ঢাকা ০৮:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো. আমজদ আলী স্যার :নিজের কর্মদক্ষতা ছড়িয়েছেন নানা প্রান্তে

নিজস্ব সংবাদ :
  • আপডেট সময় ০১:০০:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • / ৬৫৮ বার পড়া হয়েছে
ফয়সল আহমদ রুহেল : বাড়ি থেকে ৫ কি.মি. দুরে ছিল স্কুল। পায়ে হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে আসা- যাওয়া। স্কুল থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ৫ জন ছাত্রীকে পড়ানোর শর্তে লজিংও থেকেছেন। বারবার দুর্ভাগ্যও পিছু ছাড়েনি। তারপরও জীবন থেমে থাকেনি। জীবনযুদ্ধে লেগে যান। কর্মজীবন শুরু করেন কন্ট্রাক্টর হিসেবে। এরপর শিক্ষার মহান ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা শুরু। এই গুণী শিক্ষক হলেন মো. আমজদ আলী স্যার। তিনি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ভান্ডারীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : 
মো. আমজদ আলী ১৯৫৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুরের উত্তর গোলের হাওর এ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত মো. মাহবুব আলী এবং মাতা মৃত কুলসুম বিবি। মো. আমজদ আলী ৪ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি ৫ম।
শিক্ষাজীবন : 
 মো. আমজদ আলী ২নং ভান্ডারীগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইসলামপুর থেকে ১৯৬৫ সালে ৫ম শ্রেণী পাশ করেন। এরপর তিনি ১৯৭১ সালে ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গল থেকে এসএসসি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে মানবিকে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে মানবিকে ৩য় বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে ঢাকার মুহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা- ইন এডুকেশন ২য় বিভাগে পাশ করেন। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিলেট এমসি কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিএ ৩য় বিভাগে পাশ করেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালে সরকারী টিচার্স কলেজ, কুমিল্লা থেকে ২য় বিভাগে উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে বিএড সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন : 
তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কন্ট্রাক্টর (ঠিকাদারী) হিসেবে। কয়েক বছর পর নিজ গ্রামের পাশে ‘ভান্ডারীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার কাজে যোগ দেন এবং ১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ওই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে একই বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর মোট ৩৫ বছর চাকুরীর পর অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবেও ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১২ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
বর্ণাঢ্য জীবন :
১৯৬৬ সালে মো. আমজদ আলী বাড়ি থেকে ৫ কি.মি. দুরে এম এ ওহাব উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কাঁচা রাস্তায় প্রতিদিন যথাসময়ে স্কুলে রওয়ানা দিয়ে সন্ধায় বাড়িতে ফিরে আসেন। এভাবে দুই বছর পার করেন। ভালো স্কুলে পড়ার আগ্রহে বাড়ি থেকে ১৫ কি. মি. দুরে থানা সদরে কমলগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৬৮ সালে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিছু দিন মনের আনন্দে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করেন, পরে আর পারেননি। স্কুল থেকে প্রায় ৪/৫ কি.মি. দুরে আলিপুর গ্রামে নাইওর মিয়ার বাড়িতে ৫ জন ছাত্রীকে পড়ানোর শর্তে একটি লজিং পান। কোনোমতে একটি বছর পার করেন। কিন্তু লজিং বাড়িতে সমস্যার কারণে আর থাকা হয়নি। এরপর থাকার জন্য দ্বিতীয় লজিং পেলেন না। পরবর্তী বছর আবার সেই আগের স্কুলে ফিরে আসেন। আবারও ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর ১০ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। কিন্তু ১ম পরীক্ষার দিন আমজদ আলীর দাদিমা ইন্তেকাল করেন। তাঁর পরীক্ষা দেয়া হল না। পরদিন স্কুলে পরীক্ষার হলে ঢুকতে দেয়া হল না তাঁকে। আগামী বছর আবার দশম শ্রেণিতে ভর্তি হতে বলেন। অনেক অনুরোধের পরও কিছু হল না। এক বছর নষ্ট করার চেয়ে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেয়ার জন্য  গ্রামের আব্দুস ছামাদ স্যার পরামর্শ দিলেন। তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। বাড়ি থেকে ৩৫ কি.