাকরী করছি।” প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো, প্রাণ ভরে তাকে আশীর্বাদ করলাম। শিক্ষক হিসাবে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি আছে।
(২) একদিন কোথায় যেন যাচ্ছি, হঠাৎ একটি গাড়ী আমার পাশেই এসে থেমে গেল এবং গাড়ী থেকে নেমে একজন ভদ্র লোক আমার নিকট এসে পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। আমি প্রথম চিনতে পারিনি পরিচয় দেয়ার পর চিনতে পারলাম। আমার প্রাক্তন ছাত্র সে এখন খুবই ভালো অবস্থায় আছে। অনেক টাকা রোজগার করে, একটি প্রাইভেট ক্লিনিকেরও মালিক। কথায় কথায় আমার শিক্ষকতার অধীনে তার অনেক স্মৃতি তুলে ধরলো। এক পর্যায়ে বললো যে সে একদিন একাউন্টস অফিসে গিয়েছিল তার একটি বিল জমা দিতে। বিলটি ছিল একটু জটিল। যার কাছে বিলটি জমা দিল তিনি মুহুর্তেই বিলটি হিসাব করে সব ঠিক করে দিলেন। সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো যে উনি কিভাবে এই জটিল বিলটি এত সহজে হিসাব করে ফেললেন। উত্তরে ঐ ভদ্রলোক নাকি তাকে বলেছিলেন যে তিনি অংকে খুবই কাঁচা ছিলেন, উনার একজন স্যার ছিলেন নিহারেন্দু ভট্টচার্য্য যার নিকট থেকে উনি অংক শিখে পারদর্শী হয়েছেন। তারা উভয়ই আমার ছাত্র হিসাবে পরস্পরের নিকট পরিচিত হলো। এই কথাগুলো শুনে আমার শিক্ষকতা জীবন স্বার্থক হলো এবং আমি পরম করুনাময়ের কাছে হাজারো শুকরিয়া আদায় করলাম।
পারিবারিক অবস্থা: 
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য এর সহধর্মিনী কনক প্রভা চক্রবর্তী একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরে চলে গেছেন। নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক। সবার বড় মেয়ে কৃষ্ণা ভট্টাচার্য্য; বিএ; বিএড (১ম শ্রেনী) উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, বিবাহিত। স্বামী- সরকারী চাকুরীজীবি। বড় ছেলে নবেন্দু ভট্টাচার্য্য; এল,এল,বি (সম্মান); এল,এল,এম; ঢাকা সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী। বিবাহিত। স্ত্রী-বি,এ (সম্মান) এম,এ (ইংরেজী) সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ছোট ছেলে নির্মলেন্দু ভট্টাচার্য্য; বিবিএস (সম্মান), এমবিএস; (ব্যবস্থাপনা)-ব্যাংক এ চাকুরিরত। বিবাহিত। স্ত্রী-বিএ (সম্মান) এমএ (লোক প্রশাসন), সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
নিরক্ষর মুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ :  
শিক্ষার মান উন্নয়ন তথা দেশকে নিরক্ষর মুক্ত করতে শিক্ষকদেরকে অগ্রনী ভুমিকা পালন করতে হয়। তাই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের যখন দেখেন স্কুলে না গিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে অথবা ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন খুবই মর্মাহত হন নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য। সাধ্যানুযায়ী তাদেরকে অথবা তাদের অভিভাবককে উদ্বুদ্ধ করেন তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য। শ্রদ্ধেয় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার আশাবাদী এই দেশে দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম যত বেগবান হবে শিক্ষার হার তত বৃদ্ধি পাবে এবং নিরক্ষর মুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। যার ফলে বাংলাদেশ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে পৃথিবীর বুকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং সুযোগ পেলে সেই কাজে সাধ্যানুযায়ী অবদান রাখতে পারেন সেই চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
১৯৭১ সালের কিছু স্মরণীয় ঘটনাবলী 
পাকহানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুমন্ত অবস্থায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর ট্যাংক, কামান, মেশিনগানের গুলি ও বেয়নটের মাধ্যমে নির্মম, নিষ্ঠুর, নৃশংস, বর্বরতার মাধ্যমে তাদের পৈশাচিকতার ও উম্মাদনার যাত্রা শুরু করে। ২৬ মার্চ বাংলার ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে খোদিত হয় একটা নাম- ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’।
নিহারেন্দ ভট্টাচার্য্য স্যারের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বর্বর পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় লুটতরাজ চালায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কিছু স্মরণীয় ঘটনাবলীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য বলেন, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তখনকার এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে কিছু সংখ্যক পাকিস্থানপন্থি তথা রাজাকার, আলবদর, আল সামস ছাড়া প্রায় সবাই কোন না কোনভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বাস্তু হারা হয়েছেন, আত্মাহুতি দিয়েছেন। মা বোনেরা নির্যাতিত হয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছেন। আমিও এদেরই মধ্যে একজন যে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি। ৭১ এর এপ্রিলের মাঝামাঝি হবে, শেরপুরের অবরোধ ভেঙ্গে পাক বাহিনী মৌলভীবাজার শহরে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে সরাসরি কৈলাশহর বোর্ডার অভিমুখে এসে শমসেরনগর ঘাটি স্থাপন করে। যার ফলে এ অঞ্চলের লোকের ভারত যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে অনেকেই শমসেরনগর হয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমার পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই ভারতে গেছেন কিন্তু আমি যাইনি। আমার বিশ্বাস ছিল যে আমি শিক্ষকতা করি, কারও সাথে আমার শত্রুতা নেই তাই কেহ আমার কোন ক্ষতি করবে না। পাক বাহিনী এ অঞ্চলে আসার পরই কিছু সংখ্যক বিপথগামী পাকিস্থান পন্থি তাদের সাথে মিশে গেল এবং পাক বাহিনী এদের সহায়তায় প্রতিদিনই বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে লোটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষন, হত্যা ইত্যাদি নানা ভাবে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর নির্যাতন করতে লাগলো। আমার বাড়ী প্রধান সড়কের পাশে থাকায় রোজই দেখতাম আর্মির গাড়ি বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে মানুষকে নির্যাতন করছে, অগ্নিসংযোগ করছে। তবুও আমার ধারনা ছিলো যে আমার বাড়ীতে কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না। কিছু দিন পরই আমার ভুল ভেঙ্গে গেলো। দিনটা হবে এপ্রিলের শেষ ভাগের। দুপুর বেলা খেতে বসেছি হঠাৎ আমার গ্রামেরই একটি লোক দৌঁড়ে এসে বললো গ্রামে আর্মি ঢুকেছে। খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলাম। বুঝলাম যে আর রেহাই নেই। অবশ্যই আমার বাড়িতে আসবে। পরিবারের সদস্য তখন আমি, আমার বিধবা মা এবং কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই। ছোট ভাইকে তখন তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির পেছনের বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে বললাম। দুই ভাই এক সঙ্গে যেন না মরি, এক ভাই যেন বেঁচে যায়। আমি