ঢাকা ০২:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো.ফজলুর রহমান স্যার নৈতিকতায় ছিলেন অটল

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০১:২২:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / ৯৫০ বার পড়া হয়েছে
ফয়সল আহমদ রুহেল :
পিতা ছিলেন মসজিদের ইমাম। মক্তব শিক্ষকও ছিলেন। কোরআন শিক্ষা দিতেন। বাবার দেখানো পথ ধরে তিনি শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে যান। তবে মক্তব শিক্ষক নন। স্কুল শিক্ষক হিসেবে চাকুরী জীবন শুরু। দীর্ঘ সাড়ে ৩৪ বছর একই প্রতিষ্ঠানে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কর্তব্য পালন। নিজের আন্তরিকতা এবং ভালবাসায় বিদ্যালয়ের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম। বিদ্যালয়ের অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী। শিক্ষক বাবার আদর্শ, সম্মান এবং রক্তে মিশে থাকা নৈতিকতায় ছিলেন অটল। সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. ফজলুর রহমান মৌলভীবাজার সদরের জগৎসী গোপাল কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : মো. ফজলুর রহমান স্যার ১৯৫২ সালের ১ মে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১১নং মোস্তফাপুর ইউপি’র বাহারমর্দন গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাজী আব্দুল করিম, মাতা মরহুমা ছগিরা ভানু। হাজী আব্দুল করিম মক্তব শিক্ষক ছিলেন। কোরআন শিক্ষা দিতেন। পাশাপাশি মসজিদের ইমামতিও তিনি করতেন। মো. ফজলুর রহমান রহমান স্যার রা তিন ভাই, দুইবোন। উনার বড় দুই ভাই ও শিক্ষক ছিলেন। ৩ ভাইয়ের ও ২ বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ।
বর্ণাঢ্য জীবন : 
মো. ফজলুর রহমানের বাড়ির নিকটে মসজিদ ও প্রাইমারী স্কুল ছিল। ওই স্কুলেই প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করে মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পিতা মসজিদের ইমাম ও মক্তব শিক্ষক ছিলেন অবৈতনিক। কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ধান বিক্রি করে তিন ভাই ও দুই বোনের লেখাপড়ার খরচ চালান। শিক্ষা জীবনে তিনি পায়ে হেঁটে মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ করেন। তখনকার সময়ে যানবাহন কম ছিল। বড় দুই ভাই শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন। চাকুরীর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সততা ও নিষ্ঠার সাথে ক্লাস করার চেষ্টা করেন। স্বাধীনতার পর প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আইনশৃঙ্খলা চরমভাবে খারাপ ছিল। ছাত্ররা শিক্ষকদের অবাধ্য ছিল। পরীক্ষা হলে অবাধে নকল চলত। তিনি এবং তার  সহযোগী দুইজন শিক্ষক মো. মোস্তফা ও বাবু অরুন চন্দ্র এর সহযোগিতায় পরীক্ষা হলে অবাধে নকল করা বন্ধ করতে সক্ষম হন।
শিক্ষাজীবন :
মো. ফজলুর রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা ১৯৫৭ সাল বাহার মর্দান প্রাইমারী স্কুল হতে শুরু। তিনি ১৯৬১ সালে ওই স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬২ সালে মৌলভীবাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ওই মাদ্রাসা হতে ১৯৬৭ সালে মাদ্রাসা বোর্ড, ঢাকার অধীনে দাখিল ফাইনাল পরীক্ষায় ২য় বিভাগে পাশ করেন। একই মাদ্রাসা হতে ১৯৬৯ সালে আলিম ফাইনাল পরীক্ষা ২য় বিভাগে পাশ করেন। এছাড়া ১৯৭০ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এসএসসি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৩ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে মৌলভীবাজার কলেজ থেকে এইচএসসি (বিজ্ঞান) পরীক্ষায় ৩য় বিভাগ পান। তিনি ১৯৬৭ সালে ঐ কলেজ হতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন।
পারিবারিক :