মি. দূরে শ্রীমঙ্গল থানায় ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে নাম লেখালেন। পরীক্ষার জন্য আবারো থাকার একটি লজিং খুঁজে পেলেন। এভাবে ১৯৭০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলেন। কিন্তু বিধিবাম পাকিস্তান সরকার পরীক্ষা বাতিল করে দিল। আবারও ১৯৭১ সালে পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন।
১৯৭২- ৭৩ সেশনে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে এইচএসসি মানবিক বিভাগে ভর্তি হলেন। বিভিন্ন লজিং বাড়িতে থেকে অবশেষে ১৯৭৪ সালে এইচএসসি মানবিক ৩য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি সিলেট সরকারি কলেজে বিএ ১৯৭৪- ৭৫ সেশনে ভর্তি হন। এবার হোস্টেলেই থাকার সুযোগ হয়। ওয়েস্টার্ন ব্লকে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। কিন্তু এবারো দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষার পূর্বদিন থেকে কঠিন অসুখে পড়েন। পরীক্ষার হলে যেতে পারেননি। হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। বিষন্ন মনে এবার বাড়িতে ফিরে আসেন। কিছু দিন পর জীবনযুদ্ধে লেগে যান। কন্ট্রাক্টরের কাজ করতে থাকেন। এমন সময় বাড়ির পাশে গড়ে উঠা ‘ভান্ডারীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়’ নানান ঝামেলায় জর্জরিত। তাকে স্কুলে পড়াতে বলেন কমিটি। রাজি হয়ে যান তিনি। ১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সহকারী শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগদান করেন। এরপর ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি জুনিয়র স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্কুলের জমির রেজিষ্ট্রেশন ও ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখেন। স্কুলটি ১৯৮৪ সালে ১ম এমপিওভুক্ত হয়। তাঁকে জেডিপিই কোর্স করানো হয়। তাই শিক্ষার্থীদের পুরোদমে তৈরি করতে থাকেন। জেলা, বিভাগের বিভিন্ন আইটেমে সফলতা আসে। জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ লম্ফ আইটেমে অংশগ্রহন করে সুনাম অর্জন করে।
সংগঠক :
 মো. আমজদ আলী মণিপুরী মুসলিম সমাজের প্রায় সবক’টি সংগঠনের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন এবং এখনও আছেন। বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম ডেভেলাপম্যান্ট অর্গেনাইজেশন (বামডো) গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছাড়াও দীর্ঘদিন ক্রীড়া সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। মণিপুরী মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্ট- এর সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। এছাড়া ‘মণিপুরী মুসলিম কমিউনিটি অব বাংলাদেশ’ এর সহ-সভাপতি ও মণিপুরী মুসলিম টিচার্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি উত্তর গোলের হাওর জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯৬৭ সাল থেকে কমিটির সাথে জড়িত এবং অদ্যাবধি মোতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্বে আছেন।
ছাতার মধ্যে সাপ :
মো. আমজদ আলী যখন ১৯৬৩ সালে ৩য় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী তখন ২ নং ভান্ডারীগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে তিনি ছাতা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। তখন হঠাৎ ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলে দৌড়ে গিয়ে ছাতাটি হাতে নিয়ে নিজের শার্টের পেছনের কলারে ঝুলিয়ে দৌড় দিলেন। পেছন থেকে শ্রদ্বেয় প্রধান শিক্ষক সামছুদ্দিন স্যার তাঁকে চিৎকার করে ডাক দিয়ে যাচ্ছেন, আমজদ আলী যখন শুনতে পেলেন তখন রামেশ্বর সিংহ সহকারী শিক্ষক স্যার দাঁড়াতে বলেন, সঙ্গে সঙ্গে একটি বেত দিয়ে তাঁর পেছন থেকে ঘাড় বরাবর আঘাত করেন। তিনি ভয়ে তাকিয়ে দেখেন সামছুদ্দিন স্যার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার ছাতার মধ্যে একটা বিষাক্ত সাপ পেছনের ঘাড়ের উপর ফনা তোলে ছোবল মারতে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস, বেতের আঘাতে পড়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ, বেঁচে গেলে তুমি। এ ঘটনার পর আজও আমজদ আলী স্যার ছাতা হাতে নিতে গেলে খুব সতর্কতা হন আর ভয় পান।
