মাওলানা নাসির উদ্দীন চলে যাওয়ার আজ চার বছর
- আপডেট সময় ০২:২১:১৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ জুলাই ২০২৪
- / ১৯৬ বার পড়া হয়েছে
মৌলভীবাজার২৪ ডেস্কঃ মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শমসেরগঞ্জ দৌলতপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে ১৯৬৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন মাওলানা নাসির উদ্দীন।
তিনি ছিলেন একাধারে একজন আদর্শ শিক্ষক, একজন মহান অভিভাবক, একজন পরোপকারী, একজন ন্যায় বিচারক, একজন পরধর্ম সহিষ্ণু, একজন অতিথিপরায়ণ ও সর্বজনগৃহীত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এলাকার ছোটবড় সবাই তাঁকে মাওলানা স্যার নামে চিনত এবং চোখ বন্ধ করে স্বাক্ষী দেয় যে, তিনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বর্ণনা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ তিনি ছিলেন তার সময়ে অতুলনীয় একজন ব্যক্তি। চারিত্রিক গুণে হাজার হাজার মানুষকে তিনি আকৃষ্ট করেছেন প্রতিনিয়তই।
হাজার হাজার ছাত্রকে তিনি গড়ে গিয়েছেন প্রকৃত মানুষের মত করে। তাদের দ্বীনদারী, আদব-আখলাক আর সততা আদর্শের প্রতি তার বিশেষ নজর ছিল সদাসর্বদা। মুসলিম ছাত্রদের সবাইকে স্কুলে আসার সময় সাথে করে টুপি নিয়ে আসতে হত এবং সময়মত বাধ্যতামূলকভাবে নামাজ আদায় করতে হত। অন্যতায় তাঁর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতনা। আর মুসলিম মেয়েদের ক্ষেত্রে পর্দা করাও ছিল বাধ্যতামূলক একটি রীতি। তিনি ছাত্রদেরকে যেমন আদর স্নেহ করতেন তেমন একজন আদর্শবান অভিভাবকেরমত শাসনও করতেন। তাঁর ইন্তেকালের দিন এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সনাতনী সম্প্রদায়ের হাহাকার ও কান্নার দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মত। যেন তারা তাদের খুব আপন একজনকে হারিয়েছে। আজো তার প্রমাণ আমি পাই, যখন কোথাও যাই আর পরিচয় দিতে হয় আমি মাস্টার সাহেবের বাড়ির মাদ্রাসার শিক্ষক, তখন সেটা আমার জন্য বাড়তি সম্মানের কারণ হয়।
তিনি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) প্রতিষ্টিত ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলি ট্রাস্ট’, ‘বাংলাদেশ আনজুমানে আল-ইসলাহ’, ‘লতিফিয়া কারী সোসাইটি’ সহ সকল মসলিকী খেদমতের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর খিদমতের প্রশ্নে অন্যদের চেয়ে তিনি সবসময়ই এগিয়ে থাকতেন। তিনি হযরত ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর একজন স্নেহধন্য ব্যক্তি ছিলেন। শুনেছি ছোট্ট বেলায় শিশু নাসির উদ্দীনের মুখে সর্বপ্রথম ক্ষীর (মিষ্টান্ন) নাকি দিয়েছেন হযরত ফুলতলি ছাহেব (রহ.)। মুর্শিদের সেই পবিত্র হাতের বরকতের ফলাফল কি হয়েছিল সেটা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম পরিণত মাওলানা নাসির উদ্দীনকে দেখে।
তিনি ছিলেন শীর্ষ পর্যায়ের একজন অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি। প্রতি বেলায়ই তিনি কাউকে না কাউকে সাথে নিয়ে খাবার খেতে চেষ্টা করতেন। শুক্রবার জুম’আর দিন মসজিদ থেকে বের হয়ে মানুষকে খাওয়ানোর জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করতেন। নামাজ শেষে যখন সবাই বের হতেন তখন হাতে ধরে মানুষকে টেনে নিয়ে খাবার খেতে বসতেন। আত্মকেন্দ্রিক এই যুগে মাওলানা নাসির উদ্দীন ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম একজন অতিথিপরায়ণ মানুষ।
তিনি ছিলেন একজন পরোপকারী মানুষ। এলাকার সকলের ভরসাস্থল ছিলেন মাওলানা সাহেব। এলাকার অনেকেইতো এখনো আফসোস করে বলেন, ‘আহ্ আমাদের মাস্টার সাব নাই, তাই আমাদের দুঃখ বলারও মানুষ নাই, তিনি থাকতে কিছু দরকার হলে তাঁকে বলতাম, যদি সম্ভব হত তাহলে সাথে সাথে তিনি দিয়ে দিতেন আর নাহয় বলতেন আমি লন্ডনে আমার ভাইদের বলে তোমাকে সহযোগীতা করব।’ আমি তাঁর এতএত গুণের কথা অবলোকন করে আফসোস করে বলি, ‘আহ্! যদি আমি মাওলানা নাসির উদ্দীন সাহেবের মত হতে পারতাম!’
এলাকায় তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেও একজন ব্যক্তিত্ব। এলাকার সবাই এখনও তাঁর প্রশ্নে যে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সেটা যে কারোর জন্যই ঈর্ষণীয় একটা ব্যাপার। এমন একটি জীবন কে না চায় যেখানে ইন্তেকালের পরেও মানুষ তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে?
যদিও জিসমানি ভাবে তার কোন সন্তানাদি ছিলনা, আল্লাহপাক হয়ত এর মাঝেও বিশেষ কোন প্রতিদান রেখেছেন। তবে রূহানী সন্তান ছিল হাজার হাজার। তার এমন কোন ছাত্র নেই যারা তাকে পিতার মত করে দেখতনা। দারুল কিরাতের ছাত্রছাত্রীরাতো প্রায়শই বলে বসে যে, মাওলানা স্যার না থাকায় আমাদের মাদ্রাসায় আসতে মনচায়না কারণ এখানে আসলেই মাওলানা স্যারের কথা স্মরণ হয়।
ছাত্রছাত্রীরা তার কবরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর কি যেন মনেমনে বলে! হয়ত এটাই বলে ‘স্যার একবার মাথা উঠান! এই দেখেন আমরা আপনার শতশত সন্তানেরা আপনার কবরের পাশে জড়ো হয়েছি। একবার উঠুন আমরা আপনাকে পদচুম্বন করে শান্ত হই!’
আজ ৮ জুলাই ২০২৪। আপনার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে হৃদয় উজার করা দোয়া ও শ্রদ্ধা আপনার জন্য হে মাওলানা নাসির উদ্দীন ভাই!
আমি বিশ্বাস করি আপনি কবরে পরম আয়েশি জীবনযাপন করছেন।