অসুস্থতার ভান ধরে বিছানায় শুয়ে রইলাম এবং মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষন পরই দলবল নিয়ে আমার বাড়িতে প্রবেশ করলো পাক বাহিনী এবং সরাসরি ঘরে এসে ঢুকে আমাকে বিছানায় দেখে বললো ‘‘ কিহা হুয়া’’? আমি কম্পিত স্বরে বললাম “বখার (জ¦র) হুয়া”। চা বাগানে জন্ম হওয়ায় হিন্দি ভাষী শ্রমিকদের সঙ্গে থেকে কিছুটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি শিখে ছিলাম, হিন্দি ও উর্দুর মাঝে বেশ মিল আছে। আমাকে হাত ধরে টেনে তুলে উঠানে নিয়ে এলো। চেয়ে দেখলাম আমি যাদের আপন মনে করতাম সেই সব কপট প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে আছে এবং আঙ্গুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। একটি আর্মি আমার ঠিক সামনে এসে বললো “ গোল্ড নিকালো, রুপিয়া নিকালো”। আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বললাম যে আমি গরীব মাষ্টার আমার টাকা পয়সা নেই। পাশে দাঁড়ানো সেই সব বিশ্বাসঘাতকেরা আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে ইঙ্গিতে তাদের বুঝিয়ে দিলো যে আমার যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে। আর্মিরা বারবার আমাকে সোনাদানা টাকা পয়সা দেওয়ার জন্য বলছে আর আমি বারবার নিজেকে গরীব বলে বোঝানোর চেষ্ঠা করছি। এক পর্যায়ে তারা রেগে গেলো। একটি আর্মি কাঁধ থেকে রাইফেল হাতে নিয়ে আমার দিকে তাক করতেই আমার সাদা কাপড় পড়া বিধবা মা দু হাত প্রসারিত করে আমার সামনে এসে আমাকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। মায়ের সামনে যেন ছেলের মৃত্যু না হয়। মায়ের এই আত্মত্যাগ দেখে মনে হয় তার একটু করুণা হলো। রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ওরা ঘরে প্রবেশ করলো। পাশেই ছিলো একটি বড় সিন্দুক যার উপরে বিছানা করা ছিলো। বিছানা টেনে নিচে ফেলে দিতেই সিন্দুকের দুই পাশে বড় দুইটি তালা দেখে বললো “ ইয়েতো বড়া সামানা হায়, ইসকা আন্দার কিহা হায়, জলদি খোল”। চাবি দিয়ে তালা খুলে দিতেই সিন্দুকের উপরের ডালাটা ওরাই উপরে তুলে ধরলো। ভিতরে ছিলো তামা কাসার বাসনপত্র এবং একটি ট্রাংক, যার ভিতরে কিছু টাকা পয়সা এবং মায়ের কিছু গয়নাপাতি ছিলো। ট্রাংকের তালা খুলে দিতেই ওরা ট্রাংকের উপর হুমরি খেয়ে পড়ে যে যা পারে পকেটে পুরে নিলো। এদিকে, তাদের সহায়তাকারী দেশীয় দুষ্কৃতিকারীরা ঘরে ঢুকে ঘড়ি, ট্রানজিস্টার সহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিষপত্র এবং আলমিরাতে রাখা ভালো কাপড় চোপর সহ সবকিছু বেডকাভার দিয়ে গাঁট বেঁধে যে যেভাবে পারে নিয়ে নিলো। সবকিছু যেন চোখের নিমিষে ঘটে গেল। আস্তে আস্তে আর্মিরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ও মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। সবশেষে যে আর্মিটা ছিল সে বাহির হবার সময় আমার দিকে আঙ্গুল ইশারা করে মা কে বললো “ ইয়েতো ড়াড় কা বেটা হায় ইসলিয়ে খতম নাই কিয়া, হামারা ভি মাই হায়”। বুঝলাম তার মা ও বোধ হয় আমার মায়ের মতো ড়াড় (বিধবা)। তাই আমাকে রক্ষা করতে আমার মা সামনে দাঁড়াতেই তার মায়ের কথা মনে পরে গেছে। তাই আমাকে গুলি করেনি। ওরা যাবার পর ভাই বেরিয়ে এলো। তিনজন মিলে ভাবলাম যে যাদেরকে আমরা আপন বলে ভাবতাম তারা কেহই আপন নয়। এদের মধ্যেই কেহ কোন দিন সম্পত্তির লোভে আর্মির কাছে গিয়ে আমাদের নামে খারাপ কিছু বলে আমাদের ধরিয়ে দেবে। আর্মিরা শমসেরনগর ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলবে। তাই একটি ভাই যেন বেঁচে থাকতে পারি সেই চিন্তা করে আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটি লোক আছে যে গোপন পথে ভারতে লোক আনা নেওয়া করে, তাকে খবর দিয়ে বাড়িতে এনে ভাইকে ভারতে দিয়ে আসতে বললাম। ভাই আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছিলো না। জোর করে তাকে পাঠালাম এবং বলে দিলাম যে জীবনেও হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে, তুমি প্রতি বৎসর বাবার মৃত্যু তারিখে ছেলে হিসাবে যে কাজটুকু করা তা করবে, যা এতোদিন আমি করে এসেছি। ঐ লোকটিকে তার চাহিদা মতো অর্ধেক টাকা দিলাম এবং বাকি টাকা ভাই ভারতে পৌঁছার পর তার হাতের লেখা কাগজ পেলে দেব। ভাইকে গোপনে বলেছিলাম যে তুমি ভারতে পৌঁছার পর ভারতের চারমিনার সিগারেটের পেকেটের কাগজে তোমার পৌঁছা সংবাদ লিখে দিও। লোকটি কথা রেখেছে। ভাই এর হাতের লেখা কাগজ পেয়ে বাকি টাকা দিলাম। প্রবাদ আছে “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়”। তখন কাউকে বিশ্বাস  করতে পারছিলাম না। ঐ লোকটি ইচ্ছা করলে আমার ভাইকে পাক আর্মির কাছে তুলে দিতে পারতো তাই আগে সম্পূর্ণ টাকা দেইনি। ভাই ভারতে পৌঁছার পর স্বস্তি বোধ করছিলাম, এখন মরে গেলেও আপসোস নেই। এক ভাইতো বেঁচে থাকবে। আমাদের আশপাশের কিছু লোক যারা আগে আমার মতো দেশের মায়া ত্যাগ করে ভারতে যায়নি এখন নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। আমরা সবাই গোপনে একত্রে মিলিত হয়ে এক গভীর রাতে বাড়ি ঘর, ধন সম্পদ, সাজানো সংসার সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে নিজের প্রান বাঁচাতে এক বস্ত্রে বেরিয়ে গেলাম ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমার দুইটি মুসলিম ছাত্র মনতাজ মিয়া ও আদর মিয়া আমাকে অনেক সাহায্যে করেছে। যাওয়ার দিনও গভীর রাতে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। তারা কেহই এখন জীবিত নেই, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। অনেক দুর্গম পথ পেরিয়ে সারা রাত হেঁটে পরদিন দুপুরে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছলাম। প্রমানিত হলো নিজের প্রানের চেয়ে বড় দুনিয়াতে কিছু নেই। ভাই এর সঙ্গে মিলিত হলাম। আমার চেনা জানা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হচ্ছে। আমারও ইচ্ছা ছিলো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার, কিন্তু আমরা ভারতে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই আমার এক সম্পর্কিত ভাই আমার ছোট ভাইকে নিয়ে গেলেন কোহিমা (নাগাল্যান্ডের রাজধানী)। তিনি সেখানে বড় পদে চাকরী করেন, ছোট ভাইকে ঢুকিয়ে দিলেন চাকুরীতে। তাই মাকে একা ফেলে আমার আর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হলো না। এই আক্ষেপ সারা জীবন থেকে যাবে। প্রায় সাত মাস ভারতে থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাড়িতে ফিরে এলাম। কিছুই নাই, সম্পূর্ণ ময়দান। শুধু একটি জরাজীর্ণ ঘর অর্ধ ভগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। জানতে পারলাম এক লোক নাকি আমার বাড়ি দখল করে এই ঘরে ছিলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পেয়ে সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। সে বাড়িতে থাকায় এই লাভটুকু হয়েছে যে আর্মিরা বাড়ি জ্বালিয়ে  দেয়নি। আমার আশপাশে খালি বাড়ি যতগুলি ছিল সব আর্মিরা জ্বালিয়ে  দিয়েছে। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। পরিধানের বস্ত্র ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। সেই থেকে ৫০ বৎসর পর আজ এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছি। কবি বলেছেন “ যোগ্য যে ভাগ্য তার কবু নাহি টুটে, ডুবিলেও তরী তার পুনঃ ভাসি উঠে”। পরম করুণাময়ের কৃপায় আমার ডুবন্ত তরী ভেসে উঠেছে। ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনীসহ ভালোই আছি। পরম করুণাময়ের কাছে চির কৃতজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার জীবনে ঘটে যাওয়া করুণ ঘটনা গুলির চিত্র আমার জীবনীতে প্রতিফলিত না হলে দুঃখের দিন গুলির বর্ণনা অনেকের কাছে অজানা থেকে যাবে।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কমলগঞ্জ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
