শ্রীমঙ্গলে হস্ত কুটির শিল্প ও বাণিজ্য মেলার আড়ালে এসব কি হচ্ছে ! মেলা বন্ধের দাবীতে স্মারকলিপি
- আপডেট সময় ০১:২১:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর ২০২৩
- / ৮৫৬ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ প্রতিনিধি: শ্রীমঙ্গলে হস্ত কুটির শিল্প ও বাণিজ্য মেলার নামে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। হস্ত কুটির শিল্প মেলার নাম ভাঙিয়ে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে একটি চক্র দর্শনার্থীদের নানান বিনোদনের পসরা বসিয়ে এ টাকা ভাগবাটোয়ারা করে লুটেপুটে নিচ্ছে। সংঘবদ্ধচক্রটি বিভিন্নমহলকে ম্যানেজ করে দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলাসহ বিভিন্ন রাইডের মাধ্যমে বিভিন্ন অংকের প্রবেশ মূল্য দিয়ে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করে মেলার অন্যতম আয়ের খাত তৈরী করেছে।
অন্যদিকে হস্ত কুটির শিল্প মেলার আড়ালে শিশুদের জন্য নানান খেলনার দোকান ক্রোকারিজ, কসমেটিক্স,প্রসাধনী,জুতা,কাপড় চোপড়,সার্ট প্যান্ট,কোটের দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মোট অংকের সেলামী দিয়ে মেলায় বসানো হয়েছে।
ফলে শহরের ব্যবসায়িরা তাদের ব্যবসায় লোকসানের শঙ্কায় অবিলম্বে এ মেলা বন্ধের দাবীতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। এ মেলা অবিলম্বে বন্ধের জন্য স্বারকলিপিও দিয়েছে প্রশাসনের কাছে। ব্যবসায়িরা দ্বারস্থ হচ্ছেন স্থানীয় এমপি,প্রশাসন,জনপ্রতিনিধিসহ ব্যবসায়ি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছে।
তাদের দাবী যদি এ মেলায় হস্ত কুটির শিল্পের তৈরীর পণ্য বিক্রি করা হতো তাহলে ব্যবসায়ি মহলের কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু এ বাণিজ্য মেলার আড়ালে এ মেলায় মৌসুমী ব্যবসায়িরা নানান ধরনের খেলনা,ক্রোকারিজ,কসমেটিক্স,জুতা,কাপড় চোপড়ের দোকান বসিয়ে শহরের স্থায়ী ব্যবসায়িদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মূখীন করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৌর শহরের ভানুগাছ রোডস্থ রেলওয়ে মাঠে এ মেলা আয়োজন করেছে ‘মা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’। আনুষ্ঠানিকভাবে কোন উদ্ভোধন না করা হলেও গত এক সপ্তাহধরে পুরোদমে এ মেলা চলছে। মেলার ভেতরে একটি ব্যানার টাঙানো রয়েছে। এতে লিখা আছে-হস্ত কুটির শিল্প ও বাণিজ্য মেলা -২০২৩। শুভ উদ্বোধন ,২৬-০৯-২০২৩ খ্রি.। আয়োজনে:‘মা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’।
সোমবার (২ অক্টোবর) বিকেল তিনটায় এ মেলায় প্রবেশ করে দেখা যায়,দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মৌসুমী ব্যবসায়ীরা অনন্ত: অর্ধশতাধিক স্টলে নানা বয়সীদের গেঞ্জি, কাপড় চোপড়, ত্রিপিচ, সার্ট,পাঞ্জাবী, বাচ্চাদের কাপড়, জুতা, কসমেটিক্স, বাচ্চাদের নানা খেলনা,প্রসাধনী,স্যুট কোট, ক্রোকারিজসহ নানা প্রকারের খাবারের দোকানসহ সব ধরনের পণ্যের দোকান নিয়ে বসেছেন।
তবে যে উদ্দেশ্যে মেলার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে- পুরো মেলা ঘুরে হস্ত কুটির শিল্পের কোন স্টল বা দোকানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ শিশু,তরুনদের আকৃষ্ট করতে বা যে কোন বয়সী দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলা,ঘুর্ণায়মান চড়কীচড়াসহ বিভিন্ন রাইডের ব্যবস্থা রয়েছে এ মেলায়। মেলা প্রাঙ্গণে মূল ফটকের পাশেই রয়েছে, মনোরম ফোয়ারা। মেলার মধ্যস্থলে আয়োজক সংগঠনের একটি কার্যালয় তৈরি করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য মেলার ভেতরে টিকিটের হার লিখে সাইবোর্ড টাঙানো রয়েছে। যেমন-নাগরদোলা টিকিট কাউন্টারে লিখা রয়েছে- নাগরদোলায় প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা,মেডি ঘোড়া প্রবেশমূল্য ৫০টাকা,নৌকা ভ্রমণ,সুপার চেয়ার,মিনি রেলগাড়ী চড়া প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা। এছাড়া মেলায় ওয়াটার বল তৈরী করা হয়েছে,এর প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করে টিকিট কাউন্টার খোলা হয়েছে। স্লিপার ও জাম্পিং প্রবেশ মূল্য জন প্রতি ১০ মিনিট ১০০টাকা ও ওয়াটার বোর্ড প্রবেশ মূল্য ৫ মিনিট ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস টিকেট কাউন্টার ট্রেনের প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা আর নৌকা প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা লিখা রয়েছে।
