ঢাকা ০৮:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সীমাবদ্ধতাকে জয় থেমে থাকার নয়

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ১২:০৬:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ৪৯০ বার পড়া হয়েছে
সিপন দেবঃ  মেয়ে হয়ে জন্ম হয়েছে তাও আবার প্রতিবন্ধী, এমন মেয়ে কে ঘরে রাখা ঠিক হবে না। ওকে দিয়ে কোনোদিন কিচ্ছু হবে না।পরিবার আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে চিরকাল এর থেকে ওরে কোনো অনাথলায়ে রেখে আসলে ভালো হয়।এমনও হাজার কথার মুখোমুখি হতে হয়েছিলেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বারইকোনা গ্রামের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রিয়া রানী দাশের মা অমরি রানী দাশ।কিন্তু তিনি সকল সমালোচনা অবহেলা কে পিছনে ফেলে আপন শক্তিতে মেয়েকে ভর্তি করে দেন স্থানীয় বুদ্ধিপ্রতিন্ধী স্কুলে সেই মেয়ে আজ জার্মানির বার্লিনে স্পেশাল অলিম্পিকের ২০২৩ আসরের ফুটবল ইভেন্টে স্বর্নজয়ী।
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রিয়া রানী দাশের মা অমরি রানী দাশ বলেন,সমাজের কারণে প্রতিনিয়ত আমার মেয়ে অবহেলিত হত এক সময় আমার পরিবার লোকেরা তাকে নির্দিষ্ট সীমানা করে দিয়েছিলো যে সে সবসময় ঘরের ভিতরে থাকবে তাকে কারো সাথে মেলামেশা করতে দেওয়া হত না শুধুমাত্র সে প্রতিবন্ধী বলে এবং আমাকে বলা হত আমি নাকি একটা সুস্থ  সন্তান জন্ম দিতে পারি নি।এসব কথায় কষ্ট পেলেও কখনো থেমে থাকি নাই, মেয়েটাকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে চাইছি কিšতু মনে মনে বিশ্বাসী ছিলাম আমার মেয়ে অন্য শিশুদের মত জীবনে একটা কিছু করবে।
রিয়া রানী দাশের মত এমনও হাজারও প্রতিবন্ধী শিশু আছে আমাদের দেশে যাদের সকল সুবিদা থাকা স¦ত্তেও তাদের সবসময় অবহেলিত হয়ে থাকতে হয়।এমনকি নিজ পরিবারেও প্রতিবন্ধী শিশুরা নিগৃহীত হয়।তাদের বোঝা মনে করা হয়। জীবনের প্রতি পদে তারা অবহেলার শিকার হয়। কোনো কেনো ক্ষেত্রে তা আবার ভিন্ন পরিবার থেকে তার প্রতিবন্ধী শিশুকে যা যা পাওয়ার দরকার সব কিছু দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই লালন পালন করছেন।জার্মানির বার্লিনে স্পেশাল অলিম্পিকের ২০২৩ আসরের ফুটবল ইভেন্টে আরেক স্বর্নজয়ী শিশু হলেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নলদাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রউফের মেয়ে মহিমা খাতুন মীম।
ছোটবেলা থেকেই মহিমা খাতুন মীম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী পরিবারের লোকেদের পাশে পেয়েছে সবসময় মহিমার পিতার সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমার দুই মেয়ে দুইজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী পাড়ার লোকেরা অনকেই নানা রকম মন্তব্য করতো আমি  এগুলো কে কানে তুলতাম না।কারন আমি আল্লাহর সৃষ্ঠিকে অসুন্দর বলতাম না প্রতিবন্ধী হোক আর যাই হোক ওদের প্রথম পরিচয় ওরা আমার মেয়ে তাদের স্থানীয় বুদ্ধিপ্রতিন্ধী স্কুলে ভর্তি করে দিলাম ছোট মেয়ে খেলাধুলায় দেখলাম ভালো যাতে ভালো করে খেলাদুলা করতে পারে তার জন্য যা যা করনীয় তাই করলাম।এক্ষেত্রে পাড়া প্রতিবেশিদের আমার মেয়ের খেলাধুলা নিয়ে প্রথম প্রথম সমালোচনা হলেও আমার মেয়ে যখন স্বর্নজয়ী হলো তখন দেখলাম তারা খুশি হলো ।
১৯০টি দেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অ্যাথলেটদের নিয়ে গত মাসে জার্মানির বার্লিনে বসেছিল স্পেশাল অলিম্পিকের আসর।আয়োজনে ৮টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ২৪টি সোনাসহ ৩৩টি পদক জিতেছে বাংলাদেশ।এর মধ্যে মেয়েদের ফুটবল, ১০০ মিটার দৌড়ে মৌলভীবাজারের ৪ মেয়ে শিশু স্বর্নপদক লাভ করে।
মেয়ে মানুষের এতো পড়াশোনা কেন করতে হবে? বিয়ে দিয়ে দাও! মেয়ে মানুষ মাঠে খেলবে কেন? বিয়ে হবে খেলে কি হবে? খেলতে গিয়ে অনেক মেয়েকেই শুনতে হয়েছে এসব বাক্য। তবুও নিজের অদম্য গতিতে নিজের খেলাধুলা চালিয়ে গেছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী তানিয়া আক্তার সুমাইয়া মৌলভীবাজার প্রতিবন্ধী স্কুলের এই শিক্ষার্থী।পরিবারের সবাই অবহেলা করলেও নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনুপ্রেরনায় তিনি স্পেশাল অলিম্পিকের ২০২৩ আসরের ১০০ মিটার ইভেন্টে স্বর্নজয়ী সে।
আমাদের দেশে একদিকে প্রদিবন্ধকতা আবার আর্থিক অনিশ্চয়তা তাই খেলাধুলায় মেয়েদের কম আসার প্রধান কারণ।এছাড়াও মৌলিক চাহিদার জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা,লিঙ্গবৈষম্য,পরিবারের বিরোধিতা,জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেড়েছে বাল্যবিবাহ এবং সমাজ ও পরিবারের খেলাধুলায় অসহযোগিতা,মেয়েদের বিশেষায়িত ক্লাব না থাকা, নিয়মিত টুর্নামেন্ট না হওয়া এবং অনুশীলনের জায়গার অভাব।
মৌলভীবাজারের ৪ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্বর্ণপদক জয় ও মেয়েদের কীভাবে খেলাধুলায় আগ্রহী করে গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারে কথা হলে জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ জসীম উদ্দিন মাসুদ বলেন,
স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুদের জন্য আমরা গর্বিত হতে পারি। দীর্ঘ এই ৫২বছরে আমাদের খেলাধুলায় সাফল্যের গল্প নেহাত কম নয়। মেয়েদের খেলাধুলাও ব্যতিক্রম নয়, মেয়েরা অনেকটা পথ এগিয়েছে।তবে মেয়েদের খেলায় প্রত্যাশিত উন্নতি হয়েছে কি না,সে বিরাট প্রশ্ন। সত্যি বলতে, আমাদের দেশে মেয়েদের খেলায় এখনো রয়ে গেছে নানা বাধা। প্রতিবন্ধী শিশুদের এমনিতেই রয়েছে সামাজিক অবহেলা তার উপরে আবার এসব শিশুদের খেলাধুলা।তিনি আরো বলেন, প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকেই।
যদিও ফাইব-জির যুগে রয়েছি আমরা, সবকিছুই এখন আধুনিক।আমাদেরই দুইজন নারী এভারেস্ট জয় করেছেন।কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়েও মেয়েদের খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবার।আর পরিবার উৎসাহী না হলে একটি মেয়ের পক্ষে খেলাধুলায় আসা বা খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভবই।তবে কিছুটা হলেও অসম্ভব কে সম্ভব করেছে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুসহ বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুরা। মেয়েদের খেলাধুলায় আগ্রহি করে তুলতে পরিবার অগ্রহনি ভূমিকা পালন করবে এবং সমাজে বাল্যবিবাহ কমবে সমাজ সুখি সুন্দর হবে।
তিনি আরো বলেন,প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অনেকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রতিভা। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন এবং পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারলে তারা সমাজে ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন। ছেলে ও মেয়ে কে সমান সুযোগ সুবিদা পরিবার থেকে দিতে হবে।
 খেলার জগতে মেয়েদের পা রাখাটা কিন্তু খুব সহজ নয় এর মধ্যে যদি হয় প্রতিবন্ধী বলছিলেন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস এ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের ডিস্টিক অফিসার ইস্পিতা সরকার তিনি বলেন,আমাদের সমাজে মেয়েদের খেলাধুলায় প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে, খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবারের সদস্যরাই কিন্তু এই জায়গা থেকে প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুরা অনেক এগিয়ে তারা সকল বাধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে৷পরিবার থেকে নিরুৎসাহিত করলে একা একটি মেয়ের পক্ষে খেলাধূলা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে৷পরিবার বাধা দেয় মূলত সমাজের চোখ রাঙানি, প্রতিবেশিদের তিরস্কার,ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে৷অসংখ্য মানুষের সামনে মেয়েরা হাফপ্যান্ট, জার্সি পড়ে খেলবে, ছুটবে, দৌড়াবে- পরিবার ও সমাজের অভিভাবকরা তা মানতে পারেন না৷
নারীদের খেলায় অংশগ্রহন সমাজ এখনো স্বাভাবিকভাবে সমর্থন তো করেই না বরং নানাভাবে খেলাধুলা বন্ধ করার চেষ্টা চালায়৷তাছাড়া অনেক পরিবার মনে করে, খেলাধুলা করলে রোদে বৃষ্টিতে মেয়েদের চেহারার স্বাভাবিক শ্রী নষ্ট হয়ে যাবে৷তখন বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে৷কেননা, এখনও বিশ্বাস করা হয়, বিয়ে করে বাচ্চা লালন পালন করাই নারীদের নিয়তি৷তাদের স্থান অবশ্যই ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে, বাইরের দুনিয়ায় নয়৷
তিনি মনে করেন সবাইকে মেয়েদের খেলাধুলার ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে এবং পরিবার থেকে খেলাধুলার প্রতি সন্তান তে আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন আমাদের সমাজের মানুষদের বুঝতে হবে, প্রতিবন্ধী হোক আর স্বাভাবিক হোক কোনো মানুষ সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা নয়, বরং সম্পদ। কাজেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখলে দেশে উন্নয়ন সম্ভব নয়।, তাদের সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে তাদের সব ধরনের সুযোগ দিতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধীরাও অবদান রাখতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল সার্ভে অন পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ (এনএসপিডি) শীর্ষক প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৬ লাখ। প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে তাঁদের ৯৮ শতাংশ কোনো না কোনো সময় বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিগ্রহের শিকার হন।
এ ছাড়াও জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী।২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক একটি সনদ (সিআরডিপি) গৃহীত হয়। এ সনদ ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয়।
সিআরসি ও সিআরপিডি সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশু যেন কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকার ভোগ করতে পারে,তা নিশ্চিত করবে।এই দুটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।জাতীয় শিশু নীতিমালাতেও প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশুর অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে।কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা ভিন্ন।প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক।তাদের মেধার বিকাশে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই।প্রতিবন্ধীদের দিয়ে কিছুই হবে না।এই ভেবে তাদের বাতিলের খাতায় ফেলে রাখা হয়।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে অনেকটা হেয় করে অথবা নিচু চোখে দেখা হয়। তাদেরকে প্রায়ই অবহেলা করা হয়ে থাকে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিবন্ধী শিশুরাও যে অনেক প্রতিভাবান হতে পারে সেটা একদমই বুঝতে চেষ্টা করি না মৌলভীবাজারের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা দেখিয়ে দিল তাদের কোনো সীমাবদ্ধতা দিয়ে তাদের প্রতিভা কে আটকিয়ে রাখা যাবে না ।
প্রতিবন্ধী হওয়া সত্বেও অনেক শিশুই নিজেদের মেধা আর দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।এগুলো কিন্তু আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। শত বাধা বিপত্তি পার করে তাদের সফলতার সংবাদ প্রায়ই দেখা যায়।
সামাজিকভাবে প্রতিবন্ধী মেয়েদেরেদেরকে অবহেলার চোখে দেখা হলেও এখন সময় এসেছে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার।প্রতিবন্ধী সমাজের বোঝা নয়।বরং মেধা, দক্ষতা আর সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারাও সমাজ, দেশ ও জাতির সম্পদে পরিণত হতে পারে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের বেড়ে উঠার জন্য সুস্থ, সুন্দর পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি। এজন্য তাদেরকে নিয়ে চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা ইত্যাদির আয়োজন করতে হবে মেয়ে ও ছেলে প্রতিবন্ধী শিশুদের কে খেলাধুলায় আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে ঘৃণা বা অবহেলার চোখে দেখার যে প্রবণতা সমাজে চলমান সেটি বন্ধ করার জন্য প্রচার, প্রচারনা চালাতে হবে ।এতে পরিবারের ভূমিকার বিকল্প নেই।
ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

সীমাবদ্ধতাকে জয় থেমে থাকার নয়

আপডেট সময় ১২:০৬:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সিপন দেবঃ  মেয়ে হয়ে জন্ম হয়েছে তাও আবার প্রতিবন্ধী, এমন মেয়ে কে ঘরে রাখা ঠিক হবে না। ওকে দিয়ে কোনোদিন কিচ্ছু হবে না।পরিবার আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে চিরকাল এর থেকে ওরে কোনো অনাথলায়ে রেখে আসলে ভালো হয়।এমনও হাজার কথার মুখোমুখি হতে হয়েছিলেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বারইকোনা গ্রামের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রিয়া রানী দাশের মা অমরি রানী দাশ।কিন্তু তিনি সকল সমালোচনা অবহেলা কে পিছনে ফেলে আপন শক্তিতে মেয়েকে ভর্তি করে দেন স্থানীয় বুদ্ধিপ্রতিন্ধী স্কুলে সেই মেয়ে আজ জার্মানির বার্লিনে স্পেশাল অলিম্পিকের ২০২৩ আসরের ফুটবল ইভেন্টে স্বর্নজয়ী।
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রিয়া রানী দাশের মা অমরি রানী দাশ বলেন,সমাজের কারণে প্রতিনিয়ত আমার মেয়ে অবহেলিত হত এক সময় আমার পরিবার লোকেরা তাকে নির্দিষ্ট সীমানা করে দিয়েছিলো যে সে সবসময় ঘরের ভিতরে থাকবে তাকে কারো সাথে মেলামেশা করতে দেওয়া হত না শুধুমাত্র সে প্রতিবন্ধী বলে এবং আমাকে বলা হত আমি নাকি একটা সুস্থ  সন্তান জন্ম দিতে পারি নি।এসব কথায় কষ্ট পেলেও কখনো থেমে থাকি নাই, মেয়েটাকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে চাইছি কিšতু মনে মনে বিশ্বাসী ছিলাম আমার মেয়ে অন্য শিশুদের মত জীবনে একটা কিছু করবে।
রিয়া রানী দাশের মত এমনও হাজারও প্রতিবন্ধী শিশু আছে আমাদের দেশে যাদের সকল সুবিদা থাকা স¦ত্তেও তাদের সবসময় অবহেলিত হয়ে থাকতে হয়।এমনকি নিজ পরিবারেও প্রতিবন্ধী শিশুরা নিগৃহীত হয়।তাদের বোঝা মনে করা হয়। জীবনের প্রতি পদে তারা অবহেলার শিকার হয়। কোনো কেনো ক্ষেত্রে তা আবার ভিন্ন পরিবার থেকে তার প্রতিবন্ধী শিশুকে যা যা পাওয়ার দরকার সব কিছু দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই লালন পালন করছেন।জার্মানির বার্লিনে স্পেশাল অলিম্পিকের ২০২৩ আসরের ফুটবল ইভেন্টে আরেক স্বর্নজয়ী শিশু হলেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নলদাড়িয়া গ্রামের আব্দুর রউফের মেয়ে মহিমা খাতুন মীম।
ছোটবেলা থেকেই মহিমা খাতুন মীম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী পরিবারের লোকেদের পাশে পেয়েছে সবসময় মহিমার পিতার সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমার দুই মেয়ে দুইজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী পাড়ার লোকেরা অনকেই নানা রকম মন্তব্য করতো আমি  এগুলো কে কানে তুলতাম না।কারন আমি আল্লাহর সৃষ্ঠিকে অসুন্দর বলতাম না প্রতিবন্ধী হোক আর যাই হোক ওদের প্রথম পরিচয় ওরা আমার মেয়ে তাদের স্থানীয় বুদ্ধিপ্রতিন্ধী স্কুলে ভর্তি করে দিলাম ছোট মেয়ে খেলাধুলায় দেখলাম ভালো যাতে ভালো করে খেলাদুলা করতে পারে তার জন্য যা যা করনীয় তাই করলাম।এক্ষেত্রে পাড়া প্রতিবেশিদের আমার মেয়ের খেলাধুলা নিয়ে প্রথম প্রথম সমালোচনা হলেও আমার মেয়ে যখন স্বর্নজয়ী হলো তখন দেখলাম তারা খুশি হলো ।
১৯০টি দেশের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অ্যাথলেটদের নিয়ে গত মাসে জার্মানির বার্লিনে বসেছিল স্পেশাল অলিম্পিকের আসর।আয়োজনে ৮টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ২৪টি সোনাসহ ৩৩টি পদক জিতেছে বাংলাদেশ।এর মধ্যে মেয়েদের ফুটবল, ১০০ মিটার দৌড়ে মৌলভীবাজারের ৪ মেয়ে শিশু স্বর্নপদক লাভ করে।
মেয়ে মানুষের এতো পড়াশোনা কেন করতে হবে? বিয়ে দিয়ে দাও! মেয়ে মানুষ মাঠে খেলবে কেন? বিয়ে হবে খেলে কি হবে? খেলতে গিয়ে অনেক মেয়েকেই শুনতে হয়েছে এসব বাক্য। তবুও নিজের অদম্য গতিতে নিজের খেলাধুলা চালিয়ে গেছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী তানিয়া আক্তার সুমাইয়া মৌলভীবাজার প্রতিবন্ধী স্কুলের এই শিক্ষার্থী।পরিবারের সবাই অবহেলা করলেও নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনুপ্রেরনায় তিনি স্পেশাল অলিম্পিকের ২০২৩ আসরের ১০০ মিটার ইভেন্টে স্বর্নজয়ী সে।
আমাদের দেশে একদিকে প্রদিবন্ধকতা আবার আর্থিক অনিশ্চয়তা তাই খেলাধুলায় মেয়েদের কম আসার প্রধান কারণ।এছাড়াও মৌলিক চাহিদার জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা,লিঙ্গবৈষম্য,পরিবারের বিরোধিতা,জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেড়েছে বাল্যবিবাহ এবং সমাজ ও পরিবারের খেলাধুলায় অসহযোগিতা,মেয়েদের বিশেষায়িত ক্লাব না থাকা, নিয়মিত টুর্নামেন্ট না হওয়া এবং অনুশীলনের জায়গার অভাব।
মৌলভীবাজারের ৪ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্বর্ণপদক জয় ও মেয়েদের কীভাবে খেলাধুলায় আগ্রহী করে গড়ে তোলা যায় সে ব্যাপারে কথা হলে জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ জসীম উদ্দিন মাসুদ বলেন,
স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুদের জন্য আমরা গর্বিত হতে পারি। দীর্ঘ এই ৫২বছরে আমাদের খেলাধুলায় সাফল্যের গল্প নেহাত কম নয়। মেয়েদের খেলাধুলাও ব্যতিক্রম নয়, মেয়েরা অনেকটা পথ এগিয়েছে।তবে মেয়েদের খেলায় প্রত্যাশিত উন্নতি হয়েছে কি না,সে বিরাট প্রশ্ন। সত্যি বলতে, আমাদের দেশে মেয়েদের খেলায় এখনো রয়ে গেছে নানা বাধা। প্রতিবন্ধী শিশুদের এমনিতেই রয়েছে সামাজিক অবহেলা তার উপরে আবার এসব শিশুদের খেলাধুলা।তিনি আরো বলেন, প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকেই।
যদিও ফাইব-জির যুগে রয়েছি আমরা, সবকিছুই এখন আধুনিক।আমাদেরই দুইজন নারী এভারেস্ট জয় করেছেন।কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়েও মেয়েদের খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবার।আর পরিবার উৎসাহী না হলে একটি মেয়ের পক্ষে খেলাধুলায় আসা বা খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভবই।তবে কিছুটা হলেও অসম্ভব কে সম্ভব করেছে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুসহ বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুরা। মেয়েদের খেলাধুলায় আগ্রহি করে তুলতে পরিবার অগ্রহনি ভূমিকা পালন করবে এবং সমাজে বাল্যবিবাহ কমবে সমাজ সুখি সুন্দর হবে।
তিনি আরো বলেন,প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অনেকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রতিভা। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন এবং পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারলে তারা সমাজে ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন। ছেলে ও মেয়ে কে সমান সুযোগ সুবিদা পরিবার থেকে দিতে হবে।
 খেলার জগতে মেয়েদের পা রাখাটা কিন্তু খুব সহজ নয় এর মধ্যে যদি হয় প্রতিবন্ধী বলছিলেন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস এ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের ডিস্টিক অফিসার ইস্পিতা সরকার তিনি বলেন,আমাদের সমাজে মেয়েদের খেলাধুলায় প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে, খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবারের সদস্যরাই কিন্তু এই জায়গা থেকে প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুরা অনেক এগিয়ে তারা সকল বাধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে৷পরিবার থেকে নিরুৎসাহিত করলে একা একটি মেয়ের পক্ষে খেলাধূলা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে৷পরিবার বাধা দেয় মূলত সমাজের চোখ রাঙানি, প্রতিবেশিদের তিরস্কার,ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে৷অসংখ্য মানুষের সামনে মেয়েরা হাফপ্যান্ট, জার্সি পড়ে খেলবে, ছুটবে, দৌড়াবে- পরিবার ও সমাজের অভিভাবকরা তা মানতে পারেন না৷