তিনি ছাত্র জীবনে দেখতেন যে সমাজে সবাই শিক্ষকদের শ্রদ্ধা ও মান্য করে এবং শিক্ষকরাই অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। যা ছাত্রদের পরবর্তীতে সমাজ তথা দেশের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষকদের মর্যাদা শত গুন বৃদ্ধি পায়। সেই থেকেই শিক্ষকতার প্রতি মোহ জন্মায় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যারের। তিনি ছাত্র জীবনে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দীর্ঘদিন একই স্কুলে শিক্ষকতা করার কারনে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যারের প্রাক্তন ছাত্ররা স্ব-স্ব স্থানে স্বমহিমায় সুনামের সাথে কর্মরত। গরীব শিক্ষার্থীর জন্য তিনি সাহায্যের হাত সবসময় সম্প্রসারিত করেছেন। সেইসব শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত। স্যারের অনেক প্রাক্তন ছাত্ররা পথে প্রান্তরে দেখলে পা ছুঁয়ে সালাম করে। তখন প্রাণটা জুড়িয়ে যায় স্যারের। শিক্ষকতা জীবনে ইহাই তাঁর বড় প্রাপ্তি। কাজের সঠিক মূল্যায়ন মানুষের ভিতর অনুপ্রেরনা যোগায়, মানুষ নব উদ্যোমে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্যারের বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার মেধা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে সমাজকে উপহার দিয়েছেন অনেক কীর্তিমান। আমরা তাঁর সুদীর্ঘ আয়ু এবং সুস্থতা কামনা করছি।
ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

সফল কর্মজীবনের অধিকারী  নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার 

আপডেট সময় ১২:২৭:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২
ফয়সল আহমদ রুহেল : শৈশবে কেটেছে বাবার কর্মস্থল সুরমা চা বাগানে। তখনকার সময় সুরমা চা বাগানের আশেপাশে ছিল না কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাসায় গৃহ শিক্ষকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা নেন। হাইস্কুলে যেতেন বাই-সাইকেলে। কাচা সরু রাস্তা ছিল, বৃষ্টির দিনে এসব মাড়িয়ে স্কুলে যেতেন। শিক্ষা জীবনে বেশ কয়েকটি বছর নষ্ট হয়। তারপর জ্ঞান ভান্ডার বেশ সমৃদ্ধ হয়েছিল। বিএসসি শিক্ষক হিসাবে ১৫০ টাকা বেতনে মাত্র ২২ বছর বয়সে শিক্ষকতা জীবন শুরু। তখন  বিএসসি পাশ লোক গ্রামাঞ্চলে খুব কমই ছিল। তখনকার দিনে অনেক লোভনীয় সরকারী চাকরীর মোহ ত্যাগ করে শিক্ষকতায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। জীবনের যৌবনকালে শিক্ষকতায় আসা মানুষটি মানুষ গড়ার কারখানায় কাটিয়ে দিয়েছেন ৩৯ বছর। অভিভাবক সুলভ ব্যবহার দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীর হৃদয় জয় করে নেন। নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য কমলগঞ্জ উপজেলার “মুন্সীবাজার কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের” অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। দীর্ঘ ও সফল কর্মজীবনের অধিকারী গুণী শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যারের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বর্বর পাকবাহিনী লুটতরাজ চালায়।
জন্ম :
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য ১৯৪৩ সালের ২৮ আগষ্ট হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলার সুরমা চা বাগানে (তৎকালীন ছিল সিলেট) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত নরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য, মাতা মৃত সরযু বালা ভট্টাচার্য্য। পিতা চা বাগানে চাকরী (সুরমা চা বাগান) করতেন। নরেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। তাদের স্থায়ী নিবাস মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার এর সরিশকান্দি গ্রামে।
শিক্ষাজীবন :
নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য প্রাথমিক শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করেন গৃহ শিক্ষকের কাছে। তিনি ১৯৬১ সালে জগদিশপুর জে,সি হাইস্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পাশ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে ২য় বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি পাশ করেন। এছাড়া তিনি ১৯৮১-১৯৮২ শিক্ষাবর্ষে কুমিল্লা শিক্ষক প্রশিক্ষন মহাবিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১ম বিভাগে ১১তম স্থান অর্জন করে বিএড ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্মজীবন :
কমলগঞ্জ উপজেলার “মুন্সীবাজার কালী প্রসাদ এম,ই বিদ্যালয়” তখন সবেমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়ে প্রথম বারের মত ১৯৬৫ সালে ছাত্রদের কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড শর্তাধীন (একজন বিএসসি পাশ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে) এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেয়। তখন শিক্ষাবোর্ডের সেই শর্ত পূরন করতে বিএসসি শিক্ষক হিসাবে ১৫০ টাকা বেতনে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য  ১৯৬৫ সালের ২৫ অক্টোবর ঐ বিদ্যালয়ে  বিজ্ঞান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০০২ সালে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। একই স্কুলে একটানা ৩৯ বছর শিক্ষকতার পর ২০০৪ সালের ২৮ আগষ্ট প্রধান শিক্ষক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য, প্রধান শিক্ষক হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ক্রীড়া শিক্ষক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই স্কুলের ১২৭ বৎসরের ইতিহাসে এক নাগাদে কোন শিক্ষক এতদিন শিক্ষকতা করেন নাই, যা স্যারের চাকুরী জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি এবং যে কারনে তিনি গর্ববোধ করেন।
শৈশব জীবন :