মো. ফজলুর রহমান স্যার দুই ছেলে-এক মেয়ের জনক। বড় ছেলে কালিনারি আর্টস এ লেখাপড়া করে বিভিন্ন ফাইভ স্টার হোটেলে প্রায় ৬ বছর শেফের চাকুরী করেন। বর্তমানে বাড়িতে আছেন। মেয়ে ইংরেজীতে অনার্স শেষ করে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতায় আছেন (বিবাহিত)। ছোট ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে   বেসরকারী ফার্মে কিছুদিন কাজ করার পর ২০২০ সালে পড়ার জন্য লন্ডন চলে যান।
কর্মজীবন : 
মো. ফজলুর রহমান স্যার ১৯৭৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন জগৎসী গোপাল কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর স্থায়ীভাবে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৯৩ সালে বিদ্যালয়টি কলেজে রূপান্তরিত হয়। নামকরণ করা হয় জগৎসী জি,কে,এম সাইফুর রহমান বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়। ২০০৯ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ খালি হওয়াতে তাঁকে ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত করা হয়। একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর পর সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ হতে ২০১৪ সালের ১ মে অবসর গ্রহণ করেন। মো. ফজলুর রহমান স্যারের মোট কর্মকাল ছিল ৩৪ বছর ৭ মাস ২২ দিন।  এই কর্ম জীবনে বেশির ভাগ পথ তিনি পায়ে হেঁটে যাতায়াত করেন।
প্রশিক্ষণ : 
তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে ১৯৮৩ সালে নতুন বিজ্ঞান শিক্ষা কর্মসূচীর (বিজ্ঞান বিষয়ে) উপর ২ সপ্তাহের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষন নেন হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।  এছাড়া ১৯৯১ সালে বিজ্ঞান শিক্ষার উপর গুরুত্ব (জীব বিজ্ঞান) বিষয়ে ২ সপ্তাহের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষন নেন কুমিল্লা বিএড কলেজ থেকে।
বিদ্যালয়ের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী : 
জগৎসী গোপাল কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে কিছু অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি ধরা পরে। তিনি এবং আরো ২/৩ জন শিক্ষক মিলিতভাবে এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এহেন কাজ কর্মগুলো বন্ধ করতে সক্ষম হন। যেমন দশম শ্রেণীর প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ২য় স্থান অধিকারী ছাত্রকে নাম্বার বাড়িয়ে দিয়ে ১ম করা হয়েছে। বাধা দিলেও কার্যকর হয়নি। পরবর্তীতে নির্বাচনী নির্বাচনী পরীক্ষায় আবার পরিবর্তন করলে জোর প্রতিবাদ করলে তা পরিবর্তন করতে পারেনি। এই ছাত্র বর্তমানে উচ্চ পদে কর্মরত আছে। সব সময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। প্রতিষ্ঠানের নামাজের স্থান একটি রুমের মধ্যে ছিল। লন্ডন প্রবাসী এক ছাত্রের অর্থায়নে মসজিদ নির্মাণ করেন।
শিক্ষকের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা :
মো. ফজলুর রহমান স্যারের গড়া ছাত্ররা বিভিন্ন পর্যায়ে স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটিতে শিক্ষকায় উচ্চ পদ নিয়ে চাকুরিতে। শিক্ষকতা একটি আদর্শ পেশা। আদর্শ রক্ষা করা শিক্ষকদের নিজ দায়িত্ব। তিনি ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে বুঝানোর চেষ্টা করেন। ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে আন্তরিকভাবে ভাল পেত এবং তিনিও তাদেরকে আদর করতেন। বিশেষ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, ড. শফিকুর রহমান, অমরেন্দ্র দেবনাথ, নুরুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, কৃষ্ণ পদ ধর, নিত্য গোপাল গোস্বামী, শামছুজ্জামান, ছুফিয়ান, মুক্তা রাণী গোস্বামী, চিত্রা দেব রায় ও ফজরুল ইসলাম আরও অনেক সুনামধন্য ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। গুণমুগ্ধ ছাত্ররা এখনো যেখানে পায় গভীর শ্রদ্ধা জানায়। আনন্দে মন ভরে যায়। শিক্ষকা জীবনের এটুকুই পাওনা।
বিদায় :
মো. ফজলুর রহমান স্যার  জগৎসী জি,কে,এম সাইফুর রহমান বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে একটানা সাড়ে ৩৪ বছর শিক্ষকতার পর ২০১৪ সালের ১ মে অবসর গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মো. ফজলুর রহমান স্যারকে অশ্রুঝড়া নয়নে বিদায় দেওয়া হয়। সেই দিনটির কথা আজো মনে পড়ে স্যারের। ২০১১ সালে মুমিনুল হক একাডেমী (ইতিহাস বিভাগ) এর পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসাবে ভূষিত করা হয়।
সামাজিক কর্মকা- : 
স্কুল মাদ্রাসা ও কলেজের ছাত্রজীবনে পল্লীমঙ্গল সমিতি গঠন করে গ্রামের উন্নয়নমূলক কাজ কর্ম যেমন কাঁচা রাস্তা পুল মেরামত, পানির নানা ঝোঁপ জঙ্গল পরিস্কার করা হয়েছে। শিক্ষকদের সম্মান ও মুরব্বিয়ানদের কথা মেনে চলেছেন।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
ছাত্রজীবনে মাদ্রাসা ও কলেজে পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করা মো. ফজলুর রহমান স্যার শিক্ষাজীবন শেষে মানুষ গড়ার কারখানায় জীবনের স্বর্ণালী দিন কাটিয়েছেন। গুণী এই মানুষটি নম্র ও ভদ্র আচরণ দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের হৃদয় জয় করে নেন। তাঁর পিতা সারা জীবন ইসলাম শিক্ষার পাশাপাশি নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিও শিক্ষকতা জীবনে শ্রেণী কক্ষের পাঠদানের মধ্যে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র গঠন ও অন্যান্য উপদেশমূলক শিক্ষা দিতেন। ছাত্রছাত্রীদের যেমন শাসন করেন তেমনিভাবে আদরও করেছেন। তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের পথপ্রদর্শক। অবসর গ্রহণের ৯ বছর অতিবাহিত হয়। এখনো সুস্থ শরীরে আছেন।  অবসর সময়ে পরিবারের কাজে সহায়তা করেন। শ্রদ্ধেয় মো. ফজলুর রহমান স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।
ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

মো.ফজলুর রহমান স্যার নৈতিকতায় ছিলেন অটল

আপডেট সময় ০১:২২:৩৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২
ফয়সল আহমদ রুহেল :
পিতা ছিলেন মসজিদের ইমাম। মক্তব শিক্ষকও ছিলেন। কোরআন শিক্ষা দিতেন। বাবার দেখানো পথ ধরে তিনি শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে যান। তবে মক্তব শিক্ষক নন। স্কুল শিক্ষক হিসেবে চাকুরী জীবন শুরু। দীর্ঘ সাড়ে ৩৪ বছর একই প্রতিষ্ঠানে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কর্তব্য পালন। নিজের আন্তরিকতা এবং ভালবাসায় বিদ্যালয়ের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম। বিদ্যালয়ের অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী। শিক্ষক বাবার আদর্শ, সম্মান এবং রক্তে মিশে থাকা নৈতিকতায় ছিলেন অটল। সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. ফজলুর রহমান মৌলভীবাজার সদরের জগৎসী গোপাল কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : মো. ফজলুর রহমান স্যার ১৯৫২ সালের ১ মে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১১নং মোস্তফাপুর ইউপি’র বাহারমর্দন গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাজী আব্দুল করিম, মাতা মরহুমা ছগিরা ভানু। হাজী আব্দুল করিম মক্তব শিক্ষক ছিলেন। কোরআন শিক্ষা দিতেন। পাশাপাশি মসজিদের ইমামতিও তিনি করতেন। মো. ফজলুর রহমান রহমান স্যার রা তিন ভাই, দুইবোন। উনার বড় দুই ভাই ও শিক্ষক ছিলেন। ৩ ভাইয়ের ও ২ বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ।
বর্ণাঢ্য জীবন : 
