সিলেট অঞ্চলের বন্যা ও বুড়িকিয়ারীর বাঁধ অপসারণ প্রসঙ্গে — খছরু চৌধুরী
- আপডেট সময় ১১:২৯:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪
- / ৩২৮ বার পড়া হয়েছে
সিলেট অঞ্চল জুড়ে এতো ঘন-ঘন বন্যা হচ্ছে। বর্ষার মৌসুম যেন মানুষের মধ্যে আতংকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই যদি একটা প্রশ্ন করি। অর্থাৎ এতোটা দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় হাজার হাজার বছর আগে কেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা বসতি গড়েছিলেন? তখন কি ভারী বৃষ্টিপাত আর ঘন-ঘন বন্যা হতো? উত্তরটা খুব সহজ। ২০০ বছরের হিসাব ধরে আমরা যদি একটা পরিসংখ্যান তৈরি করি; তাহলে দেখা যাবে; স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৮০’র দশক থেকে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪৩ টি বর্ষা মৌসুমের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ; এর আগের ৪৩ টি বর্ষা মৌসুমের গড় বৃষ্টি পাতের চেয়ে অনেক কম। আর পূর্ববর্তী ১০৪ বছরের গড় বৃষ্টি পাতের পরিমাণও বর্তমান সময়ের গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। অবিভক্ত ভারতের এই অঞ্চলে ভারতের চেরাপুঞ্জি রয়েছে; যেখানে ১২ মাস বৃষ্টি হয়। আর আমাদের এখানে বাংলাদেশের চেরাপুঞ্জি বলা হয় শ্রীমঙ্গল উপজেলাকে। এক কথায় ষড়ঋতুর বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল হলো অধিক বৃষ্টিপাত প্রবণ এলাকা। এখানকার ভূপ্রকৃতির গঠনে পাহাড়ি-টিলা, সমতলভূমি, অসংখ্য নদনদী, খাল-বিল ও হাওর-বাওর ও প্রাকৃতিক ঝর্ণা রয়েছে। বর্ষার মৌসুমে এসব হাওর-বাওর, ছোট বড় নদনদীর পানি প্রবাহের সরাসরি একটা সংযোগ ছিল বঙ্গোপসাগরের সাথে। ভারীবৃষ্টিপাতে সৃষ্ট উজানের ঢল অসংখ্য ছোট-ছোট নদী, খাল, হাওরবাওরের পানিপ্রবাহের সংযোগে বড় নদী সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা হয়ে দ্রুততম সময়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেত — যে কারণে উজানে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে এবং ভাটিবাংলায় পানির পরিমাণ বাড়লেও পুরোজনপদকে বর্তমান সময়ের মতো সর্বগ্রাসী ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি। সিলেট অঞ্চলের জীবন যাপন সহজলভ্য ও আরামদায়ক ছিল ব’লে ই তো এখানে এতো মানুষের ঘন বসতি। আর্যরা দলে দলে এসে মিশে গেছে, থেকে গেছে প্রাচীন ছিলটি অনার্যদের জনস্রোতে।
কর্কটক্রান্তি রেখার মাঝ বরাবর অবস্থিত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় এ বসতি স্থাপনকারীদের জন্য ষড়ঋতু ছিল প্রকৃতির নানা রংয়ের নানা ঢংয়ের আশীর্বাদ স্বরূপ। বর্ষার আগমনকে সিলেট অঞ্চলের মানুষ আশীর্বাদ হিসেবে বরণ করেছেন। গ্রাম-বাংলার মরমী সাধকদের গানে, কবিতায়-ই তো এর প্রমাণ রয়েছে। বর্ষা ঋতু নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃজিত গানগুলো মানুষের আত্মার পরম শান্তি হিসেবে মানবজন্ম সার্থক করে রেখেছে। ঋতু হিসেবে বর্ষা — ভাটিবাংলার মানুষকে নানা রকমের আনন্দ দিতে কোনও কার্পণ্য করেনি। তাহলে, কাজের কথা হচ্ছে — সিলেট অঞ্চলে এই যে ঘন-ঘন বন্যা হচ্ছে, বলতে গেলে একটি বৃষ্টি হলেই ফি-বছর বন্যায় সর্বশ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ধনীরা একভাবে ঠিকে গেলেও গরীব মানুষেরা আরও গরীব হয়। দুর্যোগকালীন সময়ের সরকারি ত্রাণ সামগ্রী অসহায় মানুষকে কোনো রকমে বাঁচিয়ে রাখলেও দারিদ্র্যের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে না। এমন অবস্থার জন্য দায়ি কে? প্রকৃতি না মানুষ? প্রকৃতির কোনো দায় নেই। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে। সেই নিয়মগুলো আয়ত্ত্ব করে করে মানুষের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে সমন্বয় করতে হয়। সমন্বয়ের ঘাটতিতে আমাদের মাদার আর্থে (Mother Earth) বিপর্যয় অনিবার্য। পরিবেশ ও প্রাণীকূলে সংকটের ঘনঘটা একটির পর একটি আসতেই থাকবে।
সিলেট অঞ্চলের চলমান বন্যায় সিলেট সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন। কোথাও বেশি কোথাও কম। কৃষিজ ক্ষতির কথা বাদ দিলেও অন্যান্য ধরনের বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষায়। সারা দেশে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও সিলেট শিক্ষাবোর্ড পরীক্ষা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানির নিচে নয়তো আশ্রয় শিবির হিসেবে ভূমিকা রাখছে। অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি লাখো শিক্ষার্থী। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পানিতে ডুবে থাকায় সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অপরিকল্পিত ও অপরিনামদর্শী উন্নয়নে (কার্যত: লুটেরা বা ধনিক শ্রেণির সার্থের উন্নয়ন) এই বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি। দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি, ঘুষখোর ও অদক্ষ আমলাতন্ত্রের কারণে এমন অসহনীয় অবস্থা। হাওর, নদী, খাল ভরাট করে রাস্তাঘাট নির্মাণের খেসারত এগুলো। মৌলভীবাজার জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও মারাত্মক বিপর্যস্ত কুলাউড়া উপজেলা। কুলাউড়া পৌর শহরের অর্ধেক সহ ৪২ টি গ্রাম দীর্ঘদিন ধরে পানির নীচে। উজানের ঢলে (ভারতের আসাম ও ত্রিপুরার) এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির পানি ওভারফ্লো করছে বিগত তিন দশক থেকে। যা আগে করেনি। হাকালুকি হাওরের প্রধান পানি প্রবাহ (স্রোত) কুশিয়ারা নদীতে যায় ‘বুড়িকিয়ারী’ গাঙ হয়ে। হাওরের মৎস সম্পদের লুটেরা গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্থানীয় প্রকৌশল অফিস অবিবেচক হয়ে এই বুড়িকিয়ারী নদীর ওপর বাঁধ তৈরী করেছেন (ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার গিলা ছড়া ইউনিয়নে)। অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের স্বার্থে কাছে জিম্মি কুলাউড়া, জুড়ী, বড় লেখা — এ তিন উপজেলার সাধারণ মানুষ। হাওরের বুড়িকিয়ারী নদীর বাঁধ অপসারণ করা না হলে এ বন্যা সমাস্যার স্থায়ী সমাধান আশা করা বৃথা।
শুধু কি হাকালুকি হাওর? সিলেট বিভাগের সবক’টি হাওরের পানি প্রবাহে এরকম হাজারো বাঁধা সৃষ্টি করা হয়েছে। কাউয়াদিঘী হাওরের ভুরভুড়ি ছড়ায় পুরানো ব্রীজের জায়গায় নতুন কালভার্ট করা হয়েছে। কালভার্টের নীচ দিয়ে নৌকা যায় না; ঠিক মতো পানিও যায় না। বিগত চার দশক ব্যাপী এ যেন উন্নয়নের নামে হাওরে কাজ করা টিকাদার আর ইন্জিনিয়ারদের লুটপাট ও হাওর-পরিবেশ ধ্বংসের এক মহোৎসব। সাথে যুক্ত রয়েছে বড় দু’টি নদী সুরমা-কুশিয়ারা সহ অসংখ্য ছোট-বড় নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস, ভরাট ও দখল।
ক্ষতি যা হবার হয়েছে। কিন্তু এখন থেকে সর্বস্তরের জনগণ জাগ্রত না-হলে, হাওর, খাল, নদী, বিল-ঝিলের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ ঠিক রাখতে না পারলে, এমন অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রতিরোধ করা না-গেলে নিকট ভবিষ্যতে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রকৃতির মহাবিপর্যয় দেখা দিবে এবং মানব সন্তান বসবাসের অনুপযোগী হবে মহাকালব্যাপী বসবাস করে আসা আমাদের পুর্বপুরুষদের ভিটেমাটি। ০৬/৭/২০০৪ খ্রিঃ।।
লেখক: খছরু চৌধুরী
সদস্য সচিব
কাউয়াদিঘী হাওর রক্ষা আন্দোলন
মৌলভীবাজার।