মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ স্যার জীবনের সব শখ বিলিয়ে দেন কর্মজীবনে
- আপডেট সময় ০১:২১:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২
- / ৫২৯ বার পড়া হয়েছে
ফয়সল আহমদ রুহেল :
সংসারে অনেক অভাব অনটন ছিল। পিতা ছিলেন আদর্শ কৃষক। মনে বহুদূর এগোনোর স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাবার দৈন্যতার পীড়ায় জ্বালাচ্ছিল। তাই সংসারের সকল দায়- দায়িত্ব যেন মাথায়। চলার পথটি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। আঁকা বাঁকা পথে সামনে চলা। শিক্ষা জীবনে বিভিন্ন জায়গায় লজিংয়ে কাটিয়েছেন বেশ কাল। হোস্টেলে এবং ম্যাচেও থেকেছেন। জীবনের সকল শখ, স্বপ্ন যোগ্যতা ও দক্ষতা ব্যয় করেছেন জ্ঞান বিতরণের মত মহান ব্রতকর্মে। ভালো সুযোগ সুবিধা ছেড়ে শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরেন। অথচ সন্তানরা আজ মাধ্যমিক পাড়ি দিতে পারেনি। তিনি অবসরে। সেই তাঁকে আজ জীবন সায়াহ্নে এসে বেদনার অশ্রুস্নাত নয়নে কষতে হচ্ছে শিক্ষকতা জীবনের প্রাপ্তি। সন্তানরা আজো তাঁকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে। তিনি কেন শূন্যতাকে বরন করলেন ? এদেশের আনাচে কানাচেতেও ছড়িয়ে রয়েছেন মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের মতো বহু গুণী শিক্ষক। তিনি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার দি বাডস রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক।
জন্ম : মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ ১৯৬২ সালের ১ মার্চ মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কেরামতনগরের বালীগাঁও গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. সাজিদ মিয়া, মাতা আজিজুন নেছা। ৩ ভাই ও ৩ বোনের মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ ২য় সন্তান। বর্তমানে তিনি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের পূর্বাশা আবাসিক এলাকায় বসবাস করছেন।
শৈশব : মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের শিক্ষা জীবনের তথ্যাবলী অনেক বিস্তৃত ও করুণ ছিল। আলাপনকালে স্মৃতির পাতা থেকে স্যার জানান, তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর পরিবারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। যার কারণে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তারপরও বাবা তাঁকে নিকটস্থ আলিয়া মাদ্রাসা ভর্তি করান। মাদ্রাসায় খরচ কম হবে এই ভেবে। এ সময় তাদের বাড়িতে সাবেক ঢাকা আলিয়ার সুপার ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম জনাব হরমুজ উল্যা (শায়দা সাহেব) মাঝে মধ্যে আসতেন। বিষয়টি তাঁর নজরে নিলে তিনি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদকে ভানুগাছ সফাত আলী সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। শুরু হল আরেক জীবন। সেখানেও দুটি ক্লাসে অটো প্রমোশন দিয়ে একটু এগিয়ে যান। অত:পর সেখান থেকে বদলি নিয়ে সিলেট সৎপুর আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন।
শিক্ষা জীবন : মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ ১৯৬৬ সালে ভানুগাছ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৭০ সনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৭২ ইং সনে সেখান থেকে বদলি নিয়ে সিলেট সৎপুর আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৭৪ ইং সনে দাখিল (এসএসসি সমান) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। অসুস্থতার কারনে এক বিষয়ে পরীক্ষা দিতে না পারায় পরের বছর ঐ এক বিষয়ে কমপার্টমেন্টাল পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। অত:পর ১৯৭৫ ইং সনে ভানুগাছ সফাত আলী সিনিয়র মাদ্রাসায় আলীম শ্রেণীতে ভর্তি হন (এইচএসসি সমমান) এবং ১৯৭৬ ইং সনে আলিম দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেন। সেখান থেকে ১৯৭৮ ইং সনে ফাজিল (ডিগ্রি লেভেল) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। তারপর ১৯৭৯ ইং সনে সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় কামিল (হাদীস) শ্রেণীতে ভর্তি হন (মাস্টার্স সমমান) এবং ১৯৮১ ইং সনে কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য, সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ার সময়ই সিলেট মদন মোহন কলেজে (নাইট সেশন) এইচএসসি (মানবিক) শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৮২ ইং সনে এইচএসসি পাশ করেন।
কর্মজীবন : পরিবারের দৈন্যতায় আব্দুল হামিদের ভাইয়েরা লেখাপড়ায় বেশিদূর এগুতে পারেননি। তাই সংসারের সকল দায়- দায়িত্ব যেন তাঁর মাথায়। পড়ালেখার জীবন শেষ করে যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশায়। তিনি ১৯৮৩ ইং সনের ১০ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার দি বাডস কেজি স্কুলে সামান্য বেতনে চাকুরি নেন। শুরু হলো রাতদিন খাটার পালা। কখনো মাটি কাটা, কখনোও গাছ লাগানো, কখনো ডনেশন আনা। প্রতি বৎসরই ভালো ফলাফল হচ্ছে। দ্রুত বিদ্যালয়টি প্রাইমারী অনুমোদন পেল। দুই বৎসরের মধ্যে জুনিয়র হাইস্কুল, পরে হাইস্কুল। অত:পর কলেজ হিসাবে অনুমোদন পায়। অত:পর অনেক চেষ্টার পর ১৯৮৬ ইং অত্র প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীবৃন্দ সরকারী অনুদানের আওতায় আসেন। যা বর্তমানে দি বাডস্ রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ। এভাবে কেটে গেল ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবন। অবশেষে ২০২২ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে চলে যান।
কর্মদক্ষতা : মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ দি বাডস্ রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে চাকুরি নেয়ার পর ১৯৯১- ১৯৯৩ ইং পর্যন্ত শিক্ষাকালীন ছুটি নিয়ে সৌদিআরবস্থ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সউদ ইউনিভার্সিটিতে আরবী ভাষা বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন এবং দেশে ফিরে এসে প্রতিষ্ঠানে পুনরায় যোগদান করেন। অত:পর ২০১২ ইং সনে কুমিল্লা সরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড সমমান এসটিসি কোর্স সম্পন্ন করেন। এছাড়া চাকুরীকালীন সময়ে মাস্টার ট্রেইনারসহ আরো অনেক বুনিয়াদি ট্রেনিং সম্পন্ন করেন।
পুরস্কার : গুণী শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ মেধাবী শিক্ষক হিসেবে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। সফলতার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮৮ ইং সনে মেধা প্রকল্প মৌলভীবাজার কর্তৃক শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষক হিসাবে পুরস্কৃত হন। ১৯৯২ ইং সনে সৌদি আরব ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন শিক্ষার জন্য চ্যান্সেলর পুরস্কার পান।
শিক্ষা জীবনের স্মরণীয় ঘটনা : মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ তাঁর ছাত্র জীবনের নানান মজার ঘটনা স্মৃতি চারন করেন। তিনি সিলেট মদন মোহন কলেজে পড়ার সময় জনাব আফাজ উদ্দিন (অধ্যাপক ইংরেজী) স্যার তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন। আপনি বলে সম্বোধন করতেন। তিনি আপত্তি করলেও শুনতেন না। বাসায় গেলে না খাইয়ে ছাড়তেন না। ১৯৮২ ইং সনে এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি চলে যান। পরীক্ষার প্রস্তুতি খুব কমই ছিল। পাশ করবেন বলে ধারণা ছিল না। ফলাফল প্রকাশ হল। মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ কোন খবর পাননি। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব উন্নত ছিল না। তবুও স্যার অনেক কষ্ট করে তাঁকে জানাতে সক্ষম হলেন। আব্দুল হামিদ যেন স্যারের সাথে দেখা করেন। অত:পর বাড়ি থেকে সিলেট যান। কলেজে গিয়ে জানলেন তিনি পাশ করেছেন ।
শুনে ২ কেজি মিষ্টি নিয়ে স্যারের বাসায় যান। স্যার বের হলেন, তাঁর হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সোজা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে কলেজে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় ম্যাডামকে কী যেন বলে গেলেন। তিনি লজ্জায় বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম বেরিয়ে এসে তাঁকে হাত ধরে টেনে ঘরে নিলেন এবং বলতে থাকেন আপনি কেমন ছাত্র ? আপনার স্যারকে চিনেন না ? স্যারের মন বুঝেন না ? ঘরে নিয়ে হাতে একটা টাওয়াল ধরি দিয়ে বললেন, যান বাথরুমে যান ফ্রেশ হয়ে আসেন । তিনি ম্যাডামকে সন্তুষ্ট করতে তাই করলেন। ডাইনিং রুমে এসে দেখেন ম্যাডাম খাবার রেডি করে অপেক্ষমান। টান দিয়ে তাঁকে বসালেন, বললেন স্যারের কথা ধরতে নেই। স্যার আপনাকে ছেলের মত দেখেন, না খাইলে আরো কষ্ট পাবেন। কী করবেন ? খাওয়া দাওয়া করলেন এবং যাওয়ার সময় কলেজে গিয়ে স্যারের সাথে দেখা করলেন। সালাম দিলেন। স্যার মাথায় হাত রেখে বললেন, শিক্ষা যেন হয়। এমনটি আর করবেন না। আব্দুল হামিদ শুনেছেন স্যার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। পরবর্তী কিছু জানেন না। তিনি শিক্ষকতা জীবনে এই কৃতি শিক্ষককে ফলো করেন।
১৯৯২ এর কথা। যখন ইবনে সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তখন একদিন সুযোগ্য শিক্ষক ডক্টরেট আবু তাম্মাম একদিন ক্লাস নিতে এলেন। সবাই যুক্তি করলেন। আজ পড়বেন না। নানা কথা জুড়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত স্যার বললেন, তোমরা তো বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী। বেশ ঠিক আছে। তোমরা তোমাদের দেশের এক একটা মজার গল্প বলো। স্যার, পর পর কয়েকজনকে আহ্বান করলেন, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। অবশেষে আব্দুল হামিদের কাছে এসে বললেন, ‘ইয়া আব্দাল হামিদ ‘জানানতু ইন্নাকা তাসতাতিয়ূ আন তুবায়্যিনা কিসসাতান বিলাদিয়া বিলাগাতিল আরাবিয়া।’ কী করবেন? দাঁড়ালেন। কিছু মনে পড়ছে না, আরবীতে বলতে হবে আবার মজাদারও হতে হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্য কামনা করে ছোট বেলার একটি গল্প মনে পড়ে গেল। ভাবলেন যাক বাবা ঐটাই বলে দিব।
গল্পের নাম ছিল ‘ইনশাআল্লাহু তায়ালা’। এক লোক ছিল, তার অভ্যাস ছিল রাস্তায় হাঁটা। সে হাঁটতো আর আচানক কোন লোক পেলে জিজ্ঞেস করতো- ‘ইলা আইনা’। তুমি কোথায় যাচ্ছো ? অথবা মিন আইনা ? তুমি কোথা থেকে আসছ ? ইত্যাদি। এভাবে একদিন একজন লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। তো ঐ লোকটির সাথে দেখা হল। লোকটি জিজ্ঞেস করলো ইলা আইনা ? তুমি কোথায় যাচ্ছ ? লোকটি বললো, বাজারে যাচ্ছি। লিমাযা-কী জন্য যাচ্ছ ? লোকটি বললো গাধা কিনতে। ঐ লোকটি বলল তোমার বলা উচিত ছিল, বাজারে যাচ্ছি ইনশা আল্লাহ তায়ালা। গাধা কিনতে, ইনশা আল্লাহ তায়ালা। লোকটি বললো এভাবে বলতে হবে কেন ? টাকা আমার পকেটে আছে। আর গাধা বাজারে আছে। ইনশা আল্লাহ বলতে হবে কেন ? যাক লোকটি বাজারে গেল এবং একটি গাধা দরদাম করে ক্রয় করল। কিন্তু পকেটে হাত দিয়ে দেখে পকেটে টাকা নেই। গাধা ক্রয় করতে পারল না। বিক্রেতার নিকট ক্ষমা চেয়ে বাড়ির দিকে ফেরত রওনা দিল। দৈবাত ঐ লোকটির সাথে দেখা হল। লোকটি জিজ্ঞেস করল, মিন আইনা ? কোথা থেকে আসছ ? লোকটি এবার বল, মিনাসসোউকি ইনশা আল্লাহ তায়ালা। কেন গিয়েছিলেন-লোকটি বললো ‘লিআসতারিয়া হিমারান ইনশা আল্লাহ তায়ালা’। গাধা কিনলেন না কেন ? উত্তরে লোকটি বললো, ‘ছুরিকাত দারাহিমা ইনশা আল্লাহ তায়ালা-আমার টাকা চুরি হয়ে গেছে ইনশা আল্লাহ তায়ালা’। এই গল্পটি শুনে সকল আরবী ভাষাভাষি ছাত্র প্রচন্ড হাসতে হাসতে গল্পটি উপভোগ করছিল। কিন্তু ইংরেজী ভাষাভাষী শিক্ষার্থীরা ভাল বুঝতে না পারায় তারা মজা উপভোগ থেকে বঞ্চিত হলো।
এবার ইংরেজী ভাষার শিক্ষার্থীরা স্যার ডক্টর আবু তাম্মামকে বললো স্যার এভাবে হয় না। কেউ মজা উপভোগ করবে আবার কেউ বঞ্চিত হবে। স্যার আবার সকল শিক্ষার্থীর উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের মধ্যে যে এই গল্পটি ইংরেজী বলতে পারবে, সে এখানে আস। কেউ এল না, এবারও স্যার আব্দুল হামিদের পা’তে পাঁ দিয়ে চাপ দিয়ে বললেন, “ইয়া আবদাল হামিদ জানানতু ইন্নাকা তাসতাতিউ আন তুবায়্যিনা হাযিহিল কিসসা বিলাগাতিল আংরেজীয়া”।
কী করবেন। ভাল জ্ঞান না থাকা সত্তেও তাঁকে এই গল্পটি আবার ইংরেজীতে বলতে হল। এবার ইংরেজী ভাষার শিক্ষার্থীরা প্রাণ খুলে হাসলো এবং উপভোগ করলো। এ সময় আরবী ভাষার শিক্ষার্থীরা নিশ্চুপ ছিল। এ দৃশ্যটি সিসি ক্যামেরার মধ্যে চ্যান্সেলর মহোদয়ের গোচরিতভূত হয়। এজন্য তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়। যেদিন পুরস্কার দেওয়া হয়। সেদিন বারবার আব্দুল হামিদের নাম ঘোষণা করলেও তিনি পুরস্কার গ্রহণ করতে যাননি। কারণ তিনি তো জানেন না যে পুরস্কার পাচ্ছেন। স্যার এসে বলায় শেষে তিনি তা গ্রহণ করেন।
শিক্ষকতা জীবনের স্মরণীয় ঘটনা : মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমানভাবে কর্মতৎপর, দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠাবান। দি বাডস্ রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে যারা অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন সকল কর্ম পরিচালনায় আব্দুল হামিদকে সাথে রাখতেন। একবার সম্ভবত ১৯৮৬ ইংরেজীর দিকে একজন নতুন অধ্যক্ষ আসলেন জনাব কাজী আজিজুর রহমান। তিনি কাজী নজরুল কলেজের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি এসে তার মত করে কর্মপরিচালনা করছেন। একবার কলেজের একটা নিউজ লেটার (ইংরেজী) বানালেন। ছাপা হয়ে নিউজ লেটারের বান্ডেল তার সামনে। হঠাৎ আব্দুল হামিদ কেন জানি তাঁর চেম্বারে ঢুকলেন। আব্দুল হামিদকে বললেন, “দেখেন তো ভাইয়া কেমন হলো”। হঠাৎ তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ভুলে ভরা এটা কী দেখবো। অথচ এব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। স্যার রেগে গিয়ে বললেন, কোথায় ভুল বের করেন তো। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ইংরেজী ভালো জানেন না, এখন কী করবেন। একটি হাতে নিলেন। ভয়ে শরীর কাঁপছিল। আল্লাহকে ডেকে ডেকে দেখতে লাগলেন….হঠাৎ মনে হলো একটা বানান ভুল। সাহস বাড়লো…এভাবে দেখতে দেখতে পাঁচটি ভুল বের হল। মনে হলো এ ভুলগুলি যদি সঠিক হয় না। নিয়ে গেলেন সুদক্ষ ইংরেজী শিক্ষক মি. প্রীতি রঞ্জন চক্রবর্তী স্যারের কাছে। সব বললেন, তিনি দেখে বললেন আপনার কাটা ঠিক আছে। তিনি আরো দুইটি যোগ করলেন এবার সাতটি হলো। নিয়ে আসলেন অধ্যক্ষ মহোদয়ের কাছে। তিনি দেখলেন এবং আব্দুল হামিদকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘Thank you’ ভাইয়া। ভীষন লজ্জা থেকে আল্লাহ রক্ষা করলেন। যা আজও মনে পড়ে আব্দুল হামিদের।
শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরা : দি বাডস রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা জীবন। ১৯৯২ ইং সনে আব্দুল হামিদের এক খালাতো ভাই দৈনিক সংগ্রামের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি বর্তমানে লন্ডনে থাকেন। তিনি তাঁকে কাগজপত্র পাঠাতে বললেন। তিনি তাঁর জন্য ভাল ব্যবস্থা করেছেন। তিনি সৈয়দ রুহুল আমীন। আব্দুল হামিদ তা গ্রহণ করেননি। কিং আব্দুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে চাকুরির অফার পেয়েও গ্রহণ করেননি। সৌদি আরবে থাকাকালীন ১৯৯২ ইং সনে কানাডার ভিসার গ্রহণের আমন্ত্রণ পান, তাও গ্রহণ করেননি। এছাড়া সিডোতে বড় অফার পান সে সুযোগও নেননি। পড়ে থাকেন এই বিদ্যালয়টি গড়ার কাজে। বিদ্যালয়টি গড়ে উঠেছে। অনেক বার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়েছে। দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার পেয়েছে। কিন্তু পিছনের কারিগররা সেরা হতে পারেননি কিংবা পারবেনও না।
মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ জীবনের সব শখ, স্বপ্ন, যোগ্যতা, দক্ষতা কর্মজীবনেই ব্যয় করেছেন। সবাই বলে এত ভাল সুযোগ সুবিধা ছেড়ে শূন্যতাকে কেন আঁকড়ে ধরলেন। এর উত্তর তাঁর জানা নেই। সহধর্মিনী, ছেলে-মেয়েরা তাঁকে আজো প্রশ্নবানে জর্জরিত করে এত সুযোগ পেয়েও আপনি কেন শূন্যতাকে বরন করলেন? ছেলে মেয়েরা মাধ্যমিক পাড়ি দিতে পারে নি। কিন্তু তিনি অবসরে।
কবি জীবনানন্দ দাসের কথায়- সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায়, এ জীবনের সব লেন- দেন, থাকি শুধু অন্ধকার-মুখোমুখী বসিবার বনলতা সেন।
জাতি গড়ার কারিগররা অবহেলিত : জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকদের সর্বক্ষেত্রে মর্যাদা এবং মূল্যায়ন করা জরুরি। শিক্ষকদের মূল্যায়ন ছাড়া সুশিক্ষিত সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব নয়। শিক্ষক সমাজ হচ্ছেন প্রকৃত সমাজ ও সভ্যতার বিবেক। কিন্তু বর্তমানে বেসরকারী শিক্ষকদের জীবনে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা। বেসরকারি শিক্ষকগণ এক রকম ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ বেসরকারী শিক্ষকদের দু:খ দুর্দশার কথা তুলে ধরে