ঢাকা ০৩:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজমিস্ত্রির কর্মী থেকে সফল শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুর রব 

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০১:৪১:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ নভেম্বর ২০২৩
  • / ৭৯৯ বার পড়া হয়েছে

ফয়সল আহমদ রুহেল :: শৈশবে রাজমিস্ত্রির কর্মী ছিলেন। ১৯৬৫ সালে বিয়ানীবাজারের উত্তর বাজারে কাজ করেন রাজমিস্ত্রির কর্মী হিসেবে। এসএসসি পাশ করার পর বিমান বাহিনী চাকরি পান। সরকারী চাকরি শেষে শিক্ষকতা পেশায় চলে যান। যে শিক্ষকের প্রত্যয়ন পত্র দ্বারা শিক্ষার সূচনা। সেই শিক্ষক একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অবসরে যান। তিনি ওই বিদ্যালয়ের-ই প্রধান শিক্ষক হন। সফলতা এক সোনার হরিণের নাম। এই সোনার হরিণ ধরতে কতোনা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি তিলে তিলে নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। এই সফল ও গুনী শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুর রব সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (অব.)।

জন্ম : তিনি ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানাধীন ১১নং লাউতা ইউনিয়নের কালাইউরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. ফরমুজ আলী ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। মাতা ছুরতুন নেছা, গৃহিনী। তিন ভাই ও এক বোন এর মধ্যে মোহাম্মদ আব্দুর রব দ্বিতীয়।

শৈশব : তিনি ১৯৫৯ ইংরেজিতে কালাইউরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করলেও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আরো এক বছর পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশুনা করেন।  কিন্তু দুর্ভাগ্য বিদ্যালয়ে তিনি একমাত্র বৃত্তি পরীক্ষার্থী হওয়ায় ও পরীক্ষা কেন্দ্র প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে সিলেট শহরে থাকা, তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থিক কারণে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। তখনকার সময় ঐ অঞ্চলে মাদ্রাসা ভিত্তিক জলছা