তখনকার দিনে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলার সুরমা চা বাগানে বা তার আশেপাশে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কেটেছে বাসায় গৃহ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। স্কুল জীবন শুরু হয় ১৯৫৫ সালে আগরতলা “নেতাজী সুভাষ বিদ্যা নিকেতন” এ সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে। নবম শ্রেনী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়ে বাসস্থান পরিবর্তনের কারনে ১৯৫৮ সালে চলে যান শিলং। সেখানে “লাবান বেঙ্গলি বয়েজ হাইস্কুল” এ আবার নবম শ্রেনীতেই ভর্তি হন শিক্ষা বোর্ড পরিবর্তনের কারনে। সেখানে ১ বছর পড়ার পর দশম শ্রেনীতে উঠে ১৯৫৯ সালে পারিবারিক কারনে চলে আসতে হয় বাবার চাকুরিস্থল সুরমা চা বাগানে। ১৯৫৯ সালে আবার নবম শ্রেনীতে ভর্তি হন বাগান থেকে ৫-৬ মাইল দুরে “জগদিশপুর জে,সি, হাইস্কুলে”। স্কুলে যাতায়াত ছিল খুবই কষ্টকর। বাই সাইকেলে স্কুলে যেতেন। কাচা সরু রাস্তা ছিল, বৃষ্টির দিনে খুবই কষ্ট হত। কিছুটা পথ রেল লইনের পাশ দিয়ে যেতে হত। দুইটি লম্বা রেলওয়ে ব্রীজ পার হতে হত খুবই সাবধানে সতর্কতার সাথে সামনে পিছনে ভালো করে দেখে। যেকোন সময় ট্রেন চলে আসতে পারে। রেল লাইনের উপর সাইকেলের চাকা উঠিয়ে স্লিপারে পা রেখে টপকে টপকে ব্রীজ পার হতেন। এই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাশ করেন। প্রথমে কলিকাতা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড তারপর আসাম মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড এবং সর্বশেষ পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডে পড়াশোনা করার কারণে তাঁর শিক্ষা জীবনে বেশ কয়েকটি বছর নষ্ট হলেও জ্ঞান ভান্ডার কিছুটা সমৃদ্ধ হয়েছিল।
ছাত্র রাজনীতি : 
নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য ছাত্র জীবন থেকেই বিভিন্ন সংগঠন ও সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভ্যাস ছিল। তাই কলেজে ভর্তি হবার পর বড় ভাইদের (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, গুলজার আহমেদ প্রমুখ এরা ছিলেন দুই বছরের সিনিয়র) অনুপ্রেরণা এবং নিজের আগ্রহের কারনে জড়িয়ে পরলেন তদানীন্তন রাজনৈতিক সংগঠন “ন্যাপ” এর অঙ্গ সংগঠন EPSU (East Pakistan Students Union)এর সঙ্গে। তখনকার ছাত্র রাজনীতি ছিল শুধু ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেই সময় সিলেটের ছাত্র রাজনীতির প্রধান বিষয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় সিলেটে হবে নাকি চিটাগাং এ হবে এই নিয়ে মতানৈক্য ছিল। বিশ্ববদ্যালয় সিলেটেই প্রতিষ্ঠা হোক এই দাবি নিয়ে উনারা সিলেটের সকল স্তরের ছাত্ররা সিলেট শহরে মিছিল, মিটিং, পোষ্টারিং করেন। তখন আইয়ূব খানের শাষন আমল। চিটাগাং এর ফজলুর কাদের চৌধুরী (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা) ছিলেন তখনকার মুসলিম লীগের খুব প্রভাবশালী মন্ত্রী। তাই তাঁর প্রভাবেই অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্ধারন করা হয় চিটাগাংয়ে। ফলে সিলেটবাসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঞ্চিত হন। এমসি কলেজ থেকেই কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৬৩ সালে এইচএসসি পাশ করেন নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য। দুর্ভাগ্যবশত বিএসসি তে ভর্তি হওয়ার সময় বিশেষ কারনে কিছু দেরী হয়ে যাওয়ায় হোস্টেলে সিট পেলেন না এবং তখন সিলেটে থাকার মত এমন কোন সুবিধা না থাকায় এমসি কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না। তখন মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ কোথাও কোন কলেজে বিএসসি পড়ার সুযোগ ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হলেন। অনার্স পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেখানে অনার্স ছিল না। তাই পাশ কোর্সেই ১৯৬৫ সালে ২য় বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি পাশ করেন তিনি।
যেভাবে শিক্ষকতায় আসা :
বাড়ির পা্র্শ্ববর্তী একটি অতি প্রাচীন “মুন্সীবাজার কালী প্রসাদ এমই বিদ্যালয়” তখন সবেমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয়ে প্রথম বারের মত ১৯৬৫ সালে ছাত্রদের কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড শর্তাধীন (একজন বিএসসি পাশ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে) এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিএসসি পাশ শিক্ষক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তখনকার দিনে বিএসসি পাশ লোক গ্রামাঞ্চলে খুব কমই পাওয়া যেত। নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যরে একজন প্রতিবেশী ছিলেন ঐ স্কুলের পরিচালনা কমিটির সদস্য। তিনি প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যরে কথা আলাপ করেছিলেন। হঠাৎ একদিন একজন লোক (স্কুলের দপ্তরী) নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে এসে তাঁকে একটি খাম দিলেন। খাম খুলে দেখলেন একটি নিয়োগপত্র। বি,এসসি শিক্ষক হিসাবে ১৫০ টাকা বেতনে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি অবাক হলেন, দরখাস্ত করলেন না, ইন্টারভিউ দিলেন না অথচ চাকরী পেয়ে গেলেন। শিক্ষাবোর্ডের সেই শর্ত পূরন করতে ডিগ্রী পরীক্ষার ফল প্রকাশের সাথে সাথেই ঐ বিদ্যালয়ে তিনি মাত্র ২২ বৎসর বয়সে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৫ সালে ২৫ অক্টোবর কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। যেহেতু ঐ বিদ্যালয়ে কোন বিএসসি শিক্ষক ছিলেন না এবং এলাকাতেও তখন বি,এসসি পাশ কেউ ছিল না, তাই বি,এসসি, স্যার হিসাবে শিক্ষকতার প্রথম দিকে যে পরিচিতি লাভ করেছিলেন অবসর গ্রহনের পর এখনও নিজ নামের চেয়ে বিএস সি স্যার হিসাবেই তিনি বেশী পরিচিত। অনেকেই স্যারের নাম জানেন না। কিন্তু বিএসসি স্যার বা বিএসসি বাবু হিসাবে শুধু এলাকাতেই নয় দূর-দুরান্তেও পরিচয় ছড়িয়ে যায়।
বিদ্যালয়ের জন্য যতকিছু : 
কালী প্রসাদ বিদ্যালয়টি যেহেতু হাইস্কুল হিসাবে নতুন তাই শিক্ষকতার শুরুতেই অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। বিদ্যালয় শুরুর পূর্বে এবং ছুটির পর অতিরিক্ত ক্লাস নেন তিনি। যে কারনে বিদ্যালয়টি প্রথম থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল করতে শুরু করে এবং বোর্ড থেকে স্থায়ী স্বীকৃতি লাভে সমর্থ হয়। প্রথমদিকে বিদ্যালয়টিতে শুধু মানবিক বিভাগ ছিল। তাই মেধাবী ছাত্র যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে ভবিষ্যতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হওয়ার আশা পোষণ করে তাদের সেই আশা পূরনের কোন উপায় ছিল না। তাদের অভিভাবকদের ঐকান্তিক অনুরোধ এবং শিক্ষক হিসাবে ছাত্রদের আশা পূরনের মানসিকতা তাকে প্রবল ভাবে আলোড়িত করে। তাই প্রধান শিক্ষকের সাথে পরামর্শ ক্রমে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ খোলার ব্যবস্থা নেওয়া হল এবং ১৯৬৮ সাল থেকে বিজ্ঞান বিভাগ খুলে বিদ্যালয়টি দ্বি পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হল। একমাত্র বিএসসি শিক্ষক হিসাবে প্রথম কয়েক বছর একা তাঁকে বিজ্ঞান বিভাগের সবগুলো বিষয় পড়াতে হয়েছে যে কারনে তাকে অত্যাধিক পরিশ্রম করতে হয়েছে এমনকি কোন কোন দিন রাত পর্যন্ত হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ক্লাস নিয়েছেন (তখন এলাকাতে বিদ্যুৎ ছিল না)। বিজ্ঞান বিভাগে ১ম ব্যাচে মাত্র ১টি ছাত্রীই ছিল। ঐ ছাত্রীর বাবা প্রতিদিন বিকেল বেলা স্কুলে এসে বসে থাকতেন ক্লাস শেষ হবার পর রাত্রে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। রাত্রে মেয়েতো একা বাড়ি যেতে পারবেনা। সেসব কথা এখন কেউ বিশ্বাসই করবে না। তাঁর এই কর্মোদ্যম ছাত্রদের মধ্যেও যথেষ্ঠ অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে। তারাও যথেষ্ট আশাবাদি ছিল। যে কারনে প্রথম ২ বৎসর বিজ্ঞান বিভাগে পাশের হার ছিল শতকরা ১০০ভাগ। এছাড়া ২০০২ সালে একই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ার পর দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। শিক্ষকদের (প্রায় সবাই স্যারের ছাত্র) নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে এক যোগে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী বৎসরই এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার বিগত বৎসর গুলির তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। প্রধান শিক্ষক হওয়ার আগে তিনি ক্রীড়া শিক্ষক হিসাবেও দায়িত্ব পালন কালে ছাত্ররা জেলা পর্যায় থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত অংশগ্রহন করতে সক্ষম হয়েছে।