বলেন- বাংলাদেশের বেসরকারী শিক্ষকরা কত অবহেলিত। এমতাবস্থায় অবসরে গেলেও কিছু খয়রাতি অবসর ভাতা। তাও জীবদ্দশায় অনেকেই পান না। অবসরের শূন্যতা ও বার্ধক্যজনিত অসুকে বিনা চিকিৎসায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয় অনেককেই। শিক্ষকরা সুযোগ্য নাগরিক গড়ে তুলেন, কর্মকর্তা গড়ে তোলেন। কারো কাছে কোন দিন কোন রিওয়ার্ড চান না। কখনও কোন ছাত্রের যদি মনে পড়ে এবং বলে হ্যালো স্যার কেমন আছেন? এতেই খুশী হন, শান্তি পান, পেট ভরে যায়, কষ্ট দূর হয়।
মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে লিখা একটি কবিতার শেষ কয়টি পংক্তি :
তবুও আমি সুখের নিদ্রায় শায়িত, আমার দৈন্যতায় আমি তৃপ্ত। আমি জেদী, মহা বিভৎস। পুড়িয়ে ফেলেছি কামনার সকল উৎস। আমি রিক্ত তবু বলব-প্রাচুর্য্যকে আমি করেছি জয়। নিজ হাতে, স্বানন্দে শূন্যতাকে করেছি বরণ। তাই আজও দাঁড়িয়ে আছি পুস্পহীন জীবনে।
স্মরণীয় ঘটনা : মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা বিদায়ের দিন। তিনি ধারনা করতে পারেননি যে, তাঁর সহকর্মী, কলেজের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ এতো ভালবাসেন। তাদের স্মৃতি চারনমূলক বক্তব্যে তাঁকে অনেক কাঁদিয়েছে। সকলের চোখের পানি সিক্ত করেছে। অনেক সহকর্মীকে দেখেছেন স্বজন হারা কান্নার মত বুক ভাসিয়েছেন। স্যারকেও কাঁদিয়েছেন। আগামী দিনেও কাঁদাবেন। এর চেয়ে স্মরণীয় ঘটনা কি হতে পারে। অধ্যক্ষ জনাব জাহাঙ্গীর আলম স্যারের উঁচু মানের মূল্যায়ন, সহকর্মীদের উঁচু মানের মুল্যায়ন, সর্বোপরি গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট মহোদয়ের উঁচু মানের মুল্যায়ন, পুরাতন ছাত্রদের মন ছোঁয়া মূল্যায়ন যা বাকী জীবন তাঁকে কাঁদাবে।
পারিবারিক : শ্রীমঙ্গল উপজেলার একজন শিক্ষাগুরু হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ে সামিয়া জান্নাত (বড়) ২০২২ সনের এইচএসসি বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী এবং ছেলে খালিদ মোহাম্মদ মাহদি (ছোট) ২০২২ সালের এসএসসি বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষার্থী। উভয়ই দি বাডস রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শ্রীমঙ্গল উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে যাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে পড়িয়েছেন, তারা অনেকেই আজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্তব্যরত এবং অনেকে সমাজে অনেক সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর সতীর্থরা অনেকেই বড় মাপের অনেক ভালো অবস্থানেই আছেন। অথচ জীবনের ৪০ বছর শিক্ষকতায় পার করা মহান এই মানুষটি জীবন ও জীবিকা অতিবাহিত করতে হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। কিন্তু তাঁর কোন আফসোস নেই। শিক্ষকতায় মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। এটাই বা কম কী? কজন পায় এত মানুষের ভালোবাসা? মানুষের ভালোবাসা বড় প্রাপ্তি। যা পেয়েছেন তাতে তিনি খুশি। আচরণের সারল্য আর সাদাসিধা জীবনের অধিকারী মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের ব্যক্তিগত আর পারিবারিক জীবনের ইতিহাসও ছিল অনেক বর্ণাঢ্য। শুভ হোক আপনার প্রতিটি সময়। বাস্তবে পরিণত হোক আপনার সব স্বপ্নগুলো।এমন একজন গুণী প্রবীণ শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।