( ধর্মীয় আলোচনা সভা ) দৌলতপুর, সুজাউল ,কোনাগ্রাম, চন্দগ্রাম ইত্যাদি স্থানে অনুষ্ঠিত হত। তিনি ঐ সমস্ত স্থানে আগ্রহ নিয়ে যেতেন এবং বিখ্যাত আলেম গণের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। এই ইচ্ছা থেকেই পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর মাদ্রাসায় পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পিতা তাকে পাশের গ্রাম দৌলতপুর মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। বছরখানেক যেতে না যেতে মাদ্রাসার হুজুর ও গ্রামবাসী মুরব্বিয়ানদের মধ্যে কি যে ঘটলো তিন বুঝতে পারেননি। তবে মাদ্রাসা থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অন্যান্য মাদ্রাসায় চলে গেল। শিক্ষার্থী শূন্য মাদ্রাসায় যেতে ভাল লাগতো না। অন্যান্য শিক্ষার্থীর মতো তিনিও কিছুটা দূরবর্তী সুজাউল মাদ্রাসায় যাতায়াত করে বুঝতে পারলেন এখানেও হুজুর ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলাদলি আছে। কাজেই সেখানে যাওয়াও বন্ধ করে দেন। সারাদিন কাজ কর্ম নেই। বন্ধু বান্ধবরা স্কুলে পড়ে, যারা পড়া ছেড়ে দিয়েছে তারা মাঠে কৃষি কাজে ব্যস্ত। বিকেল বেলা যখন বন্ধু বান্ধবরা মাঠে খেলতে আসে তখনই কিছুটা স্বস্থিবোধ হয়। পাঁচ/ছয় মাস এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর পার্শ্বের পকুয়া গ্রামের ছখাওয়াত আলী। যিনি ঐ সময় বিয়ানীবাজার থানার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত দেউলগ্রাম মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতেন। তাদের বাড়িতে এসে তিনি তাঁর আব্বাকে বললেন, আব্দুর রবকে দেউলগ্রাম মাদ্রাসায় ভর্তি করাবেন। তাকে বাড়ি থেকে ৭/৮ মাইল দূরে দেউলগ্রাম মাদ্রাসায় ভর্তি করা হল এবং একই সাথে ঐ গ্রামের একটি বাড়িতে থাকারও জায়গা হল। নূতন জায়গায় নূতন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে পড়াশুনার মনোযোগী হলেন। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের খেলাধূলা করা নিষিদ্ধ থাকায় খুবই খারাপ লাগতো। ৭/৮ মাস যেতে না যেতে এখানেও বিবাদের সূত্রপাত হলো এবং কিছু দিনের মধ্যে দুইটি মাদ্রাসার সৃষ্টি হয়। একটি পুরাতন মাদ্রাসা দেউলগ্রাম, অন্যটি পাশের গ্রামে আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর মাদ্রাসা। শিক্ষার্থীরাও নিজ নিজ পছন্দ মত মাদ্রাসায় চলে গেল। তিনি শিক্ষা গ্রহণের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। তাঁর পিতা বললেন, পড়াশুনা যখন করবেই না তখন কাজ কর্ম করার চেষ্টা কর।
আব্দুর রবের ফুফাত ভাই বশির উদ্দিন ও তাঁর বন্ধু জমির হোসেন এর সাথে রাজমিস্ত্রির কর্মী হিসেবে যোগ দিলেন। তবে একটি শর্ত দিলেন যে, তাঁরা যত ভোরে বলবেন তিনি কাজে যাবেন তবে বিকেলে তাঁকে ফুটবল খেলার সুযোগ দিতে হবে। তারা ঐ শর্তে রাজী হওয়ায় তিনি উৎসাহের সাথে কাজ করতে লাগলেন। ১৯৬৫ ইংরেজির মাঝামাঝি সময়ে বিয়ানীবাজারের প্রথম দোতলা দালান উত্তর বাজারের ‘আলী ফার্মেসি’ এর দ্বিতীয় তলার কাজ করছেন। একদিন দুপুরের সময় রাজমিস্ত্রি জমির হোসেন অন্য শ্রমিককে বললেন বালু ও সিমেন্ট মিশাতে। ঐদিন বিকালে আব্দুর রব একটি ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনেল খেলা খেলতে যাবেন। বালু ও সিমেন্টের পরিমাণ দেখে তিনি বললেন, চাচা- আমি তো কিছুক্ষণ পর চলে যাব। আপনারা এত বালু সিমেন্টের কাজ করতে পারবেন না। তারা বললেন, পারব। ঠিক সময় মত তিনি চলে যেতে চাইলে তারা বললেন, আমরা তো বেশি মাল তৈরি করে ফেলেছি। আজ খেলতে যাওয়া যাবে না। তিনি রাগ করে বললেন আমি আর আপনাদের সাথে কাজ করব না। এই কথা বলে তিনি চলে আসেন। তিনি সব সময় সিদ্ধান্তে অটল থাকেন বিধায় এই ঘটনা বাড়ির সবাই জানার পর কেউই কিছু বলেননি। কিন্তু সবাই তার উপর অসন্তোষ্ট। কেবলমাত্র বড় ভাই যিনি সিলেট এমসি কলেজে পড়তেন মো. আব্দুস শহীদ তাঁকে বললেন, এই সব কিছু বাদ দিয়ে স্কুলের পড়া আরম্ভ কর। কিন্তু এরই মধ্যে জীবনের পাঁচটি বছর চলে গেছে। বড় ভাই আব্দুস শহীদ তাঁকে গ্রামের মো. মনির উদ্দিন, বিকম স্যারের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘চাচা আমার ছোট ভাই স্কুলে পড়তে চায়। আপনি ওকে পরীক্ষা করে দেখেন তো ওই কোন ক্লাসে পড়তে পারবে। স্যার আব্দুর রবকে বাংলা, ইংরেজী, গণিত ও আনুষাঙ্গিক আরো কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বললেন যে, ও যদি দুই/তিন মাস আমার কাছে বীজগণিত ও ইংরেজী পড়ে তবে অষ্টম শ্রেণীতে পড়তে পারবে। আমি তাকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত আমার কাছে পড়েছে বলে একটি প্রত্যয়নপত্র দেব যার মাধ্যমে সে যে কোন উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারবে। ইহা শুনে আব্দুর রব নিজে কিছুটা স্বস্তি পেলেন যে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছোট ছোট শিক্ষার্থীর সাথে পড়তে হবে না। স্যারের প্রত্যয়নপত্র দ্বারা ১৯৬৬ ইংরেজীর ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে তিনি জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি ওই বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য সিলেট এমসি কলেজে আবেদন করেন। ইংরেজী ও গণিত বিষয়ে ভাল নম্বর থাকায় এবং ভাল ফুটবল প্লেয়ার হওয়ার জন্য এমসি কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। ছাত্রাবাসে থাকারও সুযোগ পান। ফিস এর টাকার জন্য বাড়ি যাওয়ার সময় স্থানীয় নবপ্রতিষ্ঠিত বিয়ানীবাজার কলেজে ভর্তি হওয়া আব্দুর রবের সতীর্থরা এক রকম জোর করে তাকে বিয়ানীবাজার কলেজে নিয়ে বিনা পয়সায় ভর্তি করিয়ে দেন। তিনি বিয়ানীবাজার কলেজের ১৯৬৯ সালের শিক্ষার্থী হন।