পারিবারিক : 
মো. আমজদ আলী স্যার দুই সন্তানের জনক। এক ছেলে ডা. এহসান আলমগীর, এমবিবিএস (ডিইউ)। তিনি কুলাউড়া উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। আরেক ছেলে হাফিজ মাওলানা আহসান হাবিব। তিনি ৪ মেয়ের জনক। তারা হলেন-আয়েশা খাতুন, মৃত মাছুমা খাতুন, রাহিমা আক্তার (আমেরিকা প্রবাসী) ও নাসিমা আক্তার।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কমলগঞ্জ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
মো. আমজদ আলী স্যার শিক্ষকতার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। নিজের কর্মদক্ষতাকে ছড়িয়ে দেন নানা দিকে, নানা প্রান্তে। এলাকায় তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত । তাঁর অগণিত শিক্ষার্থী জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ ৩৫ বছর শিক্ষকতা জীবনে সফলতার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। অগণিত শিক্ষার্থীদের দোয়া ও ভালোবাসায় আপনার আগামীর বাকী দিনগুলো সুস্থতায় কাটুক-এই প্রত্যাশা করি।
ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

মো. আমজদ আলী স্যার :নিজের কর্মদক্ষতা ছড়িয়েছেন নানা প্রান্তে

আপডেট সময় ০১:০০:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২
ফয়সল আহমদ রুহেল : বাড়ি থেকে ৫ কি.মি. দুরে ছিল স্কুল। পায়ে হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে আসা- যাওয়া। স্কুল থেকে বেরিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ৫ জন ছাত্রীকে পড়ানোর শর্তে লজিংও থেকেছেন। বারবার দুর্ভাগ্যও পিছু ছাড়েনি। তারপরও জীবন থেমে থাকেনি। জীবনযুদ্ধে লেগে যান। কর্মজীবন শুরু করেন কন্ট্রাক্টর হিসেবে। এরপর শিক্ষার মহান ব্রত নিয়ে শিক্ষকতা শুরু। এই গুণী শিক্ষক হলেন মো. আমজদ আলী স্যার। তিনি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ভান্ডারীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক।
জন্ম : 
মো. আমজদ আলী ১৯৫৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুরের উত্তর গোলের হাওর এ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত মো. মাহবুব আলী এবং মাতা মৃত কুলসুম বিবি। মো. আমজদ আলী ৪ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি ৫ম।
শিক্ষাজীবন : 
 মো. আমজদ আলী ২নং ভান্ডারীগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইসলামপুর থেকে ১৯৬৫ সালে ৫ম শ্রেণী পাশ করেন। এরপর তিনি ১৯৭১ সালে ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, শ্রীমঙ্গল থেকে এসএসসি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে মানবিকে ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে মানবিকে ৩য় বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে ঢাকার মুহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা- ইন এডুকেশন ২য় বিভাগে পাশ করেন। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিলেট এমসি কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে বিএ ৩য় বিভাগে পাশ করেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালে সরকারী টিচার্স কলেজ, কুমিল্লা থেকে ২য় বিভাগে উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে বিএড সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন : 