মো. ফজলুর রহমানের বাড়ির নিকটে মসজিদ ও প্রাইমারী স্কুল ছিল। ওই স্কুলেই প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করে মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পিতা মসজিদের ইমাম ও মক্তব শিক্ষক ছিলেন অবৈতনিক। কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ধান বিক্রি করে তিন ভাই ও দুই বোনের লেখাপড়ার খরচ চালান। শিক্ষা জীবনে তিনি পায়ে হেঁটে মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ করেন। তখনকার সময়ে যানবাহন কম ছিল। বড় দুই ভাই শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন। চাকুরীর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সততা ও নিষ্ঠার সাথে ক্লাস করার চেষ্টা করেন। স্বাধীনতার পর প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আইনশৃঙ্খলা চরমভাবে খারাপ ছিল। ছাত্ররা শিক্ষকদের অবাধ্য ছিল। পরীক্ষা হলে অবাধে নকল চলত। তিনি এবং তার  সহযোগী দুইজন শিক্ষক মো. মোস্তফা ও বাবু অরুন চন্দ্র এর সহযোগিতায় পরীক্ষা হলে অবাধে নকল করা বন্ধ করতে সক্ষম হন।
শিক্ষাজীবন :
মো. ফজলুর রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা ১৯৫৭ সাল বাহার মর্দান প্রাইমারী স্কুল হতে শুরু। তিনি ১৯৬১ সালে ওই স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬২ সালে মৌলভীবাজার টাউন সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ওই মাদ্রাসা হতে ১৯৬৭ সালে মাদ্রাসা বোর্ড, ঢাকার অধীনে দাখিল ফাইনাল পরীক্ষায় ২য় বিভাগে পাশ করেন। একই মাদ্রাসা হতে ১৯৬৯ সালে আলিম ফাইনাল পরীক্ষা ২য় বিভাগে পাশ করেন। এছাড়া ১৯৭০ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে এসএসসি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৩ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে মৌলভীবাজার কলেজ থেকে এইচএসসি (বিজ্ঞান) পরীক্ষায় ৩য় বিভাগ পান। তিনি ১৯৬৭ সালে ঐ কলেজ হতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন।
পারিবারিক :
মো. ফজলুর রহমান স্যার দুই ছেলে-এক মেয়ের জনক। বড় ছেলে কালিনারি আর্টস এ লেখাপড়া করে বিভিন্ন ফাইভ স্টার হোটেলে প্রায় ৬ বছর শেফের চাকুরী করেন। বর্তমানে বাড়িতে আছেন। মেয়ে ইংরেজীতে অনার্স শেষ করে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতায় আছেন (বিবাহিত)। ছোট ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে   বেসরকারী ফার্মে কিছুদিন কাজ করার পর ২০২০ সালে পড়ার জন্য লন্ডন চলে যান।
কর্মজীবন : 
মো. ফজলুর রহমান স্যার ১৯৭৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন জগৎসী গোপাল কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর স্থায়ীভাবে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৯৩ সালে বিদ্যালয়টি কলেজে রূপান্তরিত হয়। নামকরণ করা হয় জগৎসী জি,কে,এম সাইফুর রহমান বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়। ২০০৯ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ খালি হওয়াতে তাঁকে ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত করা হয়। একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর পর সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ হতে ২০১৪ সালের ১ মে অবসর গ্রহণ করেন। মো. ফজলুর রহমান স্যারের মোট কর্মকাল ছিল ৩৪ বছর ৭ মাস ২২ দিন।  এই কর্ম জীবনে বেশির ভাগ পথ তিনি পায়ে হেঁটে যাতায়াত করেন।
প্রশিক্ষণ : 
তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে ১৯৮৩ সালে নতুন বিজ্ঞান শিক্ষা কর্মসূচীর (বিজ্ঞান বিষয়ে) উপর ২ সপ্তাহের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষন নেন হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।  এছাড়া ১৯৯১ সালে বিজ্ঞান শিক্ষার উপর গুরুত্ব (জীব বিজ্ঞান) বিষয়ে ২ সপ্তাহের স্বল্পকালীন প্রশিক্ষন নেন কুমিল্লা বিএড কলেজ থেকে।
বিদ্যালয়ের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী : 