শিক্ষা জীবন : শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ আব্দুর রব এর শিক্ষা জীবন খুবই বিচিত্র। ১৯৫৫ ইংরেজিতে কালাই উরা (সি পি) বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৯ ইংরেজিতে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেন। তিনি ১৯৬৯ ইংরেজি জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয় হতে কুমিল্লা বোর্ড থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৪ ইংরেজিতে ঢাকা বোর্ডের অধীনে সরকারী তিতুমীর কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে এইচএসসি তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন।  ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত শিক্ষার্থী হিসাবে বিএ পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। ১৯৯৭-৯৮ সেশনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন।

শিক্ষকতা জীবন : বিমান বাহিনীর চাকুরীর শেষ দিকে কেবলই তাঁর মনে হতো-বিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতে ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখতে হতো। তিনি লিখতেন ‘আমি একজন শিক্ষক হব।’ আর চাকুরী জুটলো সামরিক বাহিনীতে। বিমান বাহিনীর চাকুরীর মেয়াদ শেষ হলে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার নব প্রতিষ্ঠিত হাজী ইউনুছ মিয়া মেমোরিয়েল উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৮৯ ইংরেজির আগষ্ট মাসে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৯৪ ইংরেজির অক্টোবর মাসে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। এরপর বিয়ানীবাজারের প্রাচীনতম উচ্চ বিদ্যালয় ‘পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ হাইস্কুল’ এ সরকারী প্রধান শিক্ষক এর শূন্য পদে আবেদন করে উক্ত পদে ১৯৯৯ সালের ১ আগষ্ট নিয়োগ লাভ করেন। ২০০৭ ইংরেজির শেষার্ধে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কারণ ২০০৪ সাল থেকে সরকারী পরিপত্র মোতাবেক সকল প্রকার শিক্ষক নিয়োগ বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে শিক্ষক নিয়োগের জটিলতা নিরসন হলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারে সরকারী নীতি না মেনে কমিটির সদস্যদের নিজেদের অযাচিত শর্ত আরোপের ফলে তাঁর সাথে বিরোধের সৃষ্টি হয়। তাদের এ অন্যায় মেনে না নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। এই সময় উপজেলার ‘মাথিউরা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়’ এর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যবর্গের অনুরোধে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর যোগদান করেন।  ২০১২ সালে পি এইচ জি হাইস্কুলের নব গঠিত কমিটি কর্তৃক প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার হলে তিনি আবেদন করেন এবং পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী হিসাবে ২০১২ সালের ১৫ জুলাই প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ২০১৩ ইংরেজির শেষ দিকে বয়স ষাট বছর পূর্ণ হওয়ায় সরকারী বিধি মোতাবেক অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পর নব প্রতিষ্ঠিত নিদনপুর সুপাতলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তির অনুরোধে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অদ্যবধি উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এর দায়িত্ব পালন করছেন।

