প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান হামহাম জলপ্রপাত
- আপডেট সময় ০৭:০১:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ অগাস্ট ২০২৩
- / ৩৮৯ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধিঃ স্বচ্ছ জলধারা গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের শরীর জুড়ে। নির্জন, শান্ত পাহাড় থেকে কলকল শব্দ বয়ে যাচ্ছে সমতলে। নাম না জানা লতাপাতা, গুল্ম, বাঁশবন, বুনোফুল ও ফলের গাছ আগলে রাখা পরম মমতায় সৃষ্টির এক বিস্ময় চোখ জুড়ানো দৃশ্যের পর্যটন কেন্দ্র হামহাম জলপ্রপাত। এর অবস্থান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায়।
হামহাম জলপ্রপাত। যা পাহাড় প্রেমীদের অন্যতম একটি তীর্থস্থান। অত্যন্ত দূর্গম আর গভীর জঙ্গলে অবস্থিত এই জলপ্রপাত পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতি পদে পদে যেমন রয়েছে বিপদের ভয়, তেমনি রয়েছে রোমাঞ্চের হাতছানি। সেই রোমাঞ্চের টানেই পাহাড় ও প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান হামহাম জলপ্রপাত।
সেই টলমলে স্বচ্ছ জলধারা গড়িয়ে পড়ছে ১৫০ থেকে ১৬০ ফুট উপর থেকে। নির্জন পাহাড়ের ওপর থেকে আছড়ে পড়া স্রোতধারা শাঁ, শাঁ শব্দ বয়ে যাচ্ছে সমতলে। সেই সৃষ্ট জলকনা তৈরি করছে কুয়াশার আবরণ।
গহীন অরণ্যে অবস্থিত হওয়া এই জলপ্রপাতটি ২০১০ সালে পর্যটন গাইড শ্যামল দেববর্মার সাথে দুর্গম জঙ্গলে ঘোরা একদল পর্যটক আবিষ্কার করেন। যদিও ২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে একটি দল সরেজমিনে হামহাম জলপ্রপাতটি পরিদর্শন করেন কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবরণ কিংবা পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এরপর থেকেই এটি বিখ্যাত হয়ে উঠে।
কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে ইসলামপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রাজাকান্দি রেঞ্জের কুরমা বনবিটের প্রায় ৮ কিলোমিটার অভ্যন্তরে দৃষ্টি নন্দন এ জলপ্রপাতটি অবস্থিত। যা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী। এখানে সরাসরি পৌঁছানোর কোন সড়ক নেই। উপজেলার চৌমুহনা চত্বর থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তায় গাড়িতে করে যেতে পারলেও বাকি পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। পায়ে হেঁটে ৪/৫ কিলোমিটার ভেতরে সীমান্ত ঘেঁষে ত্রিপুরা আদিবাসীদের পল্লী ও কুরমা বনবিটের অরণ্য ঘেরা দূর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ী পর্যন্ত যাওয়া যায়। সেখান থেকে মূল জলপ্রপাত প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে।
প্রকৃতিপ্রেমীদের গহীন অরণ্য প্রবেশ করে জলপ্রপাত দেখতে হলে তৈলংবাড়ি বা কলাবন বস্তির আদিবাসীদের সাহায্য নিতে হয়। পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথে ট্রেকিং করা খুবই কষ্টের। পিচ্ছিল রাস্তাটি সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হয়। ট্রেকিং কালে সবাইকে ভারসাম্য রক্ষার্থে বাঁশের লাটি হাতে নিতে হয়। এ জলপ্রপাতটিতে যেতে পেরোতে হয় দুর্গম পাহাড়ি সরুপথ। পাহাড়ি ঝিরি ধরে হাঁটতে হয় বহুদূর। ঝিরিপথে পড়বে কখনও হাঁটু কিংবা কোমর পানি। জলপ্রপাতের অর্ধ-কিলোমিটার দূর থেকেই শুনা যায় ঝর্ণার জলধ্বনী। শুষ্ক মৌসুমে ঝর্ণার পানি কম থাকলেও বর্ষা মৌসুমে পানি বেড়ে যায়। স্থানীয় উপজাতিদের ভাষা অনুসারে হাম হাম কথাটির অর্থ হচ্ছে প্রবল বেগে জোরে পানি পড়ার শব্দ। এ থেকে এর নাম হয়েছে হামহাম।
পায়ে হেঁটে জলপ্রপাতটিতে পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লাগে। ধরণা করা হয়ে থাকে বাংলাদেশে অবস্থিত অন্যান্য জলপ্রপাতের তুলনায় এটি প্রশস্ততম। প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ততা বিশিষ্ট এবং ১৩৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এ জলপ্রপাতটি। দিনদিন রোমাঞ্চকর অভিযাত্রীদের এক তীর্থভূমি হয়ে উঠেছে। ক্রমাগত পর্যটক সংখ্যা বাড়ছেই। ইতিমধ্যে সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো এবং যোগাযোগের সুবিধা বাড়াতে বেশ কিছু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা এবং রোমাঞ্চকর পরিবেশ নিঃসন্দেহে একে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান রূপ নিবে।
হামহামে সৌন্দর্যে একদিনে মনে তৃপ্তি আসবেনা জানিয়ে চট্রগ্রাম থেকে আসা আরিফ হোসেন বলেন, ওখানে গেলে ইচ্ছে হবে না চোখ সরাতে। মনে হবে, অনন্তকাল দুচোখ ভরে দেখে নেই প্রকৃতির এই অপূর্ব সৃষ্টিকে। এই অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে ভুলে যাবেন যে কোথায় আছেন।
সদ্য হামহাম ঘুরে আসা জেলা শহরের নারায়ণ দেব সুমন বলেন, যতো উৎফুল্লতা সহ রওনা দিয়েছিলাম ঠিক ততো তাড়াতাড়িই উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেললাম যখন মাঝপথে বৃষ্টি নামতে শুরু করে। বৃষ্টিতে পাহাড়ী পথ পিচ্ছিল হয়ে যায়। তবে মাথায় তখনও জলপ্রপাত দেখার নেশা কাজ করছিল। কষ্ট করেই গেলাম। ভাবলাম যাই হোক, ঝর্ণাতে যেতেই হবে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর কানে ভেসে আসতে শুরু করল ঝর্নার শব্দ। ভয়ংকর সেই সৌন্দর্য সামনে দেখতে পেরে যেন সব কষ্ট সার্থক।
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী সুনীল শৈশব বলেন, চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব আপনার মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে আপনার দু’চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হবে যেন ওই নয়নাভিরাম পাহাড় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
কমলগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন জানান, ভোর হতেই এখানে পর্যটকরা আসতে থাকেন। কিন্তু সবাই হামহাম যাওয়াতে সফল হননা। অনেকেই ফিরে আসেন কিছু রাস্তা পাড়ি দেয়ার পর। রাস্তায় কয়েক দফায় বেশ কিছু আগত পর্যটক ক্লান্ত হয়ে কাঙ্ক্ষিত ঝর্ণা না দেখেই বাড়ির পথে রওয়ানা দেন। মূলত তরুণরাই হামহাম যাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে। ঘুরতে আসা পর্যটকদের মধ্যে ৮০ ভাগই তরুণ-তরুণী। দৃঢ় মনোবল থাকলে হামহাম জলপ্রপাতের রূপ দেখা সম্ভব।
বন বিভাগের কমলগঞ্জ রাজকান্দি রেঞ্জ কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এই বর্ষা মৌসুমে বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে হামহাম ঝরনায় পানি শীতের চেয়ে দ্বিগুণ। হামহাম পর্যটককেন্দ্রের উন্নয়ন করার জন্য বন বিভাগ থেকে বিভাগীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।