সিলেটে বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে উৎসবের আমেজ, সাজ সাজ রব
- আপডেট সময় ০২:৩২:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর ২০২২
- / ২৫৪ বার পড়া হয়েছে
নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে শনিবার সিলেটে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জেলায় পরিবহন ধর্মঘটের আগেই সমাবেশ সফল করতে দলের নেতাকর্মীরা বাস, ট্রেন, নৌকা, মোটরসাইকেলে করে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে হাজির হচ্ছেন। মাঠেই চলছে তাদের খাওয়া-ঘুম।
নেতাকর্মীরা মিছিল, স্লোগানে মুখরিত করে তুলছেন পুরো এলাকা। সমাবেশ শুরুর ১৮ ঘণ্টা আগেই কানায় কানায় পূর্ণ সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। এখানে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান জেলার নেতারা।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘শুক্রবার রাতের মধ্যেই সিলেট নগরী জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকেই মানুষ আসতে শুরু করেছেন। সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি এখন জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে।’
স্থানীয় বিএনপি নেতারা জানান, শনিবার সকাল ১১টায় এ সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে আলিয়া মাদরাসা মাঠ ছাড়িয়ে আশেপাশের সব জায়গায় জনস্রোত ঘটবে। লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠবে পুরো সিলেট মহানগর।
এই বিভাগীয় গণসমাবেশের প্রধান সমন্বয়কারী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান জানান, এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ সরকারের উপর অতিষ্ঠ। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি, লুটপাট, মানুষের ভোটাধিকার হরণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপর ক্ষুব্ধ। তাদের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে শনিবারের সমাবেশে। শুধু স্মরণকালে নয়, সিলেটের ইতিহাসে এতো বড় সমাবেশ আর কখনো হয়নি।
জানা গেছে, বিএনপির সমাবেশে উপলক্ষে বৃহস্পতিবার থেকেই খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে জড়ো হন নেতাকর্মীরা। হোটেলে, মাজারে, মাঠের মধ্যে, তাঁবুতে রাত্রিযাপন করছেন তারা। আগত নেতাকর্মীদের জন্য আগে থেকেই মাঠে জেলা ভিত্তিক তাবু করা হয়েছে। এরপরও শীতের রাতে খোলা আকাশের নীচে অনেক নেতাকর্মী রাত্রিযাপন করছেন শুরু থেকে। গোসলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজকর্ম মাঠেই সেরে নিচ্ছেন তারা। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশন থেকে কয়েকটি মোবাইল টয়লেট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাও অপর্যাপ্ত বলে জানান নেতাকর্মীরা।
অনেক জেলার দায়িত্বশীল নেতারা দুই দিনের জন্য বাসা-বাড়ি ভাড়া করেছেন। সেখানে রান্না-বান্না করে মাঠে খাবার নিয়ে আসা হয়। থাকা-খাওয়ার কষ্টের মধ্যেও অনেক নেতাকর্মী ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে আনন্দ করছেন। অনেকে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন নিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠেন। এসব জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরা পথে পথে বাধার মুখে পড়ছেন বলে অভিযোগ করছেন বিএনপির নেতারা। বাস বন্ধ থাকায় পথ ভেঙ্গে ভেঙে বিকল্প উপায়ে সিলেটে আসছেন তারা।
মৌলভীবাজার পৌর কৃষক দলের সদস্য সচিব মোনাহিস কবির জানান, তারা কয়েক হাজার নেতাকর্মী বাস, ট্রেনে করে দুই দিন আগে সমাবেশস্থলে এসেছেন। পথে পথে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাধা দিয়েছেন, হামলা করেছেন। এরপরও তারা ভেঙ্গে ভেঙ্গে সমাবেশের মাঠে এসেছেন। কৃষক দলের দুই শতাধিক নেতাকর্মীর জন্য হোটেল থেকে এবং ভাড়া করা বাসা থেকে রান্না করা খাবার আনছেন।
ওই এলাকার পৌর ছাত্রদলের সদস্য সচিব সৈয়দ এবায়দুল হোসেন জানান, কুলাউড়া রেলস্টেশনে তাদের উপর হামলা করে তিনজন নেতাকমীকে আহত করা হয়েছে। এরপরও আহতদের নিয়ে তারা সমাবেশে এসেছেন বৃহস্পতিবার।
হবিগঞ্জের বানিয়াচর থেকে ষাটোর্ধ কৃষক এওর মিয়া জানান, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে তারা দিশেহারা। তাদের জীবন আর চলে না। কৃষির জন্য সারের দামও বাড়ানো হয়েছে। ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এভাবে তারা আর চলতে পারেন না বলে ক্ষোভে এই সমাবেশে এসেছেন। এখন তিনি পরিবর্তন চান।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি শাসমুন নূর জানান, তিনি সাবেক ইউপি সদস্য। ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু সরকারি দলের ভোট ডাকাতির কারণে তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি। ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলনের শরীক হতে শুক্রবার তিনি মোটরসাইকেলে করে সিলেটে এসেছেন। পথিমধ্যে পাগলা, জাউয়াসহ আরো অনেক স্থানে বাধার মুখে পড়েছেন। এরপরও তিনি চলে এসেছেন।