বিমান বাহিনীতে চাকরি : তিনি  ১৯৬৬ ইং জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি করার পর বড় ভাই আব্দুস শহীদ ঐ বছর পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকুরি পেয়ে যান। ১৯৭০ সালে জানুয়ারি মাসে ছুটিতে বাড়ি আসেন। কি যেন একটি কাজে ঢাকা শহরে যাবেন শুনে আব্দুর রবও তাঁর সাথে ঢাকা যাওয়ার বায়না ধরেন। তিনি তাকে সঙ্গে নিলেন। ট্রেনে ঢাকা গেলেন এবং নবাবপুর রোডের একটি হোটেলে রাত্রিযাপন করেন। ভোরে উঠে বড় ভাই যেন কোথায় চলে গেলেন। তিনি হোটেল থেকে বের হয়ে নাস্তা করে ঢাকা শহর দেখার জন্য এদিক সেদিক হাঁটতে থাকেন। কিছু দূর গিয়ে দেখেন তাঁর বয়সী অনেক লোকজন একটি ছোট মাঠের মধ্যে একত্রিত হয়েছে। কাছে গিয়ে জানতে পারলেন যে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে লোক নেয়া হচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি দ্বিতীয় বিভাগ। তিনিও তাদের সাথে যোগ দিলেন। যথাসময়ে বিমান বাহিনীর পোষাক পরিহিত ৩/৪ জন লোক এসে তাদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে শারীরিক উচ্চতা দেখে সবাইকে দুই ভাগে ভাগ করে কম উচ্চতাভূক্ত লোকদের চলে যেতে বলেন। অপর সবাইকে আলাদা চেয়ার টেবিলে বসিয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়। তিন গ্রুপে মোট ১৫০ জন পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার ঘন্টাখানেক পরে ফলাফল ঘোষণায় দেখা যায় তিনিসহ তেরজন পাশ করেছেন। পরে ঐ দিনই মেডিকেল পরীক্ষায় সাতজন নির্বাচতি হলে নাম ঠিকানা লিখে রেখে তারা বিমান বাহিনীতে চাকুরি পেয়ে গেছে বলে জানানো হয়। হোটেলে এসে বড় ভাইজানকে সবকিছু বলে তাঁর রোল নং সম্বলিত কাগজ দেখালে তিনি বললেন যে, সত্যিই চাকুরী হয়ে গেছে। ১৯৭০ ইংরেজির জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে on pakistan state service লিখা একটি খাম পেলেন। যাতে লিখা ছিল ১৫ই জুন ঢাকায় যেখানে পরীক্ষা দিয়েছিলেন সেখানে গিয়ে যেন চাকুরীতে যোগদান করেন। পরিচিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে ঢাকায় যোগদান এবং ট্রেনিং এর জন্য তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা শহরে চলে যান।
প্রাথমিক পর্যায়ের ২৪ সপ্তাহ ট্রেনিং শেষে পেশাগত ট্রেনিংয়ের জন্য ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধে করাচী যান। মাস দুয়েক পর মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়। তাদের ট্রেনিং কিন্তু চলতে থাকে। ৩৬ সপ্তাহের ট্রেনিং শেষে ১৯৭১ ইংরেজীর অক্টোবর মাসে রিসালপুর গেলে বিমান বাহিনীর পুরাতন সদস্যদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর তখনই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ অবস্থার কথা বুঝতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের কারণে পাকিস্তানী সদস্যরা বাঙালীদের সন্দেহ করতে থাকে। তাদের মধ্যে চালচলন ও আচার ব্যবহারে পার্থক্য বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বাঙালী সদস্যদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ ইংরেজির ১৬ইং ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় সকল বাঙালী সদস্যকে আলাদা ক্যাম্পে নেয়া হয় এবং বন্দীলোকদের মতো রাখা হয়। প্রায় দুই বছর পর রেডক্রস এর মাধ্যমে ১৯৭৩ ইংরেজির অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন।

তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফুটবল টিমের নিয়মিত খেলোয়াড় হওয়ায় প্রায় সারা বছরই খেলাধূলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন অন্য কোন দিকে নজর দেওয়ার সময় ছিল না। চাকুরি মেয়াদ ছিল আটারো বছর অর্থাৎ ১৯৮৮ ইংরেজির জুন মাস পর্যন্ত। চাকুরীর মেয়াদ শেষ হলে অবসর গ্রহণ করে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন।

দায়িত্ব পালন : তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর পরিচালনা কমিটির সদস্য, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সমূহের কার্যাবলী নির্ধারক, বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন সাংগঠনিক কমিটির সেক্রেটারী ও বর্তমান গভর্নিং বডির সদস্য, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজি বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক, এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র সচিব, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বিয়ানীবাজার উপজেলা শাখার সেক্রেটারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

পারিবারিক : তিনি পারিবারিক জীবনে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। বড় ছেলে মো. শরীফুল ইসলাম রবিন বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ( সম্মান ) সম্পন্ন করে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে গিয়ে এমবিএ পড়ে লন্ডন শহরে বসবাস করছে। মেজো ও ছোট মেয়ে যথাক্রমে রোমেনা আক্তার রুমি ও সোহানা আক্তার রুনা বিএ পাশ করার পর বিবাহিত জীবনযাপন করছে।

এই সফল শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুর রব ন্যায় নীতির প্রতি ছিলেন নিষ্টাবান। বিমান বাহিনীতে চাকরী করেন। ফলে আরো দৃঢ়ভাবে ন্যায় নীতিতে অটল ছিলেন। এর ব্যতিক্রম কখনই সহ্য করেননি। অধিকাংশ লোক যদি কোন অন্যায় মেনে নেয় তিনি একমত না হয়ে বরং ওই পরিবেশ থেকে সরে আসেন। এই জীবনগুলো যেভাবে কেটেছে তাতে কোন নির্দিষ্ট ঘটনার গুরুত্ব ছিল না। এই শিক্ষকের জীবনে এক এক পরিস্থিতিতে একটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়। তিনি যে কাজই করেন না কেন আন্তরিকতার সাথে করেছেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুর রব এর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের মূল্যায়ন করবে শিক্ষার্থীরা এবং বাকী কাজগুলোর মূল্যায়ন করবে কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ জনগণ।গুনী এই শিক্ষকের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।

লেখক : ফয়সল আহমদ রুহেল , সাউথ ইষ্ট লন্ডন প্রতিনিধি, চ্যানেল এস টেলিভিশন।
ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

রাজমিস্ত্রির কর্মী থেকে সফল শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুর রব 

