ছাত্রজীবনে বাড়ির পার্শ্বে ছিল না কোন উচ্চ বিদ্যালয়। অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশুনা করেছেন । বিনিময় লজিং বাড়ির মালিকের কাজ ও করেছেন ।স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করবেন ।অনেক কষ্ট করে সেই সপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন । জীবনে টাকা কড়ির মোহ ছিল না। শুধু ছিল শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে। এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছেন বহু গুণী শিক্ষক। যাঁদের নিত্য পরিশ্রম আর উদ্যোগে শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। এমনই একজন গুণী শিক্ষক আবুল ইসলাম। তিনি মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার সাগরনাল উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : শ্রদ্ধেয় আবুল ইসলাম ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার শিলুয়াবাজার এর মন্ত্রীগাঁও গ্রামের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ। বাবা সুরুজ আলী ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক ও পাকিস্তান আমলের সরপঞ্চ। যা বর্তমান সময়ের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। মাতা জয়গুন বিবি ছিলেন সুগৃহিনী। ৯ ভাই ৪ বোনের তিনি সবার ছোট ।
শিক্ষা জীবন : আবুল ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি ১৯৫৯ সালে শিলুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬৫ সালে কুলাউড়া নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৯ সালে ওই বিদ্যালয় হতে মানবিক বিভাগে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় ৩য় শ্রেণীতে পাশ করেন। এরপর ১৯৭২ সালে কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় ২য় শ্রেণীতে পাশ করেন। কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজের ১ম ব্যাচ শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। তখন পাশের হার ছিল শতকরা ৪% আবুল ইসলাম ১৯৮২ সালে বিএড সম্পন্ন করেন
( চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় )।
কর্মজীবন :
আবুল ইসলাম সদ্য বিএ পাশ করার পরপর সাগরনাল এলাকা থেকে কয়েকজন মুরব্বী ব্যক্তিবর্গ তাঁর ভাইয়ের অনুমতিক্রমে ১৯৭৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাগরনাল উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। নতুন স্কুল বেতন ছাড়া শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন এলাকার মানুষকে শিক্ষিত করতে হবে সেই দায়িত্ব থেকেই রাত্রিকালীন বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করেন।গ্রামের কাচা রাস্তা, বর্ষার কাদা-পানি দিয়ে কর্মস্থলে যেতেন । স্কুলে দেরীতে যেতে পছন্দ করতেন না তিনি ।একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ৩৮ বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি অবসর গ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবনের স্মরণীয় ঘটনা :
শিক্ষা জীবনে বাড়ির পাশর্^বর্তী কোন বিদ্যালয় না থাকায় কুলাউড়া নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। থাকার জন্য প্রায় ৪ কি.মি. দূরে একটি বাড়িতে লজিং থাকেন। সেখানে কোন একদিন আবুল ইসলামের বড় ভাই লজিং বাড়ির যে কোন কাজে কর্মরত অবস্থায় দেখে সাথে সাথে নিয়ে আসেন নবীন চন্দ্র বিদ্যালয় হোস্টেলে। সে সময় থেকে হোস্টেলে থেকেই ছাত্রজীবন সমাপ্ত করেন। তিনি সে সময় থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। দিনে ক্লাসের পর ছাত্র রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকতেন। রাতের বেলায় রাতজেগে পড়াশুনা করতেন।
বিদ্যালয়ের জন্য যতকিছু :
শ্রদ্ধেয় আবুল ইসলাম শিক্ষকতা জীবনে বাড়ি থেকে কাচা রাস্তা দিয়ে প্রায় ৩ কি. মি. পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতেন। বাহুসিংহ গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে একটি ইবুলির খাল হাওরের দিকে বয়ে গেছে। সেখানে বাঁশের সাঁকো ছিল। ঝড় বৃষ্টিতেই সাঁকোটি ভেঙ্গে যেত। তখন তিনি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দপ্তরি শহিদের মাধ্যমে ৯টার পূর্বেই সাঁকোটি মেরামত করাতেন। যাতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে কোন রকম অসুবিধা যেন না হয়। তখনকার সময় সাগরনাল উচ্চ বিদ্যালয়টি বাঁশের তরজার বেড়া ছিল। তৎকালীন কুলাউড়ার সাংসদ যে কোন দলের হোক না কেন স্কুলের উন্নয়নের জন্য আবেদন রাখতেন এবং নি:স্বার্থভাবে বিদ্যালয়ের বিল্ডিং সুপারভিশন সবকিছুর সমাধান করে গেছেন। আবুল ইসলাম বিদ্যালয়ের লাইব্রেরীর জন্য তাঁর এক ক্লাসমেট যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ডা. নিপেন্দ্র চন্দ্র নাথের কাছে আবদার করা মাত্রই লাইব্রেরীর কাজ সফল হয়। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আবুল ইসলাম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে স্কুলের উন্নয়নের জন্য ছুটির পর এমনকি রাত্রিকালীনও এলাকার মুরব্বিদের নিয়ে চা বাগানে ও প্রতিটা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করেন। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সহযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষকতা জীবনে অনেক সুযোগ সুবিধা সামনে আসলেও তা গ্রহণ করেননি। একমাত্র বিদ্যালয়ের সঠিক উন্নয়নে প্রচেষ্টায় থাকতেন। গুণী এই শিক্ষক জীবনে টাকা কড়ির মোহ ছিল না। তিনি শিক্ষার আলো এলাকার ঘরে ঘরে পৌছার দায়িত্ব পালন করেন। ঐ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা ডাক্তার, সচিবের দায়িত্ব পালন করে।
সামাজিক কর্মকান্ড :
গুণী শিক্ষক আবুল ইসলাম দীর্ঘ ২০ বছর যাবত এলাকার মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কুলাউড়া উপজেলার সহ সভাপতি ও পরবর্তীতে জুড়ী উপজেলা সিনিয়র সহ সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এসএসসি পরীক্ষায় হল সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এলাকার সালিশ বিচারে তাঁর ভূমিকা ছিল।
পারিবারক :
গুণী শিক্ষক আবুল ইসলাম দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। বড়ছেলে মাজহারুল ইসলাম বেডফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটি (ইংল্যান্ড)থেকে ব্যবসা ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি ইউকে প্রবাসী স্বপরিবারে। ছোট ছেলে মিনহাজুল ইসলাম-এমবিবিএস, নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ। ছোট ছেলের স্ত্রী ফারহানা কান্তা-এমবিবিএস, নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ। মেয়ে মোর্শেদা ইসলাম ইন্টারের শিক্ষার্থী।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় জুড়ী উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
শ্রদ্ধেয় আবুল ইসলাম স্যার সততা, মানবিকতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যতা ও শিক্ষকতা জীবনের উত্তম আদর্শতা ছিল। যেটা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি কোনদিন শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত উঠাননি। শুধু শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ার কাজে সুন্দর সবল ও সুন্দর পথ খুঁজে বের করতেন। বিদ্যালয় ছিল প্রাণ, বিদ্যালয় ছিল সম্পদ। জীবনের আটত্রিশ বছর শিক্ষকতায় পার করা মহান এই মানুষটি বর্তমানে শারীরিক অসুস্থতায় ভোগছেন। আমরা শ্রদ্ধেয় আবুল ইসলাম স্যারের সুস্থতা কামনা করি।