নারীদের খেলায় অংশগ্রহন সমাজ এখনো স্বাভাবিকভাবে সমর্থন তো করেই না বরং নানাভাবে খেলাধুলা বন্ধ করার চেষ্টা চালায়৷তাছাড়া অনেক পরিবার মনে করে, খেলাধুলা করলে রোদে বৃষ্টিতে মেয়েদের চেহারার স্বাভাবিক শ্রী নষ্ট হয়ে যাবে৷তখন বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে৷কেননা, এখনও বিশ্বাস করা হয়, বিয়ে করে বাচ্চা লালন পালন করাই নারীদের নিয়তি৷তাদের স্থান অবশ্যই ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে, বাইরের দুনিয়ায় নয়৷
তিনি মনে করেন সবাইকে মেয়েদের খেলাধুলার ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে এবং পরিবার থেকে খেলাধুলার প্রতি সন্তান তে আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন আমাদের সমাজের মানুষদের বুঝতে হবে, প্রতিবন্ধী হোক আর স্বাভাবিক হোক কোনো মানুষ সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা নয়, বরং সম্পদ। কাজেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখলে দেশে উন্নয়ন সম্ভব নয়।, তাদের সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে তাদের সব ধরনের সুযোগ দিতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধীরাও অবদান রাখতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ন্যাশনাল সার্ভে অন পারসনস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ (এনএসপিডি) শীর্ষক প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৬ লাখ। প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে তাঁদের ৯৮ শতাংশ কোনো না কোনো সময় বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিগ্রহের শিকার হন।
এ ছাড়াও জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী।২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক একটি সনদ (সিআরডিপি) গৃহীত হয়। এ সনদ ২০০৮ সালের ৩ মে থেকে কার্যকর হয়।
সিআরসি ও সিআরপিডি সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশু যেন কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকার ভোগ করতে পারে,তা নিশ্চিত করবে।এই দুটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।জাতীয় শিশু নীতিমালাতেও প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশুর অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে।কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা ভিন্ন।প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক।তাদের মেধার বিকাশে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই।প্রতিবন্ধীদের দিয়ে কিছুই হবে না।এই ভেবে তাদের বাতিলের খাতায় ফেলে রাখা হয়।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে অনেকটা হেয় করে অথবা নিচু চোখে দেখা হয়। তাদেরকে প্রায়ই অবহেলা করা হয়ে থাকে শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিবন্ধী শিশুরাও যে অনেক প্রতিভাবান হতে পারে সেটা একদমই বুঝতে চেষ্টা করি না মৌলভীবাজারের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা দেখিয়ে দিল তাদের কোনো সীমাবদ্ধতা দিয়ে তাদের প্রতিভা কে আটকিয়ে রাখা যাবে না ।
প্রতিবন্ধী হওয়া সত্বেও অনেক শিশুই নিজেদের মেধা আর দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।এগুলো কিন্তু আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। শত বাধা বিপত্তি পার করে তাদের সফলতার সংবাদ প্রায়ই দেখা যায়।
সামাজিকভাবে প্রতিবন্ধী মেয়েদেরেদেরকে অবহেলার চোখে দেখা হলেও এখন সময় এসেছে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার।প্রতিবন্ধী সমাজের বোঝা নয়।বরং মেধা, দক্ষতা আর সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারাও সমাজ, দেশ ও জাতির সম্পদে পরিণত হতে পারে।
প্রতিবন্ধী শিশুদের বেড়ে উঠার জন্য সুস্থ, সুন্দর পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি। এজন্য তাদেরকে নিয়ে চিত্তবিনোদন, খেলাধুলা ইত্যাদির আয়োজন করতে হবে মেয়ে ও ছেলে প্রতিবন্ধী শিশুদের কে খেলাধুলায় আগ্রহী করে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে ঘৃণা বা অবহেলার চোখে দেখার যে প্রবণতা সমাজে চলমান সেটি বন্ধ করার জন্য প্রচার, প্রচারনা চালাতে হবে ।এতে পরিবারের ভূমিকার বিকল্প নেই।