আপডেট সময় ০১:৪১:০০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১ নভেম্বর ২০২৩

ফয়সল আহমদ রুহেল :: শৈশবে রাজমিস্ত্রির কর্মী ছিলেন। ১৯৬৫ সালে বিয়ানীবাজারের উত্তর বাজারে কাজ করেন রাজমিস্ত্রির কর্মী হিসেবে। এসএসসি পাশ করার পর বিমান বাহিনী চাকরি পান। সরকারী চাকরি শেষে শিক্ষকতা পেশায় চলে যান। যে শিক্ষকের প্রত্যয়ন পত্র দ্বারা শিক্ষার সূচনা। সেই শিক্ষক একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অবসরে যান। তিনি ওই বিদ্যালয়ের-ই প্রধান শিক্ষক হন। সফলতা এক সোনার হরিণের নাম। এই সোনার হরিণ ধরতে কতোনা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি তিলে তিলে নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। এই সফল ও গুনী শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুর রব সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (অব.)।

জন্ম : তিনি ১৯৪৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানাধীন ১১নং লাউতা ইউনিয়নের কালাইউরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. ফরমুজ আলী ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। মাতা ছুরতুন নেছা, গৃহিনী। তিন ভাই ও এক বোন এর মধ্যে মোহাম্মদ আব্দুর রব দ্বিতীয়।

শৈশব : তিনি ১৯৫৯ ইংরেজিতে কালাইউরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করলেও প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আরো এক বছর পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশুনা করেন।  কিন্তু দুর্ভাগ্য বিদ্যালয়ে তিনি একমাত্র বৃত্তি পরীক্ষার্থী হওয়ায় ও পরীক্ষা কেন্দ্র প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে সিলেট শহরে থাকা, তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থিক কারণে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। তখনকার সময় ঐ অঞ্চলে মাদ্রাসা ভিত্তিক জলছা

