দুই দফায় দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান,কাটেনি আতঙ্ক
- আপডেট সময় ০৪:৩৮:১৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৩
- / ৫২৬ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়ন। পাহাড়ি টিলাবেষ্টিত পূর্ব টাট্টিউলী গ্রামের আশপাশের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। ‘অপারেশন হিল সাইড’ শেষ হলেও পুরো ইউনিয়নজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দুই দফায় দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধানসহ ২৭ জন জঙ্গি আটকের ঘটনায় শঙ্কায় রয়েছেন এলাকার মানুষজন।
তারা জানান, এই এলাকায় অনেক লোক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ঘরবাড়ি তৈরি করছে। তবে কোনোদিন সমস্যা না হলেও এখন যেহেতু জঙ্গির সন্ধান মিলেছে তাই এলাকায় অপরিচিত লোকদের বিষয়ে ভালো করে খোঁজখবর নেয়া দরকার।
তাদের ধারণা, এখনও পাহাড়ের আনাচে কানাচে জঙ্গি আস্তানা থাকতে পারে। তাই প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্রিউলি এলাকার অনেক জমিই সরকারি খাসজমি। নির্জন পাহাড়ি ওই এলাকায় লোকজন খাসজমি দখল করে বসতি করেছেন। কেউ কেউ সেই জমি বিক্রিও করেন। স্থানীয়ভাবে যাকে ‘দখল বিক্রি’ বলা হয়। ওই জমির দলিল হিসেবে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহার হয়। বর্তমানে এখানে প্রায় ৩শত পরিবার থাকে। এসব পরিবারের লোকজন জমি কিনে বসবাস করছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ এতেই সুযোগ নেন জঙ্গিরা। আটককৃতারা স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে জমি কিনে সেখানে আস্তানা গড়েন। দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় খাসজমি ‘দখল বিক্রি’ বেচাকেনা চললেও জমি উদ্ধার কিংবা অবৈধ দখল উচ্ছেদে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, প্রায় দুই মাস আগে কুলাউড়ার কর্মধার পূর্ব টাট্টিউলী গ্রামের বাসিন্দা ও প্রবাসী রাশিদ আলীর ৫০ শতকের টিলা জমি ক্রয় করে তারা। ওই টিলায় তিনটি টিনের ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন শিশু-নারীসহ কয়েকটি পরিবার। তারা আশপাশের মানুষকে জানিয়েছে, নদী ভাঙ্গনে নিজেদের বাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ায় এখানে জমি ক্রয় করেছে ও তারা সেখানে সবজি চাষসহ সামাজিক বনায়ন করবে বলেও জানায়।
এলাকাবাসী বলেন, সহজে জমি কেনার সুযোগ পায় জঙ্গিরা। জমির মালিক রাশিদ আলী কাতারে থাকেন। তার অনুপস্থিতিতে ছোট ভাই রফিক মিয়ার সঙ্গে টাকা লেনদেন হয়। সম্প্রতি রফিকও দুবাইয়ে পাড়ি জমান।
রাশিদ আলীর বড়ভাই রশিদ আলী বলেন, ‘আমার ছোট ভাই প্রবাসী রাশিদ আলীর জায়গাটি ক্রয় করেন তারা। পুলিশ যাদের ধরছে, তারা যে খারাপ তা আগে কারও জানা ছিল না।’
স্থানীয় বাসিন্দা তোফাজ্জল মিয়া ও আবদুল মুনিম বলেন, তারা মাসখানেক পূর্বে ৩-৪টি পরিবার বাইশালী টিলায় আসে। হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আগমন। পরে জানতে পারলাম এখানে জঙ্গি আস্তানা। আমরা আতঙ্কে আছি।
ওই টিলার পাশেই দিনমজুর আবদুর রাজ্জাকের বসতঘর। তার স্ত্রী রেজিয়া বেগম বলেন, প্রায় দুই মাস আগে তারা এখানে এসেছে। টিলা কেটে ঘর বানায়। পুরুষ, মহিলা আর বাচ্চাও ছিলো। নদী ভাঙনে নাকি তাদের বাড়িঘর নিয়া গেছে। তাই, এইখানে এসেছে। এখন শুনছি তার জঙ্গি, খুবই ভয়ে আছি।
এদিকে, কিছুদিন আগে সংগঠনের এক সদস্য ঢাকায় গেলে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। জিজ্ঞাসাবাদে বাইশালী টিলায় তাদের নতুন আস্তানার কথা স্বীকার করে। সেই সূত্রে সিটিটিসির সদস্যরা ওই এলাকায় প্রায় ৭ দিন সেখানে বসবাসকারীদের নজরদারিতে রাখেন। নিশ্চিত হওয়ার পর গত শুক্রবার (১১ আগস্ট) রাতে পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামের জুগিটিলায় বাইশালী নামক এলাকায় একটি টিলার ওপর নতুন স্থাপিত বাড়িটি ঘিরে রাখে সিটিটিসি ইউনিট।
এরপর শনিবার সকালে অভিযান করে বাড়িটি থেকে ১৩ জনকে আটক করা হয়। এদের মধ্যে ৪জন পুরুষ ও ৬জন নারী। এছাড়া ৩ শিশুও ছিল বাড়িটিতে। এসময় আস্তানা থেকে প্রায় ৩ কেজি বিস্ফোরক ও ৫০টি ডেটোনেটর উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ সামগ্রী, কমব্যাট বুট, বক্সিন ব্যাগ এবং কয়েক বস্তা জিহাদি বই জব্দ করা হয়। আটকরা ‘ইমাম মাহদির কাফেলা’ নামে নতুন একটি সংগঠনের সদস্য বলে জানান সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।
এর দুদিন পর গত সোমবার (১৪ আগস্ট) সকালে কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের আছকরাবাদ বাজারের স্থানীয় মানুষ ও সিএনজি আটোরিকশার চালকেরা সন্দেহজনকভাবে ১৭ জন ব্যক্তিকে আটক করেন। খবর পাওয়ার পর সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে এসে পৌছায় সিটিটিসির সদস্যরা। পরে মঙ্গলবার ভোরে আটককৃতদের নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযান চালিয়ে দুটি ঘর থেকে ৬ কেজি এক্সক্লোসিভ, ১৪ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার করা হয়। যেদিন তাদের আটক করা হয় তখন তাদের সাথে ছিল নগদ ২ লাখ টাকা, দুটি বড় দা এবং ৯৫টি ডেটোনেটর।
কর্মধা ইউপি সদস্য আবদুল কাদির বলেন, জঙ্গি আস্তানাসহ জঙ্গি আটকের ঘটনায় সবাই ভয় পেয়েছেন। সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
কর্মধা ইউপি চেয়ারম্যান মো. মুহিবুল ইসলাম আজাদ জানান, এই এলাকার অনেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ঘরবাড়ি তৈরি করছেন। তবে কোনোদিন কোনো সমস্যা হয়নি। এখন যেহেতু জঙ্গির সন্ধান মিলেছে তাই এলাকায় অপরিচিত লোকদের বিষয়ে ভালো করে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য স্থানীয়দের সচেতন থাকার পাশাপাশি এখানে জমি ক্রয় বিক্রয় করতে হলে ইউনিয়ন পরিষদকে অবগত করতে বলা হয়েছে।
জমি কেনাবেচার বিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান খোন্দকার জানান, কীভাবে সরকারি জমি কিনলেন, তা তদন্তের জন্য সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে। প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।