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর এলাকার কৃষক তমিজউদ্দিন এসেছেন বৃহস্পতিবার রাতে। এই শীতের রাতে কষ্ট হবে জেনেও তিনি সরকার পরিবর্তনের অন্দোলনে হাজির হয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, নৌকায় করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে তিনি সিলেটে এসেছেন মনের আবেগ নিয়ে। বহুদিন পর তিনি এরকম সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন বলে আনন্দ বোধ করছেন।
হবিগঞ্জ থেকে আসা মিন্টু বলেন, ‘সকাল থেকে জেলায় ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এ কারণে ভোররাতে নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে চলে এসেছি। সরকার দলীয় লোকজন পথে পথে বাধা দেয়ার পায়তারা করছেন। তবে বিএনপির নেতাকর্মীরা এসব উপেক্ষা করে সমাবেশে চলে আসবেন।’
বিএনপি নেতারা বলেছেন, সমাবেশ শুরুর আগেই বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছেন। সকাল হওয়ার পর থেকে তারাও মাঠে যোগ দেবেন। অনেক নেতাকর্মী এখন পথে রয়েছেন। শনিবারের সমাবেশে মানুষের ঢল নামবে। বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে আসবে। হুমকি-ধামকি আর পরিবহন ধর্মঘট দিয়ে আটকানো যাবে না।
এদিকে সরজমিনে দেখা গেছে, সিলেট বিভাগীয় সমাবেশ উপলক্ষ্যে পুরো বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড এমনকি ব্যাপক সংখ্যক তোরণ নির্মাণ করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। সমাবেশস্থলের আশেপাশে দলের বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ব্যানার পোস্টারে ছেয়ে গেছে। এর আগে অনুষ্ঠিত অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশে যেখানে বিএনপির নেতাকর্মীরা মিছিল-মিটিং কিংবা প্রচার-প্রচারণা করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েছেন, সেখানে এই বিভাগে হয়েছে তার উল্টোটা।
শুক্রবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কোনো মিছিল দেখা না গেলেও বিএনপির মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে শহরের বিভিন্ন অলিগলি। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের মোটরসাইকেল মহড়া দিতেও দেখা গেছে এদিন।
এদিকে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে শুক্রবার থেকে সিলেট বাদে এই বিভাগের অন্যান্য তিনটি জেলায় পরিবহন ধর্মঘট চলছে। শনিবার সকাল থেকে সিলেটেও এই ধর্মঘট শুরু হবে। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে শুক্রবার সকাল থেকে কোনো দূরপাল্লার বাস সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকাসহ মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়নি।
সিলেটে শনিবার থেকে ধর্মঘট হলেও অন্যান্য জেলায় শুক্রবার থেকে হওয়ায় কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যেও কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। এমনকি মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ থেকেও কোনো বাস সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসেনি। সিলেটের সঙ্গে কার্যত সারাদেশের সব ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় বিকল্প পথে সিলেটের সমাবেশে আসছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
পরিবহন ধর্মঘটের কারণে আগে থেকেই বিভিন্ন জেলার অনেক নেতাকর্মী সিলেট আসতে পারলেও অনেকে রয়েছেন পথে। অন্যরা নৌ পথে আসার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারা, দিরাই, শাল্লা ওবজামালগঞ্জ থেকে নৌকাযোগে যাত্রা শুরু করেছেন শতশত নেতাকর্মী। বৃহস্পতিবারও অনেকে নৌকাযোগে সিলেট পৌঁছান।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা কলিম উদ্দিন আহমদ মিলন জানিয়েছেন, প্রথমে ছাতক-দোয়ারা থেকে বাসযোগে নেতাকর্মীদের সমাবেশে যোগদানের কথা ছিল। এখন নৌপথে তারা আসছেন। শুক্রবার নগরীতে বিচ্ছিন্নভাবে মিছিল করে সমাবেশস্থলে যোগ দিয়েছেন আগাম আসা নেতাকর্মীরা।
এদিকে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল না করায় যাত্রীরা পড়েছেন দুর্ভোগে। শুক্রবার দুপুরে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, কিছু যাত্রী গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সিলেট থেকে বড় অংশের যাত্রী প্রতিদিন যাতায়াত করেন বিভাগের হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে।
হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসের কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেল, সেটি বন্ধ রয়েছে। আব্দুল হক নামের এক যাত্রী চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার সিলেটে এসেছিলেন দাবি করে জানান, কিভাবে এখন হবিগঞ্জ পৌঁছাবেন সেই চিন্তায় রয়েছেন তিনি। বাস টার্মিনালের বিভিন্ন বাসের কাউন্টারও বন্ধ পাওয়া যায়। সিলেট বিভাগের যাত্রী ছাড়াও ঢাকাগামী যাত্রীরাও আটকা পড়েছেন।
কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের অবস্থাও একই। সুনাগঞ্জের উদ্দেশ্যেও কোনো বাস ছেড়ে যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে কিছু আন্ত:উপজেলা বাস ও লেগুনা, সিএনজি অটোরিকশা যাত্রী বহনের চেষ্টা করছে।
সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল কবির পলাশ জানিয়েছেন, বিভিন্ন জেলায় ধর্মঘট হওয়ায় সিলেট থেকে আন্ত:জেলা ও দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে না। তিনি বলেন, আগাম পরিবহন বন্ধের ঘোষণা থাকায় যাত্রীর সংখ্যা কম ও ভোগান্তিও কম হচ্ছে বলে জানান।