শ্রেষ্ট শিক্ষকের পুরস্কার : 
এই গুণী মানুষটিকে শিক্ষকতায় নিজ কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৯৭ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ শ্রেনী শিক্ষক হিসাবে এবং ২০০৩ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসাবে মনোনীত করে সনদ ও পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
স্যারের যত ছাত্ররা :
কালী প্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম দিকের ছাত্ররা অনেকেই এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক হিসাবে স্ব-স্ব স্থানে স্বমহিমায় সুনামের সাথে কর্মরত থেকে সৎভাবে জীবনযাপন করছে। যে কারনে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। মাঝে মধ্যে পুরাতন ছাত্ররা মোবাইল করে সেই সব পুরাতন স্মৃতি স্মরণ করে। তাঁর ভালোই লাগে, শিক্ষক হিসাবে ইহাই তাঁর বড় প্রাপ্তি। শ্রেনী শিক্ষক থাকা অবস্থায় অনেক গরীব শিক্ষার্থী যারা সময়মত বেতন অথবা পরীক্ষার ফিস না দেওয়ার কারনে পরীক্ষা দেওয়া হতে বঞ্চিত হচ্ছিল তাদের অনেকেরই বেতন বা পরীক্ষার ফিস ইত্যাদি নিজেই পরিশোধ করেন। সেইসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু শিক্ষকের এই অবদানের কথা এখনও বলে বেড়ায়। দীর্ঘদিন একই স্কুলে শিক্ষকতা করার কারনে নিজ ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং অনেক  মেম্বার নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যরে প্রাক্তন ছাত্র। স্যারের প্রাক্তন ছাত্র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সেনা বিভাগে, সরকারী আমলা, অধ্যাপক, ব্যাংকার হিসাবে চাকুরীরত অথবা অবসর গ্রহণ করেছে।
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড :
১৯৮১-১৯৮২ শিক্ষাবর্ষে কুমিল্লা শিক্ষক প্রশিক্ষন মহাবিদ্যালয়ে প্রশিক্ষনে থাকা কালীন সময়ে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যোগদান করে অনেক সনদ ও পুরষ্কার পান। কবিতা আবৃত্তি, নাটক ও টেবিল টেনিস খেলাতে ১ম, ক্যারাম বোর্ড খেলাতে ২য় হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার জেলা শিল্প কলা একাডেমির উদ্যোগে জেলা ব্যাপী নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেই প্রতিযোগিতায় “সূর্যমূখী নাট্ট সংস্থা” সহ সমস্ত জেলা থেকে মোট ১৩টি দল অংশ গ্রহন করে। এই প্রতিযোগিতায় তিনি মৌলভীবাজার জেলার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে সনদ এবং পুরষ্কার লাভ করেন। এছাড়াও স্কুলে ও এলাকাতে তিনি অনেক নাটকে অংশগ্রহন করে সুনাম অর্জন করেন। প্রশিক্ষনের কারনে শিক্ষকতায় উৎকর্ষ সাধন হয় এবং প্রনালীবদ্ধ উপায়ে ছাত্রদের শিক্ষাদান করে তাদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে সহায়তা করেন। ১৯৯৬ সালে শিক্ষাক্রম বিস্তরন কার্যক্রমের উপর প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। যা পেশাগত মান ও শ্রেনী কক্ষে শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নের উপর সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্বল্পকালীন প্রশিক্ষন নিয়ে নিজের পেশাগত মান বৃদ্ধি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহজবোধ্য উপায়ে শিক্ষাদান করার চেষ্টা করেন।
পরীক্ষক : 
শ্রদ্ধেয় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে প্রথম এসএসসি পরীক্ষার গণিত বিষয়ের পরীক্ষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং পরবর্ত্তী বৎসর গুলিতেও পরীক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। অত:পর ২০০০ সালে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের জন্মলগ্ন থেকেই পরীক্ষক হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে গণিত বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রশিক্ষণ : 
শ্রদ্ধেয় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য অবসর গ্রহন করার পর ২০০৬ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের ফিমেল সেকেন্ডারি স্কুল এসিসট্যান্স প্রজেক্ট থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কমিটির এবং পিটিএ সদস্যদের উন্নত মানের শিক্ষাদান পদ্ধতি, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার ব্যাপারে প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য কমলগঞ্জ উপজেলা থেকে একমাত্র নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্যকে নির্বাচিত করা হয় এবং এ ব্যাপারে ঢাকা থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অত্র উপজেলার শিক্ষক ও কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
শিক্ষকদের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা : বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছিলেন অবহেলিত, তাদের মাসিক বেতনও ছিল নগন্য, সরকার থেকে তারা কোন আর্থিক সুযোগ সুবিধা পেতেন না তাই শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষকদের সার্বিক উন্নয়নের ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার। যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিন মৌলভীবাজার জেলার শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং অবসর গ্রহনের দিন পর্যন্তও এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির মোট চার জন উপদেষ্টার মধ্যে তিনিও একজন উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে শিক্ষকরা শতভাগ সরকারী বেতন পাচ্ছেন।
দায়িত্ব পালন : 
গুণী শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য “দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি” কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে “সুশাসনের জন্য নাগরিক” (সুজন) কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কমলগঞ্জ গণমহাবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সরিষকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (স্যারের পূর্ব পুরুষের দান করা জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত) পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসাবে কয়েকবার দায়িত্ব পালন করেন। গবিন্দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। “বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খীষ্টান ঐক্য পরিষদ” মৌলভীবাজার জেলা শাখার শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এবং একই সংগঠনের কমলগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্র জীবনের ঘটনা :
নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, এমসি কলেজে মুহিব আলী স্যার নামে একজন অংকের অধ্যাপক ছিলেন। খুবই বৃদ্ধ এবং রসালাপী। ক্লাসের বাইরে সিলেটি ভাষায় কথা বলতেন। একদিন অংকের ক্লাস শেষে তিনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেছেন হঠাৎ আমরা যারা ক্লাসের ১ম সারিতে বসতাম আমাদের নজরে পড়লো যে স্যার উনির চশমার কেইচটা ভূলবসত টেবিলের উপর ফেলে গেছেন। আমরা কয়েকজন চশমার কেইচটা নিয়ে স্যারের সুনজরে পড়া এবং একটু বাহবা পাওয়ার আশায় দৌঁড়ে স্যারের কাছে যেতেই স্যার পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকালেন, আমরা চশমার কেইচটা স্যারের হাতে দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করলাম। মুহুর্তেই সব ম্লান হয়ে গেল। স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন “তোমরা ত ভালা মাইনষর বাচ্চা নায়।” আমরা অবাক হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পরেই স্যার হেসে বললেন “রাগ করছনি হুনো, আইজ কাইল ভালা মাইনষে কিচ্ছু পাইলে ফিরৎ দেইননা, পকেটো বরি রাখি দেইন। এর লাগি কইছি তোমরা ভালা মাইনষর বাচ্চা নায়।” মুহুর্তে আমাদের ভুল ভেঙ্গে গেলো, ম্লান মুখে হাসি ফুটলো। স্যার আমাদের পিঠ চাপড়ে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। স্যারের দোয়া ও স্নেহ আমৃত্যু মনে থাকবে।
শিক্ষকতা জীবনের ঘটনা : (১) নিহারেন্দু ভট্টাচার্যের  জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তারপরও তিনি দু’একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন- আমাদের স্কুলের পাশেই বাজার। তখন স্কুলের সীমানা দেয়াল না থাকায় টিফিনের সময় কিছু কিছু ছাত্র বাজারে চলে যেত। একদিন দেখলাম টিফিন শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়ে গেছে, ছেলেরা দৌড়ে দৌড়ে স্কুলে এসে ডুকছে। বেশ কিছু সময় পর দেখলাম দশম শ্রেণীর একটি ছেলে খুব আস্তে আস্তে  নবাবি কায়দায় হেটে হেটে স্কুলে এসে ঢুকছে। আমি দপ্তরী পাঠিয়ে ঐ ছেলেকে অফিস রুমে আমার কাছে এনে টিফিনের পর দেরীতে স্কুলে আসার কারন জিজ্ঞাসা করলে সে বললো “এভাবেত অনেক ছেলেই দেরীতে আসে।” তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা শুনে আমার রাগ হলো। আমি তাকে বেত্রাঘাত করে শাসন করলাম (তখন বেতের প্রচলন ছিলো)। এর ৩/৪ দিন পর একদিন স্কুল ছুটির পর বাইসাইকেলে বাড়ী আসার পথে একজন খুব সাদাসিদে ধরনের ভদ্র লোক, আমাদের এলাকার লোক বলে মনে হলো না, আমার বিপরীত দিক থেকে আসছেন। আমাকে সাইকেল থামানোর ইঙ্গিত দিলেন। নেমে কারন জিজ্ঞাসা করলে জানতে চাইলেন হাইস্কুলটা কতদূর? কৌতুহল হলো। জানতে চাইলাম হাইস্কুলে উনার কি দরকার। উত্তরে বললেন, এই স্কলে বিএসসি স্যার নামে একজন শিক্ষক আছেন উনার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন। আরো অবাক হলাম জীবনে উনাকে কখনও দেখিনি অথচ আমাকে উনার প্রয়োজন। আমার পরিচয় দিলাম যে আমিই বিএসসি স্যার। সঙ্গে সঙ্গে এই রাস্তার উপরেই মাথা নুইয়ে আমার দুই পা জড়িয়ে ধরে বললেন উনার ছেলে আমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছে, ওস্তাদ এর সঙ্গে বেয়াদবি করা মহাপাপ তাই ছেলের হয়ে উনি ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। তাড়াতাড়ি নুইয়ে উনাকে হাত ধরে দাঁড় করে উনার ছেলের নাম জিজ্ঞাসে করে জানতে পারলাম, যে ছেলেটি ঐ দিন টিফিনের পর স্কুলে আসতে দেরী করেছিল সেই ছেলেটির বাবা উনি। উনার বাড়ী এখানে নয়, উনার ছেলে এখানে এক বাড়ীতে লজিংয়ে থাকে। ঐ লজিং মাষ্টার উনাকে খবর দিয়ে বিষয়টা জানিয়েছেন। আমি উনাকে শান্তনা দিয়ে বললাম যে আপনি অনুশোচনা করবেন না আমি এসব কথা ভুলে গেছি। উনাকে শান্তনা দিয়ে এবং উনার উপযুক্ত অভিভাবকত্বের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলাম। মনে মনে ভাবলাম এই ধরনের অভিভাবক আছেন বলেই আমরা শিক্ষকরা এখনো সমাজের বুকে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে টিকে আছি। অনেক বছর পর একদিন শমসেরনগর রেল ষ্টেশনে একটি সুঠাম দেহের অধিকারী লোক আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে দোয়া করতে বললো। আমি প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। সে তার নাম ও বহুদিন আগের ঐ ঘটনাটির ইঙ্গিত দিয়ে বললো “স্যার আপনার বেতের আঘাতেই আজ আমি মানুষ হয়েছি, এখন আমি সেনাবাহিনীতে চাকরী করছি।” প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো, প্রাণ ভরে তাকে আশীর্বাদ করলাম। শিক্ষক হিসাবে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি আছে।
(২) একদিন কোথায় যেন যাচ্ছি, হঠাৎ একটি গাড়ী আমার পাশেই এসে থেমে গেল এবং গাড়ী থেকে নেমে একজন ভদ্র লোক আমার নিকট এসে পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। আমি প্রথম চিনতে পারিনি পরিচয় দেয়ার পর চিনতে পারলাম। আমার প্রাক্তন ছাত্র সে এখন খুবই ভালো অবস্থায় আছে। অনেক টাকা রোজগার করে, একটি প্রাইভেট ক্লিনিকেরও মালিক। কথায় কথায় আমার শিক্ষকতার অধীনে তার অনেক স্মৃতি তুলে ধরলো। এক পর্যায়ে বললো যে সে একদিন একাউন্টস অফিসে গিয়েছিল তার একটি বিল জমা দিতে। বিলটি ছিল একটু জটিল। যার কাছে বিলটি জমা দিল তিনি মুহুর্তেই বিলটি হিসাব করে সব ঠিক করে দিলেন। সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো যে উনি কিভাবে এই জটিল বিলটি এত সহজে হিসাব করে ফেললেন। উত্তরে ঐ ভদ্রলোক নাকি তাকে বলেছিলেন যে তিনি অংকে খুবই কাঁচা ছিলেন, উনার একজন স্যার ছিলেন নিহারেন্দু ভট্টচার্য্য যার নিকট থেকে উনি অংক শিখে পারদর্শী হয়েছেন। তারা উভয়ই আমার ছাত্র হিসাবে পরস্পরের নিকট পরিচিত হলো। এই কথাগুলো শুনে আমার শিক্ষকতা জীবন স্বার্থক হলো এবং আমি পরম করুনাময়ের কাছে হাজারো শুকরিয়া আদায় করলাম।
পারিবারিক অবস্থা: 
শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য এর সহধর্মিনী কনক প্রভা চক্রবর্তী একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরে চলে গেছেন। নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য ২ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক। সবার বড় মেয়ে কৃষ্ণা ভট্টাচার্য্য; বিএ; বিএড (১ম শ্রেনী) উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, বিবাহিত। স্বামী- সরকারী চাকুরীজীবি। বড় ছেলে নবেন্দু ভট্টাচার্য্য; এল,এল,বি (সম্মান); এল,এল,এম; ঢাকা সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী। বিবাহিত। স্ত্রী-বি,এ (সম্মান) এম,এ (ইংরেজী) সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ছোট ছেলে নির্মলেন্দু ভট্টাচার্য্য; বিবিএস (সম্মান), এমবিএস; (ব্যবস্থাপনা)-ব্যাংক এ চাকুরিরত। বিবাহিত। স্ত্রী-বিএ (সম্মান) এমএ (লোক প্রশাসন), সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।