আর মেলার স্টলের বাইরে বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য ৩০ থেকে ৫০ টাকার টিকিটে ভূতের বাড়ী নামে একটি ঘর বানানো হয়েছে। ভুতের বিনোদন দেখতে এটিতে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। মেলাতে বিনোদনের জন্য নয়টি ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছে।
যার সবকটিতেই নির্দিষ্ট অংকের টাকা গুণতে হয়। তাছাড়া মেলায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য চারটি প্রবেশপথ রয়েছে। যে কোন প্রবেশ পথে মেলায় ঢুকতে একেকজনকে ২০টাকা টিকিট কিনে ঢুকতে হয়। তবে মেলা আয়োজকরা শহরে মাইকিং করে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে বলেছেন যারা টিকিট কিনে মেলায় প্রবেশ করবে-তাদের জন্য রয়েছে, লটারীর মাধ্যমে আকর্ষণীয় পুরুষ্কার। সে লক্ষ্যে কেনা এ টিকেটের একটি অংশ মেলায় রাখা টিনের তৈরী একটি ডামের বাক্সে রাখারও ব্যবস্থা রয়েছে। বলা হচ্ছে,মেলায় বিক্রিত টিকিটের লটারীর মাধ্যমে আকর্ষণীয় পুরুষ্কার দেয়া হবে। এ মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মেলা চলে। দেখা গেছে,সন্ধ্যার পর মেলায় শিশু কিশোরসহ সব বয়সী মানুষের ঢল নামে। এ হস্ত ও কুটির শিল্প মেলার নামে শহর ও গ্রামে মাইকিং করে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে মেলাকে আকর্ষণীয় করে তোলা হচ্ছে। ফলে মেলামূখি হচ্ছে সব বয়সী মানুষেরা।
এদিকে হস্ত কুটির শিল্প মেলার আড়ালে মেলায় সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রতিদিন প্রবেশ মূল্য সর্ব নিম্ন ২০ থেকে বিনোদনের জন্য নাগরদোলাসহ বিভিন্ন রাইডের মাধ্যমে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তুলেছে বিভিন্ন মহল। এবং তা অবিলম্বে বন্ধের দাবীতে প্রশাসনের কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছে,শ্রীমঙ্গল শহরের বস্ত্র ব্যবসায়ি সমিতি
এ সংগঠনটির আহবায়ক ব্যবসায়ি ফজলুর রহমানের স্বাক্ষরিত ওই স্মারক লিপিতে বলা হয়েছে-হস্ত ও কুটির শিল্পর নামে বাণিজ্য এই মেলায় হস্ত কুটির শিল্পের নামে একটি দোকানও নেই। গত রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার কার্যালয়ে ইউএনও বরাবরে এ স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। এর অনুলিপি দেয়া হয়েছে বিভিন্ন স্থানে।
অভিযোগ করে শ্রীমঙ্গল শহরের বস্ত্র ব্যবসায়ি লেডিস ফেয়ারের কর্ণধার জয়নাল আবেদীন বলেন-এই মেলার ভিতরে ঘুরে দেখে আসুন-একটা দোকানও নেই হস্ত ও কুটির শিল্পর মাধ্যমে তৈরী করা পণ্যের। তিনি জানান- যদি মেলা মাসব্যাপী চলে তাহলে আমরা সাধারণ ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। এমনকি স্থানীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাবসহ ব্যবসায়ীদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে।
তাছাড়া এ মেলাকে ঘিরে উঠতি বয়সী তরুন তরুনীদের অবাধ আড্ডা ও মারামারিসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড মেলায় ঘটার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। কারণ এর আগেও এধরণের মেলায় মারামারির ঘটনা ঘটেছে। আর এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ি সমিতির সহ সভাপতি দেবাশীষ ধর পার্থ মুঠোফোনে বলেন-‘এখানে হস্ত ও কুটির শিল্প মেলা হলে আমাদের ব্যবসায়ি সমাজের কোন আপত্তি ছিল না। কিন্ত এটার নামে তারা দোকান বসিয়ে অত্যন্ত নিম্নমানের বস্ত্র এনে উচ্চ দামে বিক্রি করছে এর ফলে যেমনি শ্রীমঙ্গলের মানুষজন যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তেমনি