তিনি কর্মজীবন শুরু করেন কন্ট্রাক্টর (ঠিকাদারী) হিসেবে। কয়েক বছর পর নিজ গ্রামের পাশে ‘ভান্ডারীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার কাজে যোগ দেন এবং ১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ওই বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে একই বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর মোট ৩৫ বছর চাকুরীর পর অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবেও ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১২ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
বর্ণাঢ্য জীবন :
১৯৬৬ সালে মো. আমজদ আলী বাড়ি থেকে ৫ কি.মি. দুরে এম এ ওহাব উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কাঁচা রাস্তায় প্রতিদিন যথাসময়ে স্কুলে রওয়ানা দিয়ে সন্ধায় বাড়িতে ফিরে আসেন। এভাবে দুই বছর পার করেন। ভালো স্কুলে পড়ার আগ্রহে বাড়ি থেকে ১৫ কি. মি. দুরে থানা সদরে কমলগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৬৮ সালে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিছু দিন মনের আনন্দে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করেন, পরে আর পারেননি। স্কুল থেকে প্রায় ৪/৫ কি.মি. দুরে আলিপুর গ্রামে নাইওর মিয়ার বাড়িতে ৫ জন ছাত্রীকে পড়ানোর শর্তে একটি লজিং পান। কোনোমতে একটি বছর পার করেন। কিন্তু লজিং বাড়িতে সমস্যার কারণে আর থাকা হয়নি। এরপর থাকার জন্য দ্বিতীয় লজিং পেলেন না। পরবর্তী বছর আবার সেই আগের স্কুলে ফিরে আসেন। আবারও ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর ১০ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। কিন্তু ১ম পরীক্ষার দিন আমজদ আলীর দাদিমা ইন্তেকাল করেন। তাঁর পরীক্ষা দেয়া হল না। পরদিন স্কুলে পরীক্ষার হলে ঢুকতে দেয়া হল না তাঁকে। আগামী বছর আবার দশম শ্রেণিতে ভর্তি হতে বলেন। অনেক অনুরোধের পরও কিছু হল না। এক বছর নষ্ট করার চেয়ে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেয়ার জন্য  গ্রামের আব্দুস ছামাদ স্যার পরামর্শ দিলেন। তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। বাড়ি থেকে ৩৫ কি.মি. দূরে শ্রীমঙ্গল থানায় ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে নাম লেখালেন। পরীক্ষার জন্য আবারো থাকার একটি লজিং খুঁজে পেলেন। এভাবে ১৯৭০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলেন। কিন্তু বিধিবাম পাকিস্তান সরকার পরীক্ষা বাতিল করে দিল। আবারও ১৯৭১ সালে পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন।
১৯৭২- ৭৩ সেশনে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে এইচএসসি মানবিক বিভাগে ভর্তি হলেন। বিভিন্ন লজিং বাড়িতে থেকে অবশেষে ১৯৭৪ সালে এইচএসসি মানবিক ৩য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি সিলেট সরকারি কলেজে বিএ ১৯৭৪- ৭৫ সেশনে ভর্তি হন। এবার হোস্টেলেই থাকার সুযোগ হয়। ওয়েস্টার্ন ব্লকে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। কিন্তু এবারো দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষার পূর্বদিন থেকে কঠিন অসুখে পড়েন। পরীক্ষার হলে যেতে পারেননি। হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। বিষন্ন মনে এবার বাড়িতে ফিরে আসেন। কিছু দিন পর জীবনযুদ্ধে লেগে যান। কন্ট্রাক্টরের কাজ করতে থাকেন। এমন সময় বাড়ির পাশে গড়ে উঠা ‘ভান্ডারীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়’ নানান ঝামেলায় জর্জরিত। তাকে স্কুলে পড়াতে বলেন কমিটি। রাজি হয়ে যান তিনি। ১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সহকারী শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগদান করেন। এরপর ১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারি জুনিয়র স্কুল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্কুলের জমির রেজিষ্ট্রেশন ও ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখেন। স্কুলটি ১৯৮৪ সালে ১ম এমপিওভুক্ত হয়। তাঁকে জেডিপিই কোর্স করানো হয়। তাই শিক্ষার্থীদের পুরোদমে তৈরি করতে থাকেন। জেলা, বিভাগের বিভিন্ন আইটেমে সফলতা আসে। জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ লম্ফ আইটেমে অংশগ্রহন করে সুনাম অর্জন করে।
সংগঠক :
 মো. আমজদ আলী মণিপুরী মুসলিম সমাজের প্রায় সবক’টি সংগঠনের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন এবং এখনও আছেন। বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম ডেভেলাপম্যান্ট অর্গেনাইজেশন (বামডো) গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছাড়াও দীর্ঘদিন ক্রীড়া সম্পাদক ও সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। মণিপুরী মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্ট- এর সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। এছাড়া ‘মণিপুরী মুসলিম কমিউনিটি অব বাংলাদেশ’ এর সহ-সভাপতি ও মণিপুরী মুসলিম টিচার্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি উত্তর গোলের হাওর জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯৬৭ সাল থেকে কমিটির সাথে জড়িত এবং অদ্যাবধি মোতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্বে আছেন।
ছাতার মধ্যে সাপ :
মো. আমজদ আলী যখন ১৯৬৩ সালে ৩য় শ্রেণিতে শিক্ষার্থী তখন ২ নং ভান্ডারীগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে তিনি ছাতা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। তখন হঠাৎ ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলে দৌড়ে গিয়ে ছাতাটি হাতে নিয়ে নিজের শার্টের পেছনের কলারে ঝুলিয়ে দৌড় দিলেন। পেছন থেকে শ্রদ্বেয় প্রধান শিক্ষক সামছুদ্দিন স্যার তাঁকে চিৎকার করে ডাক দিয়ে যাচ্ছেন, আমজদ আলী যখন শুনতে পেলেন তখন রামেশ্বর সিংহ সহকারী শিক্ষক স্যার দাঁড়াতে বলেন, সঙ্গে সঙ্গে একটি বেত দিয়ে তাঁর পেছন থেকে ঘাড় বরাবর আঘাত করেন। তিনি ভয়ে তাকিয়ে দেখেন সামছুদ্দিন স্যার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার ছাতার মধ্যে একটা বিষাক্ত সাপ পেছনের ঘাড়ের উপর ফনা তোলে ছোবল মারতে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস, বেতের আঘাতে পড়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ, বেঁচে গেলে তুমি। এ ঘটনার পর আজও আমজদ আলী স্যার ছাতা হাতে নিতে গেলে খুব সতর্কতা হন আর ভয় পান।
পারিবারিক : 
মো. আমজদ আলী স্যার দুই সন্তানের জনক। এক ছেলে ডা. এহসান আলমগীর, এমবিবিএস (ডিইউ)। তিনি কুলাউড়া উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। আরেক ছেলে হাফিজ মাওলানা আহসান হাবিব। তিনি ৪ মেয়ের জনক। তারা হলেন-আয়েশা খাতুন, মৃত মাছুমা খাতুন, রাহিমা আক্তার (আমেরিকা প্রবাসী) ও নাসিমা আক্তার।
২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত গুনী শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করা হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কৃতি সন্তান জনাব টি, আলী স্যারের নামে প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক চ্যারেটি সংস্থা টি,আলী স্যার ফাউন্ডেশন মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অবসরপ্রাপ্ত দুইজন আদর্শ শিক্ষককে সম্মাননা পদকে মনোনয়নে জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কমলগঞ্জ উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকের সম্মাননার স্বীকৃতি হিসেবে টি, আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলার ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জীবনী ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ফাউন্ডেশনের সভাপতি টি, আলী স্যারের পুত্র বৃটেনের জনপ্রিয় চ্যানেল এস টেলিভিশনের সাংবাদিক ফয়সল আহমদ (রুহেল)।
উল্লেখ্য, ১৪ জন মনোনয়নপ্রাপ্ত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ৫ জনকে আর্থিক সহযোগিতা এবং জেলার আদর্শ শিক্ষকের স্বীকৃতি হিসেবে ৫ জন শিক্ষককে টি আলী স্যার ফাউন্ডেশন সম্মাননা পদকে ভুষিত করবে সংস্থাটি।
মো. আমজদ আলী স্যার শিক্ষকতার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। নিজের কর্মদক্ষতাকে ছড়িয়ে দেন নানা দিকে, নানা প্রান্তে। এলাকায় তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত । তাঁর অগণিত শিক্ষার্থী জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ ৩৫ বছর শিক্ষকতা জীবনে সফলতার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। অগণিত শিক্ষার্থীদের দোয়া ও ভালোবাসায় আপনার আগামীর বাকী দিনগুলো সুস্থতায় কাটুক-এই প্রত্যাশা করি।