আওয়ামী লীগে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের সঙ্গে কোন্দল আধিপত্য হারানোর ভয় এমপিদের
- আপডেট সময় ১১:১৪:৫৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ মার্চ ২০২৪
- / ৪৭৪ বার পড়া হয়েছে
আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূলে বড় ধরনের কোন্দল দেখা দিয়েছে। মূলত স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিরোধ চলছে। এই বিরোধের পেছনে প্রধান কারণ উপজেলা চেয়ারম্যানদের কাছে সংসদ সদস্যদের আধিপত্য হারানোর ভয়। কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো কালের কণ্ঠকে এমনটা জানিয়েছে
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের আগামী দিনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন। পাঁচ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সংসদীয় নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ড দলের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে উপজেলা চেয়ারম্যানদের বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে সংসদ সদস্যদের মধ্যে ভয় সংক্রমিত হয়েছে। তাঁরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে সতর্ক হচ্ছেন।
তাঁরা চাইছেন নিজের অনুগত নেতাকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করতে, যেন তাঁদের আধিপত্য হুমকিতে না পড়ে। ফলে অন্য যাঁরা চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে চাইছেন তাঁদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধ বাড়ছে সংসদ সদস্যদের। তৃণমূলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিষয়াদি দেখাশোনা করেন এমন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, উপজেলা চেয়ারম্যানদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ বিষয়টিকে অনেক সংসদ সদস্যই ভালোভাবে নিতে পারছেন না।
মূলত যেসব সংসদ সদস্যের নিজ এলাকায় অবস্থান তেমন শক্ত নয়, তাঁদের সঙ্গেই উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিরোধ বেশি দেখা যাচ্ছে। জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সংসদ সদস্যদের এলাকায় এ দ্বন্দ্ব তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ এবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দেবে না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংসদ সদস্যরা তাঁদের পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে চাইছেন। ফলে দল বিভক্ত হয়ে পড়ছে।
গত বুধবার পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় এক অনুষ্ঠানে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থী ঘোষণা করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মহিববুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আগামী উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে দলের সাধারণ সম্পাদক ত্যাগী নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব তালুকদারকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি।
কলাপাড়া উপজেলা পরিষদে প্রার্থী হতে মাঠে আছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আল সাইফুল। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য মহিববুর রহমানের প্রার্থী ঘোষণায় নাখোশ হয়েছেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ শুরু হয়েছে।
বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের সঙ্গে একাধিক প্রার্থীর বিরোধ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে দুই পক্ষের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থানে আছেন। যেকোনো সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
রাজশাহীর বেশির ভাগ উপজেলায়ই স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে একাধিক প্রার্থীর বিরোধ শুরু হয়েছে। বাগমারা, বাঘা, চারঘাটসহ একাধিক উপজেলায় বিবদমান নেতাকর্মীদের মাঝে সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
সংসদ সদস্য মনোনয়নে গুরুত্ব পান উপজেলা চেয়ারম্যানরা
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র মতে, জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ কারণেই সংসদ সদস্যরা উপজেলা চেয়ারম্যানদের হুমকি হিসেবে দেখছেন। মূলত ২০২০ সাল থেকে এই প্রবণতা দৃশ্যমান হতে থাকে। সে বছর কভিড মহামারির সময়ে কয়েকজন সংসদ সদস্য মারা যান। ওই আসনগুলোতে উপনির্বাচনে স্থানীয় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা দলের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে বছর উপনির্বাচনে যশোর-৬ আসনে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার, নওগাঁ-৬ আসনে রানীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন হেলাল ও পাবনা-৪ আসনে ঈশ্বরদী উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান বিশ্বাস সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালে নাটোর-৪ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, বিগত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও প্রার্থী মনোনয়নে উপজেলা চেয়ারম্যানরা গুরুত্ব পান। প্রায় অর্ধশত সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমপি প্রার্থী হন। তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন।
সাতক্ষীরা জেলার চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতে প্রার্থী পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ। তিনটিতেই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনে কলারোয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন, সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু এবং সাতক্ষীরা-৪ আসনে শ্যামনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম আতাউল হক দোলন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হন জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। সেখানে মনোনয়ন পান পটিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। ময়মনসিংহ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। আসনটিতে দলের মনোনয়ন পান মুক্তাগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই আকন্দ। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে দলের মনোনয়ন পান উল্লাপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফি।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও বেশ কয়েকজন উপজেলা চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মোহাম্মদ নিজামুদ্দিন নদভীকে পরাজিত করেন সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব।
গোপালগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর প্রভাবশালী সদস্য মুহম্মদ ফারুক খানের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলেন মুকসুদপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাবির মিয়া।
সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় নেতারা যা বললেন
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বে আছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলের কোন্দল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর যে প্রান্তে তিনজন বাঙালির উপস্থিতি রয়েছে, সেখানেই একাধিক গ্রুপের অস্তিত্ব দেখা যায়। এটি আমাদের স্বভাবগত নেতিবাচক দিক। সুতরাং বাঙালির আপন দল আওয়ামী লীগে এর অস্তিত্ব থাকবে না—এমনটা আশা করা ভুল।
সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিরোধ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘একজন সংসদ সদস্য যেমন নিজ এলাকার জনগণের খাদেম, তেমনি তিনি অভিভাবকতুল্য মর্যাদা ভোগ করেন। সুতরাং কেউ দীর্ঘদিন বারবার নির্বাচিত হতে চাইলে সবাইকে ধারণ করা এবং ভিন্নমতকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার মানসিকতা বহন করতে হবে। যাঁরা এর ব্যত্যয় ঘটান তাঁদের পরিণতি সুখকর হয় না। বিগত জাতীয় নির্বাচনে অনেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েও জিততে পারেননি। এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
রাজশাহী বিভাগ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্বে আছেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দিচ্ছে না। যে যার জনপ্রিয়তা দিয়ে নির্বাচনে জিতে আসবে। এখানে একজন চেষ্টা করবে তার কর্তৃত্ব ধরে রাখার, আরেকজন চেষ্টা করবে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার। এই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই আমাদের দলকে এগিয়ে নিতে হবে।
তথ্য কালের কন্ঠ