স্থানীয় ব্যবসায়িরাও ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। কারণ সামনে দুর্গাপূজা। পূজা উপলক্ষে স্থানীয় ব্যবসায়িরা অনেকে ঋণগ্রস্থ হয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। তারা সিকিউরিটি দিয়ে দোকানঘর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। এ মেলায় কাপড়ের দোকান,জুতা,কসমেটিক্স সামগ্রী বিক্রির ফলে ব্যবসায়িরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। এ নিয়ে গত পরশুদিন রাতে ব্যবসায়ি সমিতি কার্যালয়ে বস্ত্র ও পাদুকা ব্যবসায়ি সমিতির বৈঠক হয়। এর পর স্থানীয় সংসদ সদস্য ড.উপাধ্যক্ষ মো,আব্দুস শহীদ স্যারের বাসভবনে গিয়ে ব্যবসায়ি সমিতি ও বস্ত্র ব্যবসায়ি সমিতির নেতৃবৃন্দের মেলা বন্ধে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে। আর হস্ত কুটির শিল্পর মেলার নামে বস্ত্র বিক্রি ও বিনোদনের নামে টিকিট বিক্রির আয়োজন করতে পারে না। তিনি তাৎক্ষণিক ইউএনও ও থানার ওসি কে ডেকে এনে বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দেন। এবং দুইদিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সময় বেঁধে দেন। এসময় তারা ১৫ দিনের জন্য মেলা পারমিশন নিয়েছে বলে জানান’।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান হাজী মোহাম্মদ লিটন আহমেদ মুঠোফোনে বলেন- ‘আমরা ব্যবসায়িমহল সহ বিভিন্ন বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছি, শ্রীমঙ্গলে হস্ত ও কুটির শিল্প মেলার আয়োজনের নামে সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করা হচ্ছে। যে মেলায় বস্ত্র ও কুটির শিল্পর তৈরীর পণ্য সামগ্রির বিক্রির স্টল করার কথা। অথচ এর বিপরীতে মেলায় বসানো হয়েছে-মার্কেটে বিক্রির কাপ চোপড়,ত্রি-পিচ,সার্ট,পাঞ্জাবী,বাচ্চাদের কাপড়,জুতা,কসমেটিক্স,প্রসাধনী সামগ্রী,বাচ্চাদের খেলনা,ক্রোকারিজসহ সব ধরনের পণের দোকান। আর মেলায় তরুন প্রজন্মকে আকর্ষণীয় করতে মূল আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে- দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলাসহ বিভিন্ন রাইডের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার যতো ব্যবস্থা। এটাকে কি শিল্প ও বাণিজ্য মেলা বলে? এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি অবিলম্বে স্থানীয় ব্যবসায়িদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও মেলার আড়ালে এহেন কর্মকান্ড বন্ধে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবী জানান’।
জানতে চাইলে মেলার আয়োজক জাবেদ হোসেন লিটন মুঠোফোনে বলেন-‘মেলার পারমিশনে যে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে,তার সব গুলি আমরা পালন করছি। ভ্যাট,ট্যাক্স,এল আর ফান্ডসহ সবকিছু দিয়ে একমাসের জন্য আসছি। নাগরদোলাসহ সব বিনোদনের জন্য সবকিছুরই পারমিশন আছে। একটা মেলার পারমিশন হলে এগুলা সবকিছু লাগে। তাছাড়া মেলার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। মেলায় ৩৬ টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। তাছাড়া পুলিশ প্রশাসনের কাছেও আবেদন করেছি মেলার নিরাপত্তায় তিনজন ফোর্স দেয়ার জন্য। উনারা সার্বক্ষনিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবেন’।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলার জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম বলেছেন- আসলে ওরা মেলার অনুমতির জন্য আমাদের এখানে এপ্লিকেশন করার পর,প্রতিবেদনের জন্য আমরা চেম্বার অব কমার্সে পাঠিয়েছি। তার পর পুলিশ সুপারের দপ্তরে পাঠিয়েছি। তখন ওখান থেকে দিয়েছে যে, করা যেতে পারে। তারপর উপজেলা থেকে আমরা রিপোর্ট নিয়েছি। তার পরিপ্রেক্ষিতে সবাই যখন বলছে, আমরা মেলার পারমিশন দিয়েছি। এখন স্থানীয় ব্যবসায়িগণ যে অভিযোগ দিয়েছেন,তা আমি এখনও পাইনি। পেলে আমি দেখব। তবে অভিযোগ যেহেতু দিয়েছে,আমরা এটা খোঁজ নিচ্ছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলছি।