মেঝো ভাইসাবকে ভুলতে পারি না হাফিজ সাব্বির আহমদ

- আপডেট সময় ০৫:০৫:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫
- / ১ বার পড়া হয়েছে

মেঝো ভাইসাব মাওলানা নাসির উদ্দিন গত হওয়ার আজ ৫ বছর হয়ে গেলো। তবু এক মুহূর্তের জন্যও তাঁকে ভুলতে পারি না। জীবন এক অদ্ভুত রহস্যের জাল বুনে আমাদেরকে জড়িয়ে রাখে। হাসি-কান্না, আনন্দের মিশ্রণ জীবনকে চালিত করে। তবু মাঝেমাঝে ঘটে তার পতন। জীবন গতি হারায়। পার্থিব জীবনে আপনজনকে হারিয়ে ফেলার শূন্যতা হৃদয়ে দাগ ফেলে। আর তা যদি হয় আপন রক্তের বাঁধন; সেই বেদনা কালোমেঘে ঢেকে দেয় মন। মানুষ বলেই হয়তো জীবনে এমন অনুভব প্রত্যাশিত। তবু খুশি থাকতে হয় মহান মাওলার সিদ্ধান্তের উপর। এর বাইরে কখন কে যেতে পেরেছে।
দেশের বাইরে থাকি অনেক বছর। এই পরবাস আমাকে কখনো দেশের প্রতি টান ও অনুভব ভুলিয়ে দিতে পারেনি। হৃদয়ে নিত্য অবস্থান স্বদেশ-পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আপনজন। এক মায়ার ইন্দ্রজাল মন থেকে মনে প্রবাহিত।
মা-বাবা দুনিয়াতে নেই অনেক বছর। আল্লাহ তাদের রহম করুন। বেহেস্তের আলা দরোজা নসিব করুন। তাদের অবর্তমানে নিজের ভাইবোন ও পরিবারের অটুট বন্ধন নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা। বড় ভাইসাব মো. ফখরুল ইসলাম বাহির সামাল দিলে মেঝো ভাই ঘর সামলেছেন। কিন্তু করোনাকালের এক নিদারুণ বর্ষার গভীর রাতে বুকে ব্যথা অনুভব করেন মেঝো ভাই মাওলানা নাসির উদ্দিন। আমার ছোটভাই জহির (মাওলানা জহিরুল ইসলাম) ও বড় ভাতিজা রেদোয়ান তাঁকে নিয়ে হসপিটালে পৌঁছার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। সহসাই জীবন প্রদীপ নিভে যায়। আমাদের পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। থেমে যায় সকল সুখের গল্প। চোখের পলকে এমন মায়াবন্ধন ছিন্ন করে এভাবেও চলে যাওয়া যায় তাও আমাদের বিশ্বাস করতে হলো। পিছনে পড়ে রইলো তাঁর এক জীবনের সুমহান কীর্তি, চেনাজানা পথঘাট। নিমিষেই প্রাণহীন ছায়া হয়ে গেলেন আমার ভাই।
তিনি আমাদের মানুষ করেছেন। আদর যত্ন আর স্নেহ শাসনে জীবনের পথ বদলে দিয়েছেন। মেঝো ভাই ছিলেন আমাদের পরিবারে খুঁটি। বাড়ির পাশের শমসেরগঞ্জ ধোবারহাট হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এ সুবাধে বাড়িতেই অবস্থান করতেন। আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশি সকলকেই মেইনটেইন করতেন । আমাদের পরিবারকে বন্ধনের মিহিসুতায় গেঁথে রেখেছিলেন পরম-মমতায়। আত্মীয় স্বজনের সম্পর্ককে জিইয়ে রাখতেন গভীর দায়িত্ববোধ নিয়ে। গরীব-দুখি, অসহায় মানুষকে ভালবাসতেন। তাদের দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।
আমার এই ভাই ছিলেন কুরআনের অকৃত্রিম খাদিম। ইন্তেকালের ক’বছর আগে থেকেই শারীরিক কিছু জটিলতা ছিল তা সত্ত্বেও দারুল কিরাতের খেদমত থেকে দূরে থাকেন নি। পির ও মুর্শিদ আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) এর স্নেহধন্য ছিলেন। আমার আব্বা আলহাজ মরহুম ডা. কুতুব উদ্দিন সাহেব ছিলেন ফুলতলী ছাহেবের মুরিদ ও প্রিয়ভাজন। আমরা ছোটবেলা থেকে ছাহেব কিবলার আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছি। আমার এই ভাইয়ের মুখে ছাহেব কিবলাহ ভাত তুলে দিয়েছিলেন। আজীবন সেই স্মৃতি ও মসলকি নিসবত অটুট রেখেছিলেন তিনি। মসলকের প্রতি ছিলেন আপোষহীন। ফুলতলীর বড়ছাহেব (আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী) উনাকে খুব স্নেহ করতেন।
এছাড়াও একজন স্কুল শিক্ষক হিসাবে আমাদের অঞ্চলে তিনি ছিলেন আদর্শের পরাকাষ্টা। ছাত্র-শিক্ষক সকলের মধ্যমনি। সাংসারিক জীবনে নিঃসন্তান আমার ভাই আমাদের ছেলেমেয়েদের নিজের সন্তানের মতোই আদরে আহলাদে রাখতেন। কখন কার কি প্রয়োজন তা তিনিই ভালো বুঝতেন। রূটিন করে সকলের খোঁজখবর নিতেন। ব্যক্তিগত জীবনে যখন কোন বিষয়ে মন খারাপ হতো বা দুঃখ পেতাম উনার সাথে শেয়ার করলেই মন ভালো হয়ে যেতো। বিদেশ বিভূঁইয়ে বসবাস করলেও প্রায় প্রতিদিনই ফোনে মেঝো ভাইসাবের সাথে কথা হতো। নিজ পরিবার, এলাকা আত্মীয়-পরিজন সকলের খোঁজখবর উনার কাছ থেকে নিতাম।
ভাইসাবের ইন্তেকালের পরও বাড়ি যাওয়া হয়। কিন্তু তিনি নেই। বুকভরা শূন্যতা সবসময় তাড়া করে। বাড়ির প্রতিটি ধুলোকনাও যেন তাঁকে মিস করে। প্রশস্থ পুকুরঘাট; যেখানটায় তিনি বসতেন সেদিকে তাকাই। মসজিদের পথধরে যেন মেঝো ভাইসাব এখনো হেঁটে যাচ্ছেন অনুভব হয়। কিন্তু পরক্ষণেই যেনো সব আলো নিভে যায়। সব স্মৃতি গুমোট বাধে। শুধু মহান রবের কাছে তার শূন্যতার বদলা চাই। আল্লাহ যেন আমার ভাইসাবকে বেহেশতের সুন্দরতম জায়গায় স্থান দেন। আমিন#
হাফিজ সাব্বির আহমদ: পরিচালক, সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ অ্যান্ড অ্যাডকেশন সেন্টার, বার্মিংহাম, ইউকে।
