সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরিতে প্রায় দেড় লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

- আপডেট সময় ০৮:১২:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
- / ৬ বার পড়া হয়েছে

কুলাউড়া প্রতিনিধি : মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় প্রথম প্রান্তিক মূল্যায়ন পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র তৈরি, ক্রয় ও বিক্রয় মূল্যে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া প্রশ্নপত্র তৈরি কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলায় ভূল প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা দেয় বিভ্রান্তি। শিক্ষা অফিসের বড় কর্তাদের পছন্দের শিক্ষকদের নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করা হয় এবং ছাপা থেকে প্রতিটি স্কুলে বিক্রয় পর্যন্তও চলে সিন্ডিকেট। মূলত নিজেদের অনুগত শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্ন তৈরির কাজ সম্পন্ন করে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সহকারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার প্রশ্ন তৈরি ও ছাপানো কমিটির প্রধান সৌরভ গোস্বামীর বিরুদ্ধে। এছাড়াও আরো অভিযোগ উঠেছে পতিত আওয়ামী সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত পছন্দের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেট চক্র দিয়ে শিক্ষা অফিসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদনে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এবং তাদের মাধ্যমে টাকার ভাগ পৌঁছায় সৌরভ গোস্বামীর কাছে।
উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও তা স্কুলগুলোতে বিক্রিতে এমন দূর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনায় শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন মহলের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
কুলাউড়া শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, এবছর উপজেলায় প্রায় ১৯৩টি টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম-২য় শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী ৯ হাজার ১৫৮ জন, ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৩ হাজার ৮৩৫ জন। মোট শিক্ষার্থী ২২ হাজার ৯ শত ৯৩ জন। এই হিসেবে প্রায় ২৩ হাজার প্রশ্ন ছাপাতে খরচ পড়ে ৮২ হাজার ৮১৪ টাকা। কিন্তু প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে ১ম ও ২য় শ্রেণিতে প্রতি সেট প্রশ্ন বাবদ খরচ নেওয়া হয়েছে ৭ টাকা। ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণিতে খরচ নেওয়া হয়েছে ১১ টাকা। সিলেট মহাজনপট্টিতে অবস্থিত আনোয়ারা প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ছাপা করা হয়েছে।
অথচ যে ছাপাখানা থেকে প্রশ্নপত্র ছাপানো হয়েছে এবং মৌলভীবাজার জেলার অন্যান্য ছাপা খানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১ম ও ২য় শ্রেণিতে প্রতি সেট প্রশ্ন বাবদ খরচ হয় ৩ টাকা। ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণিতে খরচ ৪ টাকা। এতে করে ওই প্রশ্ন তৈরিতে সিন্ডিকেট চক্র কেবল প্রথম প্রান্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করে প্রায় একলক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
মৌলভীবাজার জেলা শহরে থাকা প্রায় অর্ধ-শতাধিক স্বনামধন্য নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ছাপাখানা থাকলেও সহজে টাকা নয়ছয় করতে কৌশলে তা সিলেট জেলা থেকে ছাপানো হয়েছে। এর কারণ জেলার ছাপাখানাগুলোর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খরচ দেখানো। এছাড়া পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিনই ৫ম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ে প্রশ্নের ক্রমিক নাম্বারে ৭ এর পরে ৮, ৯, ১০ এবং ১১নং না দিয়ে ১২ ও ১৩ ক্রমিক নম্বার দেওয়া হয়েছে। যা চরম বিভ্রান্তিতে ফেলে কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, শিক্ষা অফিস থেকে প্রশ্নের যে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে কোনো কৈফিয়ত চাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। প্রশ্নের মান ও ধরন নিয়েও মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষকরাও কখনো কোনো পরামর্শ কিংবা মতামতও দিতে পারেন না। কেবল প্রশ্ন নয়, শিক্ষা অফিসের অনেক কাজেই এভাবেই বাধ্য হয়ে চুপ থাকতে হয় শিক্ষকদের। তারা ক্ষোভের সাথে জানান, শিক্ষা অফিসের সহকারি শিক্ষা অফিসার সৌরভ গোস্বামী পতিত ফ্যাসিবাদি সরকারের আমলে দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর থেকে বীরদর্পে নানা অপকর্ম চালিয়ে গেলেও এখনো তিনি বহাল তবিয়তে সুকৌশলে চালিয়ে যাচ্ছেন তার আগের কর্মকান্ড। তাঁর প্রশ্রয়ে স্বৈরাচারের দোসরদের দৌরাত্ম এখনো কুলাউড়া শিক্ষা অফিসে চলমান।
অফিসের যে কোনো সভা, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং যে কোন প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালনসহ শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপন কমিটি কিংবা প্রশ্ন তৈরিতেও তার প্রশ্রয়ে থাকছেন স্বৈরাচারী সরকারের দোসর ও চিহ্নিত বিতর্কিত শিক্ষককরা। ব্যক্তিগত জীবনে নানা বির্তকিত কর্মকান্ডে অভ্যস্ত আলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সামছুন নাহার বেগম। তাঁর বাবা নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামীলীগের কুলাউড়া উপজেলা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি ও হাজিপুর ইউনিয়ন কমিটির সাবেক সভাপতি ছিলেন। মনে প্রাণে আওয়ামীপ্রীতি থাকা ওই শিক্ষক এখনো মুজিব কোর্টে আসক্ত। এমনকি ৫ আগস্টের পরও তার স্কুলে পতিত সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা ও তাঁর বাবার ছবি টানানো ছিলো। তার মতো একই আদর্শে বিশ্বাসী প্রধান শিক্ষক আব্দুল বাছিত, মিলন চন্দ্র নাথ, আব্দুল মছব্বির শামীম, নজমুল ইসলাম, জ্যোতি বিকাশ, অরুন্ধুতি ভট্টাচার্য্যরা থাকেন শিক্ষা অফিসের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহনের সভায়। মূলত শিক্ষক আব্দুল বাছিত ও সামছুন নাহারের নেতৃত্বে অন্য শিক্ষকরা অফিসের সকল কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকেন। উল্লেখিত শিক্ষকগণ ছাড়াও এবছর প্রথম প্রান্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রস্তুত, বিক্রয় ও বিতরণে সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন শিক্ষক সামছুন নাহার বেগম, আব্দুল বাছিত, অনন্ত কুমার দত্ত, সজ্জিত দাশ, প্রশান্ত দত্ত, মিলন চন্দ্র নাথ, রন্টু চন্দ্র শীল, অরুন্ধুতিসহ অনেকেই। যাদের অনেকেরই তাদের স্কুলের অফিসে ৫ আগস্টের অনেক পরেও পতিত সরকারের প্রধান ও তার বাবার ছবি টানানো ছিলো। এমনকি মনে প্রাণে তা এখনো লালন করছেন। উপজেলা শিক্ষা অফিসে ৫ আগস্টের আগের মতো তাদের এমন দাপটের বিষয়টি চাউর হলে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে শিক্ষক, অভিভাবক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার মধ্যে। আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের এমন দৌরাত্ম কে থামাবে এমনটা এখন দেখার অপেক্ষায় শিক্ষক, অভিভাবকসহ কুলাউড়ার সচেতনমহল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কথা হয় সিলেট মহাজন পট্টিতে অবস্থিত আনোয়ারা প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী মো. মনিরুজ্জামানের সাথে। বলেন, ১ম ও ২য় শ্রেণীর প্রশ্ন প্রতি সেট ৩ টাকা ও ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর প্রতি প্রশ্ন সেটের খরচ ৪ টাকা করে। সিলেটের ১৪টি উপজেলায় আমাদের ছাপাখানা একই মূল্যে প্রশ্নপত্র তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে সহকারি শিক্ষা অফিসার সৌরভ গোস্বামী বলেন, প্রশ্নপত্র তৈরিতে টাকা আত্মসাতের অভিযোগটি সঠিক নয়। প্রশ্ন তৈরি করার পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে যাতায়াত খরচ, শিক্ষকদের সম্মানী, খাবারসহ শিক্ষা অফিসের বিভিন্ন খাতে খরচ করা হয়। ক্লাস্টার ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রশ্ন তৈরিতে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন তৈরির জন্য প্রতিটি স্কুল থেকে স্লিপ বরাদ্দ থেকে টাকা নেয়া হচ্ছে। তাছাড়া প্রশ্ন তৈরির খরচের পুরো হিসাব এখনো করা হয়নি। প্রশ্নপত্র তৈরিতে শিক্ষক নেতৃবৃন্দরা কাজ করছেন আমরা শুধু দেখভাল করছি। প্রশ্নের ক্রমিক নম্বর কেন নেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এবারের প্রশ্ন তৈরিতে খুবই কম সময় থাকায় প্রশ্ন তৈরিতে অনিচ্ছাকৃতভাবে এই ত্রুটি হয়েছে।
বর্তমান সময়ে শিক্ষা অফিসের বিভিন্ন কার্যক্রমে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের কেন অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসকল শিক্ষকরা এসব অভিযোগ করছেন তারা কখনো শিক্ষা অফিসের কার্যক্রমে আসেননি। তারা আসলে আমরা অবশ্যই গুরুত্ব দিব। কোন শিক্ষকের প্রতি আমাদের কোন ক্ষোভ নেই। আওয়ামীপন্থী শিক্ষক বলতে আমরা কিছু জানিনা, শিক্ষকদের আমরা শিক্ষক হিসেবে দেখি। কুলাউড়ায় সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্বপালন করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. ইফতেখায়ের হোসেন ভূঁঞা বলেন, আনীত সকল অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা হবে। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার শফিউল আলম বলেন, প্রশ্ন তৈরিতে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার কোন সুযোগ নেই। কোন লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বর্তমান সময়ে কেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে সেই বিষয়টি শিক্ষা কর্মকর্তা ও ইউএনও’র সাথে কথা বলতে পারেন। শিক্ষা অফিসের বিভিন্ন কার্যক্রমে বিএনপি-জামাতপন্থি যোগ্য শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দিতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে বলবো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, সার্বিক বিষয় খোঁজ নিয়ে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো।