( ধর্মীয় আলোচনা সভা ) দৌলতপুর, সুজাউল ,কোনাগ্রাম, চন্দগ্রাম ইত্যাদি স্থানে অনুষ্ঠিত হত। তিনি ঐ সমস্ত স্থানে আগ্রহ নিয়ে যেতেন এবং বিখ্যাত আলেম গণের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। এই ইচ্ছা থেকেই পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর মাদ্রাসায় পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পিতা তাকে পাশের গ্রাম দৌলতপুর মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। বছরখানেক যেতে না যেতে মাদ্রাসার হুজুর ও গ্রামবাসী মুরব্বিয়ানদের মধ্যে কি যে ঘটলো তিন বুঝতে পারেননি। তবে মাদ্রাসা থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অন্যান্য মাদ্রাসায় চলে গেল। শিক্ষার্থী শূন্য মাদ্রাসায় যেতে ভাল লাগতো না। অন্যান্য শিক্ষার্থীর মতো তিনিও কিছুটা দূরবর্তী সুজাউল মাদ্রাসায় যাতায়াত করে বুঝতে পারলেন এখানেও হুজুর ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলাদলি আছে। কাজেই সেখানে যাওয়াও বন্ধ করে দেন। সারাদিন কাজ কর্ম নেই। বন্ধু বান্ধবরা স্কুলে পড়ে, যারা পড়া ছেড়ে দিয়েছে তারা মাঠে কৃষি কাজে ব্যস্ত। বিকেল বেলা যখন বন্ধু বান্ধবরা মাঠে খেলতে আসে তখনই কিছুটা স্বস্থিবোধ হয়। পাঁচ/ছয় মাস এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর পার্শ্বের পকুয়া গ্রামের ছখাওয়াত আলী। যিনি ঐ সময় বিয়ানীবাজার থানার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত দেউলগ্রাম মাদ্রাসায় পড়াশুনা করতেন। তাদের বাড়িতে এসে তিনি তাঁর আব্বাকে বললেন, আব্দুর রবকে দেউলগ্রাম মাদ্রাসায় ভর্তি করাবেন। তাকে বাড়ি থেকে ৭/৮ মাইল দূরে দেউলগ্রাম মাদ্রাসায় ভর্তি করা হল এবং একই সাথে ঐ গ্রামের একটি বাড়িতে থাকারও জায়গা হল। নূতন জায়গায় নূতন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে পড়াশুনার মনোযোগী হলেন। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের খেলাধূলা করা নিষিদ্ধ থাকায় খুবই খারাপ লাগতো। ৭/৮ মাস যেতে না যেতে এখানেও বিবাদের সূত্রপাত হলো এবং কিছু দিনের মধ্যে দুইটি মাদ্রাসার সৃষ্টি হয়। একটি পুরাতন মাদ্রাসা দেউলগ্রাম, অন্যটি পাশের গ্রামে আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর মাদ্রাসা। শিক্ষার্থীরাও নিজ নিজ পছন্দ মত মাদ্রাসায় চলে গেল। তিনি শিক্ষা গ্রহণের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। তাঁর পিতা বললেন, পড়াশুনা যখন করবেই না তখন কাজ কর্ম করার চেষ্টা কর।
আব্দুর রবের ফুফাত ভাই বশির উদ্দিন ও তাঁর বন্ধু জমির হোসেন এর সাথে রাজমিস্ত্রির কর্মী হিসেবে যোগ দিলেন। তবে একটি শর্ত দিলেন যে, তাঁরা যত ভোরে বলবেন তিনি কাজে যাবেন তবে বিকেলে তাঁকে ফুটবল খেলার সুযোগ দিতে হবে। তারা ঐ শর্তে রাজী হওয়ায় তিনি উৎসাহের সাথে কাজ করতে লাগলেন। ১৯৬৫ ইংরেজির মাঝামাঝি সময়ে বিয়ানীবাজারের প্রথম দোতলা দালান উত্তর বাজারের ‘আলী ফার্মেসি’ এর দ্বিতীয় তলার কাজ করছেন। একদিন দুপুরের সময় রাজমিস্ত্রি জমির হোসেন অন্য শ্রমিককে বললেন বালু ও সিমেন্ট মিশাতে। ঐদিন বিকালে আব্দুর রব একটি ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনেল খেলা খেলতে যাবেন। বালু ও সিমেন্টের পরিমাণ দেখে তিনি বললেন, চাচা- আমি তো কিছুক্ষণ পর চলে যাব। আপনারা এত বালু সিমেন্টের কাজ করতে পারবেন না। তারা বললেন, পারব। ঠিক সময় মত তিনি চলে যেতে চাইলে তারা বললেন, আমরা তো বেশি মাল তৈরি করে ফেলেছি। আজ খেলতে যাওয়া যাবে না। তিনি রাগ করে বললেন আমি আর আপনাদের সাথে কাজ করব না। এই কথা বলে তিনি চলে আসেন। তিনি সব সময় সিদ্ধান্তে অটল থাকেন বিধায় এই ঘটনা বাড়ির সবাই জানার পর কেউই কিছু বলেননি। কিন্তু সবাই তার উপর অসন্তোষ্ট। কেবলমাত্র বড় ভাই যিনি সিলেট এমসি কলেজে পড়তেন মো. আব্দুস শহীদ তাঁকে বললেন, এই সব কিছু বাদ দিয়ে স্কুলের পড়া আরম্ভ কর। কিন্তু এরই মধ্যে জীবনের পাঁচটি বছর চলে গেছে। বড় ভাই আব্দুস শহীদ তাঁকে গ্রামের মো. মনির উদ্দিন, বিকম স্যারের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘চাচা আমার ছোট ভাই স্কুলে পড়তে চায়। আপনি ওকে পরীক্ষা করে দেখেন তো ওই কোন ক্লাসে পড়তে পারবে। স্যার আব্দুর রবকে বাংলা, ইংরেজী, গণিত ও আনুষাঙ্গিক আরো কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বললেন যে, ও যদি দুই/তিন মাস আমার কাছে বীজগণিত ও ইংরেজী পড়ে তবে অষ্টম শ্রেণীতে পড়তে পারবে। আমি তাকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত আমার কাছে পড়েছে বলে একটি প্রত্যয়নপত্র দেব যার মাধ্যমে সে যে কোন উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারবে। ইহা শুনে আব্দুর রব নিজে কিছুটা স্বস্তি পেলেন যে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছোট ছোট শিক্ষার্থীর সাথে পড়তে হবে না। স্যারের প্রত্যয়নপত্র দ্বারা ১৯৬৬ ইংরেজীর ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে তিনি জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি ওই বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য সিলেট এমসি কলেজে আবেদন করেন। ইংরেজী ও গণিত বিষয়ে ভাল নম্বর থাকায় এবং ভাল ফুটবল প্লেয়ার হওয়ার জন্য এমসি কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। ছাত্রাবাসে থাকারও সুযোগ পান। ফিস এর টাকার জন্য বাড়ি যাওয়ার সময় স্থানীয় নবপ্রতিষ্ঠিত বিয়ানীবাজার কলেজে ভর্তি হওয়া আব্দুর রবের সতীর্থরা এক রকম জোর করে তাকে বিয়ানীবাজার কলেজে নিয়ে বিনা পয়সায় ভর্তি করিয়ে দেন। তিনি বিয়ানীবাজার কলেজের ১৯৬৯ সালের শিক্ষার্থী হন।

শিক্ষা জীবন : শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ আব্দুর রব এর শিক্ষা জীবন খুবই বিচিত্র। ১৯৫৫ ইংরেজিতে কালাই উরা (সি পি) বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৯ ইংরেজিতে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেন। তিনি ১৯৬৯ ইংরেজি জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয় হতে কুমিল্লা বোর্ড থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৪ ইংরেজিতে ঢাকা বোর্ডের অধীনে সরকারী তিতুমীর কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে এইচএসসি তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন।  ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত শিক্ষার্থী হিসাবে বিএ পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। ১৯৯৭-৯৮ সেশনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন।

শিক্ষকতা জীবন : বিমান বাহিনীর চাকুরীর শেষ দিকে কেবলই তাঁর মনে হতো-বিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতে ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখতে হতো। তিনি লিখতেন ‘আমি একজন শিক্ষক হব।’ আর চাকুরী জুটলো সামরিক বাহিনীতে। বিমান বাহিনীর চাকুরীর মেয়াদ শেষ হলে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার নব প্রতিষ্ঠিত হাজী ইউনুছ মিয়া মেমোরিয়েল উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৮৯ ইংরেজির আগষ্ট মাসে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৯৪ ইংরেজির অক্টোবর মাসে জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। এরপর বিয়ানীবাজারের প্রাচীনতম উচ্চ বিদ্যালয় ‘পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ হাইস্কুল’ এ সরকারী প্রধান শিক্ষক এর শূন্য পদে আবেদন করে উক্ত পদে ১৯৯৯ সালের ১ আগষ্ট নিয়োগ লাভ করেন। ২০০৭ ইংরেজির শেষার্ধে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কারণ ২০০৪ সাল থেকে সরকারী পরিপত্র মোতাবেক সকল প্রকার শিক্ষক নিয়োগ বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে শিক্ষক নিয়োগের জটিলতা নিরসন হলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচারে সরকারী নীতি না মেনে কমিটির সদস্যদের নিজেদের অযাচিত শর্ত আরোপের ফলে তাঁর সাথে বিরোধের সৃষ্টি হয়। তাদের এ অন্যায় মেনে না নিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন। এই সময় উপজেলার ‘মাথিউরা দ্বিপাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয়’ এর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যবর্গের অনুরোধে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর যোগদান করেন।  ২০১২ সালে পি এইচ জি হাইস্কুলের নব গঠিত কমিটি কর্তৃক প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রচার হলে তিনি আবেদন করেন এবং পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী হিসাবে ২০১২ সালের ১৫ জুলাই প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ২০১৩ ইংরেজির শেষ দিকে বয়স ষাট বছর পূর্ণ হওয়ায় সরকারী বিধি মোতাবেক অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পর নব প্রতিষ্ঠিত নিদনপুর সুপাতলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তির অনুরোধে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে অদ্যবধি উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এর দায়িত্ব পালন করছেন।