জগৎসী গোপাল কৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে কিছু অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি ধরা পরে। তিনি এবং আরো ২/৩ জন শিক্ষক মিলিতভাবে এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এহেন কাজ কর্মগুলো বন্ধ করতে সক্ষম হন। যেমন দশম শ্রেণীর প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ২য় স্থান অধিকারী ছাত্রকে নাম্বার বাড়িয়ে দিয়ে ১ম করা হয়েছে। বাধা দিলেও কার্যকর হয়নি। পরবর্তীতে নির্বাচনী নির্বাচনী পরীক্ষায় আবার পরিবর্তন করলে জোর প্রতিবাদ করলে তা পরিবর্তন করতে পারেনি। এই ছাত্র বর্তমানে উচ্চ পদে কর্মরত আছে। সব সময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। প্রতিষ্ঠানের নামাজের স্থান একটি রুমের মধ্যে ছিল। লন্ডন প্রবাসী এক ছাত্রের অর্থায়নে মসজিদ নির্মাণ করেন।
শিক্ষকের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা :
মো. ফজলুর রহমান স্যারের গড়া ছাত্ররা বিভিন্ন পর্যায়ে স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটিতে শিক্ষকায় উচ্চ পদ নিয়ে চাকুরিতে। শিক্ষকতা একটি আদর্শ পেশা। আদর্শ রক্ষা করা শিক্ষকদের নিজ দায়িত্ব। তিনি ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে বুঝানোর চেষ্টা করেন। ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে আন্তরিকভাবে ভাল পেত এবং তিনিও তাদেরকে আদর করতেন। বিশেষ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ড. গৌর গোবিন্দ গোস্বামী, ড. শফিকুর রহমান, অমরেন্দ্র দেবনাথ, নুরুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, কৃষ্ণ পদ ধর, নিত্য গোপাল গোস্বামী, শামছুজ্জামান, ছুফিয়ান, মুক্তা রাণী গোস্বামী, চিত্রা দেব রায় ও ফজরুল ইসলাম আরও অনেক সুনামধন্য ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। গুণমুগ্ধ ছাত্ররা এখনো যেখানে পায় গভীর শ্রদ্ধা জানায়। আনন্দে মন ভরে যায়। শিক্ষকা জীবনের এটুকুই পাওনা।
বিদায় :
মো. ফজলুর রহমান স্যার  জগৎসী জি,কে,এম সাইফুর রহমান বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে একটানা সাড়ে ৩৪ বছর শিক্ষকতার পর ২০১৪ সালের ১ মে অবসর গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মো. ফজলুর রহমান স্যারকে অশ্রুঝড়া নয়নে বিদায় দেওয়া হয়। সেই দিনটির কথা আজো মনে পড়ে স্যারের। ২০১১ সালে মুমিনুল হক একাডেমী (ইতিহাস বিভাগ) এর পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসাবে ভূষিত করা হয়।
সামাজিক কর্মকা- : 
স্কুল মাদ্রাসা ও কলেজের ছাত্রজীবনে পল্লীমঙ্গল সমিতি গঠন করে গ্রামের উন্নয়নমূলক কাজ কর্ম যেমন কাঁচা রাস্তা পুল মেরামত, পানির নানা ঝোঁপ জঙ্গল পরিস্কার করা হয়েছে। শিক্ষকদের সম্মান ও মুরব্বিয়ানদের কথা মেনে চলেছেন।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
ছাত্রজীবনে মাদ্রাসা ও কলেজে পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করা মো. ফজলুর রহমান স্যার শিক্ষাজীবন শেষে মানুষ গড়ার কারখানায় জীবনের স্বর্ণালী দিন কাটিয়েছেন। গুণী এই মানুষটি নম্র ও ভদ্র আচরণ দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের হৃদয় জয় করে নেন। তাঁর পিতা সারা জীবন ইসলাম শিক্ষার পাশাপাশি নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিও শিক্ষকতা জীবনে শ্রেণী কক্ষের পাঠদানের মধ্যে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক চরিত্র গঠন ও অন্যান্য উপদেশমূলক শিক্ষা দিতেন। ছাত্রছাত্রীদের যেমন শাসন করেন তেমনিভাবে আদরও করেছেন। তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের পথপ্রদর্শক। অবসর গ্রহণের ৯ বছর অতিবাহিত হয়। এখনো সুস্থ শরীরে আছেন।  অবসর সময়ে পরিবারের কাজে সহায়তা করেন। শ্রদ্ধেয় মো. ফজলুর রহমান স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।