নিরক্ষর মুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ :  
শিক্ষার মান উন্নয়ন তথা দেশকে নিরক্ষর মুক্ত করতে শিক্ষকদেরকে অগ্রনী ভুমিকা পালন করতে হয়। তাই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের যখন দেখেন স্কুলে না গিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে অথবা ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন খুবই মর্মাহত হন নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য। সাধ্যানুযায়ী তাদেরকে অথবা তাদের অভিভাবককে উদ্বুদ্ধ করেন তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর জন্য। শ্রদ্ধেয় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার আশাবাদী এই দেশে দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রম যত বেগবান হবে শিক্ষার হার তত বৃদ্ধি পাবে এবং নিরক্ষর মুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। যার ফলে বাংলাদেশ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে পৃথিবীর বুকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং সুযোগ পেলে সেই কাজে সাধ্যানুযায়ী অবদান রাখতে পারেন সেই চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
১৯৭১ সালের কিছু স্মরণীয় ঘটনাবলী 
পাকহানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুমন্ত অবস্থায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর ট্যাংক, কামান, মেশিনগানের গুলি ও বেয়নটের মাধ্যমে নির্মম, নিষ্ঠুর, নৃশংস, বর্বরতার মাধ্যমে তাদের পৈশাচিকতার ও উম্মাদনার যাত্রা শুরু করে। ২৬ মার্চ বাংলার ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে খোদিত হয় একটা নাম- ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’।
নিহারেন্দ ভট্টাচার্য্য স্যারের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বর্বর পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় লুটতরাজ চালায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কিছু স্মরণীয় ঘটনাবলীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য বলেন, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তখনকার এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে কিছু সংখ্যক পাকিস্থানপন্থি তথা রাজাকার, আলবদর, আল সামস ছাড়া প্রায় সবাই কোন না কোনভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বাস্তু হারা হয়েছেন, আত্মাহুতি দিয়েছেন। মা বোনেরা নির্যাতিত হয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছেন। আমিও এদেরই মধ্যে একজন যে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি। ৭১ এর এপ্রিলের মাঝামাঝি হবে, শেরপুরের অবরোধ ভেঙ্গে পাক বাহিনী মৌলভীবাজার শহরে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে সরাসরি কৈলাশহর বোর্ডার অভিমুখে এসে শমসেরনগর ঘাটি স্থাপন করে। যার ফলে এ অঞ্চলের লোকের ভারত যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে অনেকেই শমসেরনগর হয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমার পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই ভারতে গেছেন কিন্তু আমি যাইনি। আমার বিশ্বাস ছিল যে আমি শিক্ষকতা করি, কারও সাথে আমার শত্রুতা নেই তাই কেহ আমার কোন ক্ষতি করবে না। পাক বাহিনী এ অঞ্চলে আসার পরই কিছু সংখ্যক বিপথগামী পাকিস্থান পন্থি তাদের সাথে মিশে গেল এবং পাক বাহিনী এদের সহায়তায় প্রতিদিনই বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে লোটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষন, হত্যা ইত্যাদি নানা ভাবে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর নির্যাতন করতে লাগলো। আমার বাড়ী প্রধান সড়কের পাশে থাকায় রোজই দেখতাম আর্মির গাড়ি বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে মানুষকে নির্যাতন করছে, অগ্নিসংযোগ করছে। তবুও আমার ধারনা ছিলো যে আমার বাড়ীতে কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না। কিছু দিন পরই আমার ভুল ভেঙ্গে গেলো। দিনটা হবে এপ্রিলের শেষ ভাগের। দুপুর বেলা খেতে বসেছি হঠাৎ আমার গ্রামেরই একটি লোক দৌঁড়ে এসে বললো গ্রামে আর্মি ঢুকেছে। খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলাম। বুঝলাম যে আর রেহাই নেই। অবশ্যই আমার বাড়িতে আসবে। পরিবারের সদস্য তখন আমি, আমার বিধবা মা এবং কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই। ছোট ভাইকে তখন তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির পেছনের বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে বললাম। দুই ভাই এক সঙ্গে যেন না মরি, এক ভাই যেন বেঁচে যায়। আমি অসুস্থতার ভান ধরে বিছানায় শুয়ে রইলাম এবং মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষন পরই দলবল নিয়ে আমার বাড়িতে প্রবেশ করলো পাক বাহিনী এবং সরাসরি ঘরে এসে ঢুকে আমাকে বিছানায় দেখে বললো ‘‘ কিহা হুয়া’’? আমি কম্পিত স্বরে বললাম “বখার (জ¦র) হুয়া”। চা বাগানে জন্ম হওয়ায় হিন্দি ভাষী শ্রমিকদের সঙ্গে থেকে কিছুটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দি শিখে ছিলাম, হিন্দি ও উর্দুর মাঝে বেশ মিল আছে। আমাকে হাত ধরে টেনে তুলে উঠানে নিয়ে এলো। চেয়ে দেখলাম আমি যাদের আপন মনে করতাম সেই সব কপট প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে আছে এবং আঙ্গুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছে। একটি আর্মি আমার ঠিক সামনে এসে বললো “ গোল্ড নিকালো, রুপিয়া নিকালো”। আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে বললাম যে আমি গরীব মাষ্টার আমার টাকা পয়সা নেই। পাশে দাঁড়ানো সেই সব বিশ্বাসঘাতকেরা আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে ইঙ্গিতে তাদের বুঝিয়ে দিলো যে আমার যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে। আর্মিরা বারবার আমাকে সোনাদানা টাকা পয়সা দেওয়ার জন্য বলছে আর আমি বারবার নিজেকে গরীব বলে বোঝানোর চেষ্ঠা করছি। এক পর্যায়ে তারা রেগে গেলো। একটি আর্মি কাঁধ থেকে রাইফেল হাতে নিয়ে আমার দিকে তাক করতেই আমার সাদা কাপড় পড়া বিধবা মা দু হাত প্রসারিত করে আমার সামনে এসে আমাকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। মায়ের সামনে যেন ছেলের মৃত্যু না হয়। মায়ের এই আত্মত্যাগ দেখে মনে হয় তার একটু করুণা হলো। রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ওরা ঘরে প্রবেশ করলো। পাশেই ছিলো একটি বড় সিন্দুক যার উপরে বিছানা করা ছিলো। বিছানা টেনে নিচে ফেলে দিতেই সিন্দুকের দুই পাশে বড় দুইটি তালা দেখে বললো “ ইয়েতো বড়া সামানা হায়, ইসকা আন্দার কিহা হায়, জলদি খোল”। চাবি দিয়ে তালা খুলে দিতেই সিন্দুকের উপরের ডালাটা ওরাই উপরে তুলে ধরলো। ভিতরে ছিলো তামা কাসার বাসনপত্র এবং একটি ট্রাংক, যার ভিতরে কিছু টাকা