বিমান বাহিনীতে চাকরি : তিনি  ১৯৬৬ ইং জলঢুপ উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি করার পর বড় ভাই আব্দুস শহীদ ঐ বছর পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকুরি পেয়ে যান। ১৯৭০ সালে জানুয়ারি মাসে ছুটিতে বাড়ি আসেন। কি যেন একটি কাজে ঢাকা শহরে যাবেন শুনে আব্দুর রবও তাঁর সাথে ঢাকা যাওয়ার বায়না ধরেন। তিনি তাকে সঙ্গে নিলেন। ট্রেনে ঢাকা গেলেন এবং নবাবপুর রোডের একটি হোটেলে রাত্রিযাপন করেন। ভোরে উঠে বড় ভাই যেন কোথায় চলে গেলেন। তিনি হোটেল থেকে বের হয়ে নাস্তা করে ঢাকা শহর দেখার জন্য এদিক সেদিক হাঁটতে থাকেন। কিছু দূর গিয়ে দেখেন তাঁর বয়সী অনেক লোকজন একটি ছোট মাঠের মধ্যে একত্রিত হয়েছে। কাছে গিয়ে জানতে পারলেন যে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে লোক নেয়া হচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি দ্বিতীয় বিভাগ। তিনিও তাদের সাথে যোগ দিলেন। যথাসময়ে বিমান বাহিনীর পোষাক পরিহিত ৩/৪ জন লোক এসে তাদেরকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে শারীরিক উচ্চতা দেখে সবাইকে দুই ভাগে ভাগ করে কম উচ্চতাভূক্ত লোকদের চলে যেতে বলেন। অপর সবাইকে আলাদা চেয়ার টেবিলে বসিয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়। তিন গ্রুপে মোট ১৫০ জন পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষার ঘন্টাখানেক পরে ফলাফল ঘোষণায় দেখা যায় তিনিসহ তেরজন পাশ করেছেন। পরে ঐ দিনই মেডিকেল পরীক্ষায় সাতজন নির্বাচতি হলে নাম ঠিকানা লিখে রেখে তারা বিমান বাহিনীতে চাকুরি পেয়ে গেছে বলে জানানো হয়। হোটেলে এসে বড় ভাইজানকে সবকিছু বলে তাঁর রোল নং সম্বলিত কাগজ দেখালে তিনি বললেন যে, সত্যিই চাকুরী হয়ে গেছে। ১৯৭০ ইংরেজির জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে on pakistan state service লিখা একটি খাম পেলেন। যাতে লিখা ছিল ১৫ই জুন ঢাকায় যেখানে পরীক্ষা দিয়েছিলেন সেখানে গিয়ে যেন চাকুরীতে যোগদান করেন। পরিচিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে ঢাকায় যোগদান এবং ট্রেনিং এর জন্য তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা শহরে চলে যান।
প্রাথমিক পর্যায়ের ২৪ সপ্তাহ ট্রেনিং শেষে পেশাগত ট্রেনিংয়ের জন্য ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধে করাচী যান। মাস দুয়েক পর মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়। তাদের ট্রেনিং কিন্তু চলতে থাকে। ৩৬ সপ্তাহের ট্রেনিং শেষে ১৯৭১ ইংরেজীর অক্টোবর মাসে রিসালপুর গেলে বিমান বাহিনীর পুরাতন সদস্যদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর তখনই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ অবস্থার কথা বুঝতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের কারণে পাকিস্তানী সদস্যরা বাঙালীদের সন্দেহ করতে থাকে। তাদের মধ্যে চালচলন ও আচার ব্যবহারে পার্থক্য বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বাঙালী সদস্যদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ ইংরেজির ১৬ইং ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় সকল বাঙালী সদস্যকে আলাদা ক্যাম্পে নেয়া হয় এবং বন্দীলোকদের মতো রাখা হয়। প্রায় দুই বছর পর রেডক্রস এর মাধ্যমে ১৯৭৩ ইংরেজির অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগদান করেন।

তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফুটবল টিমের নিয়মিত খেলোয়াড় হওয়ায় প্রায় সারা বছরই খেলাধূলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন অন্য কোন দিকে নজর দেওয়ার সময় ছিল না। চাকুরি মেয়াদ ছিল আটারো বছর অর্থাৎ ১৯৮৮ ইংরেজির জুন মাস পর্যন্ত। চাকুরীর মেয়াদ শেষ হলে অবসর গ্রহণ করে গ্রামের বাড়ি চলে আসেন।

দায়িত্ব পালন : তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর পরিচালনা কমিটির সদস্য, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সমূহের কার্যাবলী নির্ধারক, বিয়ানীবাজার আদর্শ মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন সাংগঠনিক কমিটির সেক্রেটারী ও বর্তমান গভর্নিং বডির সদস্য, সিলেট শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজি বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক, এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র সচিব, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি বিয়ানীবাজার উপজেলা শাখার সেক্রেটারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

পারিবারিক : তিনি পারিবারিক জীবনে এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক। বড় ছেলে মো. শরীফুল ইসলাম রবিন বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ( সম্মান ) সম্পন্ন করে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে গিয়ে এমবিএ পড়ে লন্ডন শহরে বসবাস করছে। মেজো ও ছোট মেয়ে যথাক্রমে রোমেনা আক্তার রুমি ও সোহানা আক্তার রুনা বিএ পাশ করার পর বিবাহিত জীবনযাপন করছে।

এই সফল শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুর রব ন্যায় নীতির প্রতি ছিলেন নিষ্টাবান। বিমান বাহিনীতে চাকরী করেন। ফলে আরো দৃঢ়ভাবে ন্যায় নীতিতে অটল ছিলেন। এর ব্যতিক্রম কখনই সহ্য করেননি। অধিকাংশ লোক যদি কোন অন্যায় মেনে নেয় তিনি একমত না হয়ে বরং ওই পরিবেশ থেকে সরে আসেন। এই জীবনগুলো যেভাবে কেটেছে তাতে কোন নির্দিষ্ট ঘটনার গুরুত্ব ছিল না। এই শিক্ষকের জীবনে এক এক পরিস্থিতিতে একটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়। তিনি যে কাজই করেন না কেন আন্তরিকতার সাথে করেছেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মোহাম্মদ আব্দুর রব এর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের মূল্যায়ন করবে শিক্ষার্থীরা এবং বাকী কাজগুলোর মূল্যায়ন করবে কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ জনগণ।গুনী এই শিক্ষকের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ূ কামনা করি।

লেখক : ফয়সল আহমদ রুহেল , সাউথ ইষ্ট লন্ডন প্রতিনিধি, চ্যানেল এস টেলিভিশন।