পয়সা এবং মায়ের কিছু গয়নাপাতি ছিলো। ট্রাংকের তালা খুলে দিতেই ওরা ট্রাংকের উপর হুমরি খেয়ে পড়ে যে যা পারে পকেটে পুরে নিলো। এদিকে, তাদের সহায়তাকারী দেশীয় দুষ্কৃতিকারীরা ঘরে ঢুকে ঘড়ি, ট্রানজিস্টার সহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিষপত্র এবং আলমিরাতে রাখা ভালো কাপড় চোপর সহ সবকিছু বেডকাভার দিয়ে গাঁট বেঁধে যে যেভাবে পারে নিয়ে নিলো। সবকিছু যেন চোখের নিমিষে ঘটে গেল। আস্তে আস্তে আর্মিরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ও মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। সবশেষে যে আর্মিটা ছিল সে বাহির হবার সময় আমার দিকে আঙ্গুল ইশারা করে মা কে বললো “ ইয়েতো ড়াড় কা বেটা হায় ইসলিয়ে খতম নাই কিয়া, হামারা ভি মাই হায়”। বুঝলাম তার মা ও বোধ হয় আমার মায়ের মতো ড়াড় (বিধবা)। তাই আমাকে রক্ষা করতে আমার মা সামনে দাঁড়াতেই তার মায়ের কথা মনে পরে গেছে। তাই আমাকে গুলি করেনি। ওরা যাবার পর ভাই বেরিয়ে এলো। তিনজন মিলে ভাবলাম যে যাদেরকে আমরা আপন বলে ভাবতাম তারা কেহই আপন নয়। এদের মধ্যেই কেহ কোন দিন সম্পত্তির লোভে আর্মির কাছে গিয়ে আমাদের নামে খারাপ কিছু বলে আমাদের ধরিয়ে দেবে। আর্মিরা শমসেরনগর ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলবে। তাই একটি ভাই যেন বেঁচে থাকতে পারি সেই চিন্তা করে আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটি লোক আছে যে গোপন পথে ভারতে লোক আনা নেওয়া করে, তাকে খবর দিয়ে বাড়িতে এনে ভাইকে ভারতে দিয়ে আসতে বললাম। ভাই আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছিলো না। জোর করে তাকে পাঠালাম এবং বলে দিলাম যে জীবনেও হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে, তুমি প্রতি বৎসর বাবার মৃত্যু তারিখে ছেলে হিসাবে যে কাজটুকু করা তা করবে, যা এতোদিন আমি করে এসেছি। ঐ লোকটিকে তার চাহিদা মতো অর্ধেক টাকা দিলাম এবং বাকি টাকা ভাই ভারতে পৌঁছার পর তার হাতের লেখা কাগজ পেলে দেব। ভাইকে গোপনে বলেছিলাম যে তুমি ভারতে পৌঁছার পর ভারতের চারমিনার সিগারেটের পেকেটের কাগজে তোমার পৌঁছা সংবাদ লিখে দিও। লোকটি কথা রেখেছে। ভাই এর হাতের লেখা কাগজ পেয়ে বাকি টাকা দিলাম। প্রবাদ আছে “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়”। তখন কাউকে বিশ্বাস  করতে পারছিলাম না। ঐ লোকটি ইচ্ছা করলে আমার ভাইকে পাক আর্মির কাছে তুলে দিতে পারতো তাই আগে সম্পূর্ণ টাকা দেইনি। ভাই ভারতে পৌঁছার পর স্বস্তি বোধ করছিলাম, এখন মরে গেলেও আপসোস নেই। এক ভাইতো বেঁচে থাকবে। আমাদের আশপাশের কিছু লোক যারা আগে আমার মতো দেশের মায়া ত্যাগ করে ভারতে যায়নি এখন নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। আমরা সবাই গোপনে একত্রে মিলিত হয়ে এক গভীর রাতে বাড়ি ঘর, ধন সম্পদ, সাজানো সংসার সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে নিজের প্রান বাঁচাতে এক বস্ত্রে বেরিয়ে গেলাম ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমার দুইটি মুসলিম ছাত্র মনতাজ মিয়া ও আদর মিয়া আমাকে অনেক সাহায্যে করেছে। যাওয়ার দিনও গভীর রাতে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। তারা কেহই এখন জীবিত নেই, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। অনেক দুর্গম পথ পেরিয়ে সারা রাত হেঁটে পরদিন দুপুরে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছলাম। প্রমানিত হলো নিজের প্রানের চেয়ে বড় দুনিয়াতে কিছু নেই। ভাই এর সঙ্গে মিলিত হলাম। আমার চেনা জানা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হচ্ছে। আমারও ইচ্ছা ছিলো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার, কিন্তু আমরা ভারতে যাওয়ার কয়েকদিন পরেই আমার এক সম্পর্কিত ভাই আমার ছোট ভাইকে নিয়ে গেলেন কোহিমা (নাগাল্যান্ডের রাজধানী)। তিনি সেখানে বড় পদে চাকরী করেন, ছোট ভাইকে ঢুকিয়ে দিলেন চাকুরীতে। তাই মাকে একা ফেলে আমার আর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হলো না। এই আক্ষেপ সারা জীবন থেকে যাবে। প্রায় সাত মাস ভারতে থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বাড়িতে ফিরে এলাম। কিছুই নাই, সম্পূর্ণ ময়দান। শুধু একটি জরাজীর্ণ ঘর অর্ধ ভগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে। জানতে পারলাম এক লোক নাকি আমার বাড়ি দখল করে এই ঘরে ছিলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পেয়ে সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। সে বাড়িতে থাকায় এই লাভটুকু হয়েছে যে আর্মিরা বাড়ি জ্বালিয়ে  দেয়নি। আমার আশপাশে খালি বাড়ি যতগুলি ছিল সব আর্মিরা জ্বালিয়ে  দিয়েছে। একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। পরিধানের বস্ত্র ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। সেই থেকে ৫০ বৎসর পর আজ এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছি। কবি বলেছেন “ যোগ্য যে ভাগ্য তার কবু নাহি টুটে, ডুবিলেও তরী তার পুনঃ ভাসি উঠে”। পরম করুণাময়ের কৃপায় আমার ডুবন্ত তরী ভেসে উঠেছে। ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনীসহ ভালোই আছি। পরম করুণাময়ের কাছে চির কৃতজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার জীবনে ঘটে যাওয়া করুণ ঘটনা গুলির চিত্র আমার জীবনীতে প্রতিফলিত না হলে দুঃখের দিন গুলির বর্ণনা অনেকের কাছে অজানা থেকে যাবে।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কমলগঞ্জ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
তিনি ছাত্র জীবনে দেখতেন যে সমাজে সবাই শিক্ষকদের শ্রদ্ধা ও মান্য করে এবং শিক্ষকরাই অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেন। যা ছাত্রদের পরবর্তীতে সমাজ তথা দেশের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষকদের মর্যাদা শত গুন বৃদ্ধি পায়। সেই থেকেই শিক্ষকতার প্রতি মোহ জন্মায় নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যারের। তিনি ছাত্র জীবনে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দীর্ঘদিন একই স্কুলে শিক্ষকতা করার কারনে নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যারের প্রাক্তন ছাত্ররা স্ব-স্ব স্থানে স্বমহিমায় সুনামের সাথে কর্মরত। গরীব শিক্ষার্থীর জন্য তিনি সাহায্যের হাত সবসময় সম্প্রসারিত করেছেন। সেইসব শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত। স্যারের অনেক প্রাক্তন ছাত্ররা পথে প্রান্তরে দেখলে পা ছুঁয়ে সালাম করে। তখন প্রাণটা জুড়িয়ে যায় স্যারের। শিক্ষকতা জীবনে ইহাই তাঁর বড় প্রাপ্তি। কাজের সঠিক মূল্যায়ন মানুষের ভিতর অনুপ্রেরনা যোগায়, মানুষ নব উদ্যোমে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্যারের বেলায়ও ব্যতিক্রম হয়নি। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নিহারেন্দু ভট্টাচার্য্য স্যার মেধা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে সমাজকে উপহার দিয়েছেন অনেক কীর্তিমান। আমরা তাঁর সুদীর্ঘ আয়ু এবং সুস্থতা কামনা করছি।